কারা খুন করলো ছাত্রলীগ নেতা শাওনকে?
প্রকাশিতঃ 8:28 pm | March 09, 2018
বিশেষ প্রতিবেদক, কালের আলো :
একটি নয়, দু’টি গুলি লেগেছিল ছাত্রলীগ নেতা আশফাক আল রাফী শাওনের পেটে। টানা ৭ দিন ছিলেন লাইফ সাপোর্টে। ১১ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে সবাইকে চোখের জলে ভাসিয়ে বিদায় নিয়েছেন চিরতরে। ঘাতকের তপ্ত বুলেটে শাওনের জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার পর একটি প্রশ্ন বড় দাগে সামনে চলে এসেছে।
কারা খুন করেছে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি আশফাক আল রাফী শাওনকে। ঘাতকদের সঙ্গে কী এমন শত্রুতা ছিল তাঁর, যে কারণে এভাবে হত্যাকান্ডের শিকার হতে হবে তাকে।
এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না কেউ। চাঞ্চল্যকর এ বিষয়টিকে নিয়ে মুখ খুলছে না পরিবার। রাজ্যের নীরবতায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। এমন বাস্তবতায় শাওনের হতভাগ্য বাবা ময়মনসিংহ জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম.এ.কুদ্দুস বলেছেন, ‘আমি সবকিছু আল্লাহ’র ওপর ছেড়ে দিয়েছি। আল্লাহই ওদের বিচার করবে।’
শুক্রবার (০৯ মার্চ) বাদ জুম্মা ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার লক্ষীপুর গ্রামে দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক গোরস্থানেই শেষ শয্যা হয়েছে ছাত্রলীগ নেতা শাওনের। নামাজে জানাজায় তাঁর হত্যাকান্ডের বিচার দাবি করেছেন দলীয় নেতা-কর্মীরা।
যদিও পুলিশ বলছে, শাওনের পরিবারের অনীহার কারণেই এ হত্যাকান্ডকে ঘিরে তাঁরা কোন পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। পরিবার সজাগ হলে কিলাররা অবশ্যই আইনের আওতায় আসবে।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দিনগত মধ্যরাতে নগরীর মৃত্যুঞ্জয় স্কুল রোড এলাকায় রহস্যজনকভাবে গুলিবিদ্ধ হন ছাত্রলীগ নেতা শাওন। পরে তাকে উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাকে রাজধানীর ইবনেসিনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার (০৮ মার্চ) দুপুরে মারা যান শাওন।
সূত্র মতে, শাওন গুলিবিদ্ধ হবার পর থেকে মরদেহ দাফনের আগ পর্যন্ত পুরো বিষয়টিই ছিল রহস্যেঘেরা। প্রথম দিকে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল নিজের বন্দুকের গুলিতেই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন শাওন। কিন্তু দিন পেরুতেই বিষয়টি ক্রমশ খোলাসা হতে শুরু করে। ঘটনার পর পরই শাওনের বন্ধু হিসেবে পরিচিত তিন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীকে পুলিশ আটক করে। একই সঙ্গে মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে নিশ্চিত হয় হত্যাকান্ডের ঘটনাস্থল।
কোতোয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহমুদুল ইসলাম দৈনিক কালের আলোকে জানিয়েছেন, শাওনের পরিবার হত্যাকান্ড নিয়ে মামলা করতে আগ্রহী নয়। একাধিকবার তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু সাড়া মেলেনি। ফলে এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আটক জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সঞ্জয় দত্ত, ছাত্রলীগ নেতা পিচ্চি আরিফ ও হিমেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়।
বৃহস্পতিবার (০৮ মার্চ) রাতে নগরীর আঞ্জুমান ঈদগাহ মাঠে শাওনের প্রথম জানাজায় নিজের বক্তব্যে বাবা, জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম.এ.কুদ্দুস বলেন, ‘হে আল্লাহ যারা শাওনের এ অবস্থা করেছে তাদেরকে তুমি জনগনের সম্মুখে ধ্বংস করে দিও।’
তাঁর এ বক্তব্যের পর পরই নগরীতে নানা কানাঘুষা শুরু হয়। শাওন যে হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন এ বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শুক্রবার (০৯ মার্চ) বাদ জুম্মা জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার লক্ষীপুর এলাকায় দাফনের আগেও একই রকম কথা বলেন শাওনের বাবা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোতোয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহমুদুল ইসলাম জানান, গত বৃহস্পতিবার (০৮ মার্চ) শাওনের বাবা জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের মাধ্যমে কোন আইনগত পদক্ষেপ নেবেন না বলে আমাদের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। ফলে ময়না তদন্ত ছাড়াই তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
ওসি জানান, শাওনের পরিবার অভিযোগ করলে এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িতদের ছাড় দেয়া হবে না। অবশ্যই তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।’
শাওন হত্যাকান্ডের বিচার দাবিতে সোচ্চার নেতা-কর্মীরা
শাওনের হত্যাকান্ডের বিচার দাবিতে সরগরম হয়ে ওঠেছে ফেসবুক। এ হত্যাকান্ডের খুনিদের বিচার দাবি করে অব্যাহত পোস্ট দিচ্ছেন ছাত্রলীগের সাবেক, বর্তমান নেতা-কর্মী ও শাওনের বন্ধুরা।
শাওনের বন্ধু জামালপুর জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সিয়াম সাদি আবেগঘন ও মর্মস্পর্শী উচ্চারণ করে লিখেছেন, ‘শাওন তোর হত্যার বিচার না হলেও হত্যা নিয়ে তুমুল রাজনীতি হবে। বড়বড় নেতারা অনর্গল বক্তব্য ঝাড়বে। অনেক বড়বড় পোদ্দার আসবে তোর কুলখানি দাওয়াতে।
কর্মীরা কয়েকশত বাইক আর প্রাইভেটকারের প্রটোকল দেবে। ছোট কর্মীরা বড় পোদ্দারদের সাথে সেলফি খিঁচবে। কোন কর্মী বেশী প্রটোকল দিতে না পাড়লে তাকে শোকজ করা হবে। তুমুল রাজনীতি হবে বন্ধু তোকে নিয়ে