বর্তমান সময়ে গ্রামীণ কৃষির হালচাল

প্রকাশিতঃ 12:21 pm | April 10, 2018

:: আসিফ হাসান রাজু ::

আবহমান কাল থেকেই এ দেশের মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। আজ থেকে প্রায় দশ হাজার বছর আগে যখন জলবায়ুতে পরিবর্তন ঘটতে থাকে ধারণা করা হয় তখন থেকে কৃষির উদ্ভব। প্রথমদিকে নারীদের হাত ধরে কৃষি কাজের উদ্ভব হলেও একটা সময় সেই জায়গাটি দখল করে নেয় পুরুষেরা। প্রথম দিকে পাথরের তৈরী যন্ত্রপাতি দিয়ে কৃষি কাজ করা হতো। পরবর্তীতে যখন পশুকে কাজে লাগিয়ে লাঙ্গলের ব্যবহার শুরু হয় তখন কৃষি ব্যবস্থায় মানুষ পূর্বের তুলনায় অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এভাবে মানুষ ধীরে ধীরে কৃষি সমাজ গড়ে তোলে। প্রথমে এসব কৃষক মূলত তাদের জীবন যাপনের জন্য কৃষিকাজ শুরু করলেও ধীরে ধীরে সে বাজার ব্যবস্থার সাথে যুক্ত হতে থাকে।

বর্তমানের যে কৃষি ব্যবস্থা আমরা দেখতে পাই তা একদিনে আসেনি। ঠিক তেমনি আমাদের দেশের কৃষি ব্যবস্থাও নানা ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। যার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো প্রযুক্তির ব্যবহার, উদারনৈতিক বাণিজ্য, কৃষি যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতা, জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রযুক্তি নির্ভর কৃষিযন্ত্রপাতির ব্যবহার ইত্যাদি।

বিশেষ করে সবুজ বিল্পবের পরবর্তী সময়ে এদেশের কৃষি ব্যবস্থায় বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে দেশে যে কৃষি ব্যবস্থা সেটি উপনিবেশবাদের পূর্বে এক রকম ছিল আর পরবর্তিতে অন্য রূপ ধারণ করে। উপনিবেশবাদের পূর্ববর্তী সময়ে উপমহাদেশের মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা ছিলনা। সামগ্রিকভাবে জমির মালিকানা নির্ধারণ করা হতো। রাষ্ট্র অথবা রাজা ছিল জমির মালিক। সেঁচ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতো রাষ্ট্র। কিন্তু উপনিবেশবাদের পরবর্তী সময়ে এ ধারনার পরিবর্তন ঘটে। ফলে মানুষ ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারনা লাভ করে।

বর্তমান যে কৃষি ব্যবস্থা এবং পূর্বে যে ব্যবস্থা ছিল তার মধ্যে বিভিন্ন ধরণের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে দেখা যায় যে, নির্দিষ্ট এলাকার কৃষি ব্যবস্থায় জলবায়ুর পরিবর্তন, বন্যা, খরা, প্রযুক্তির ব্যবহার, বিদেশী বীজের ব্যবহার, পূর্বের তুলনায় কিটনাশক ব্যবহার এবং সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ফলে কৃষির ক্ষেত্রে এক নব বিপ্লব সাধিত হয়েছে।

এছাড়াও পরিবার ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থার মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক নঁওগা জেলার পত্নীতলা উপজেলার পাটিচোরা ইউনিয়নের উপর এক নৃবৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে তথ্য উঠে এসেছে যে, আগের তুলনায় সেখানকার মানুষ কৃষি কাজে অধিক হারে প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে। পূর্বে যেখানে সনাতন পন্থায় চাষাবাদ, উৎপাদন, ভোগ, বাজারজাতকরণ ইত্যাদি পদ্ধতি ছিলো সেখানে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

আন্তর্জাতিক খাদ্য গবেষণা সংস্থার (ইফপ্রি) পরিচালক কৃষি মন্ত্রণালয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদন পরিবর্তনের দৃশ্যপট সম্পর্কিত বিষয়টি উপস্থাপন করে বলেন, নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এদেশে অন্যান্য শস্য যেমন শাকসবজি ও ফল উৎপাদনে কৃষকরা তেমন আগ্রহী ছিল না। শস্য উৎপাদনের অন্যতম উপায় হলো কৃষি উপকরণ যেমন সার, বীজ ও সেচ যথাসময়ে কৃষকদের বিতরণ করা। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বিদেশি উন্নয়ন সংস্থা একাধিক শস্য বৈচিত্রকরণ প্রকল্পে সহায়তা করলেও এ লক্ষ্য সম্পূর্ণ অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এর মূল কারণ অন্যান্য শস্য অতটা লাভজনক ছিল না। পূর্বে যেখানে লাঙ্গল দিয়ে হাল চাষ করা হতো বর্তমানে সেখানে পাওয়ার ট্রিলার, পূর্বে যেখানে বৃষ্টির পানির উপর নির্ভর করতে হতো এখন সেখানে গভীর নলকূপ, ছোট মটার এসেছে। আগে যেখানে জৈব সার, প্রকৃতি নির্ভর কৃষিব্যবস্থা প্রচলিত ছিল এখন সেখানে প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি ব্যবস্থা বিদ্যমান।

এছাড়া নানা ধরনের দেশী-বিদেশী সার, বীজের পর্যাপ্ততার ফলে নানা ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এদেশের কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তনে উপমহাদেশের কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তন বেশ ভুমিকা রেখেছে। কেননা উপনিবেশবাদ ও উত্তর উপনিবেশবাদের কৃষি ব্যবস্থা এক নয়।

এসময়ে উপমহাদেশের কৃষি ব্যবস্থায় বেশ কিছু ভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা, রায়াতী পদ্ধতি, মালগুজারী পদ্ধতি চালু হয়। ফলে যারা স্বপোষী কৃষি কাজের সাথে যুক্ত ছিল তাদেরকেও ট্যাক্স প্রদান করতে হতো। যার মাধ্যমে কৃষক আরোও বেশী নিবিড় চাষের দিকে ঝুকে পড়ে। কৃষির এ পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে পূর্বে যেখানে ছিল নিজের প্রয়োজনে চাষাবাদ তা এখন বাজার কেন্দ্রীক। কারণ তাকে খাজনা পরিশোধ করতে হবে। যার ফলে মানুষ খাদ্য উৎপাদনের পরিবর্তে অর্থকরী ফসলের দিকে ঝুকে পড়ে। এ সময় জমি হয়ে যায় কেনা বেচার পণ্যের ন্যায়। উপনিবেশবাদের পরবর্তীকালে রাষ্ট্র কলোনিয়াল রূল থেকে সরে এসে পিছিয়ে পড়া কৃষকদের উন্নতির জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ হাতে নেয়। এসময় জমির মালিকানার ব্যাপারে কিছু বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। ফলে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ জমির মালিক হবার পর তার জমি ভূমিহীনের মাঝে বন্টনের রীতি চালু করা হয়। কৃষিকে বাঁচিয়ে রাখতে ঋণের ব্যবস্থাও করা হয়।

বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ‘সবুজ বিল্পব’ ছিল কৃষি ব্যবস্থায় পরিবর্তনের এক যুগান্তকারী মাইলফলক। এ পরিবর্তন এসেছে প্রচলিত পদ্ধতির চাষাবাদ থেকে অধিক উৎপাদনক্ষম নতুন প্রযুক্তির চাষাবাদে রূপান্তরের মাধ্যমে। এটি মূলত উন্নত বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক, পানি সেঁচ ও উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষিতে দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধির কৌশল। বাংলাদেশ ১৯৮০-৯০ এর দিকে বেশকিছু উদারনৈতিক বাণিজ্যের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। এ সময় নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস আমদানীর ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সাবসিটি প্রদান করে এবং নিজেদের উৎপাদিত পণ্য যেন নিজেরা ব্যবহার করতে পারে তার জন্য বিদেশী পন্যের উপর অধিক কর আরোপ করা হয়। রাষ্ট্র এ সময় বাজার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করত।

১৯৭২-৮০ দিকে আমদানীর উপর রাজস্ব নির্ধারণ করা হয়। ১৯৮৪ সালে রাজস্ব ব্যবস্থা উঠিয়ে এলসি পদ্ধতি চালু করা হয় একই সাথে ১৯৮৬ সালে (আইপিওএস) পদ্ধতি চালু হয়। ১৯৮৫ সালে যেখানে ৭৫২ টি পণ্য আমদানী করা যেতনা সেটি ২০০৩-০৬ এসে ৬৩ টিতে নেমে আসে। ফলে এর মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থায় এক বিরাট পরিবর্তন আসে। কেননা এখন বাইরের দেশ হতে উন্নত প্রযুক্তি সম্পন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি, সার, বীজ, কিটনাশক আমদানীর মাধ্যমে বিভিন্ন উন্নত ফসলের চাষ শুরু হয়। আমদানীর ক্ষেত্রে উদারনৈতিকতা চলে আসে। এর ফলে আমদানীর ক্ষেত্রে গভমেন্ট এজেন্সির সাথে যুক্ত হয়। আমদানী পণ্যের উপর থেকে রাজস্বকে সরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি পরিমাণের বাধ্যবাধকতাকে উঠিয়ে নেওয়া হয়। এভাবে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা পূর্বে যেখানে স্বপোষি ছিলো যেটিকে নৃবিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘পেজেন্ট’ সেটি ফার্মারে রূপ নেয়। এভাবে উদ্যান চাষ, পশু শক্তির ব্যবহার, লাঙ্গলের ব্যবহার,সেঁচ ব্যবস্থার উন্নতির মধ্যে দিয়ে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে প্রেট্র কেমিক্যালের আর্বিভাবের মধ্য দিয়ে সেঁচ ব্যবস্থায় আরো উন্নতি সাধন করে বায়ো-টেকনোলজির ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বর্তমান কৃষি ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে। ফলে গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থায় আগে যেখানে মাত্র একবার ধান চাষ করা হতো এখন সেখানে দুই-তিনবার ধান চাষ হচ্ছে। পাশাপাশি নানা ধরনের সবজির চাষাবাদ শুরু হয়েছে।

১৯৭১ সালে যখন দেশ স্বাধীন হয় তখন এদেশের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৭কোটি। তখন কৃষি ছিল অনেকটা প্রকৃতি নির্ভর। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক চিত্র পাল্টে গেছে ব্যাপকভাবে। এসময় দেশে বছরে এক কোটি টন চাল উৎপাদন করতে পারতো যা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় দুই তৃতীয়াংশ। বর্তমান সময়ে সেখানে পৌনে চার কোটি টন হতে চার কোটি টন চাল উৎপাদন হচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) হিসাব অনুযায়ী খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ দশম এবং শুধু চাল উৎপাদনে চতুর্থ। যে বাংলাদেশ শুরুতে আগে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে খাওয়াতে অক্ষম ছিল সেখানে বর্তমানে ষোল কোটি মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদন করছে এবং ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে কোন কোন বছর খাদ্য উদ্বৃত্তও থাকে। এ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে মূলত কৃষির ক্ষেত্রে সনাতনী কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রযুক্তি নির্ভর কৃষিব্যবস্থার ফলে।

নৃবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ahraju.ru@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email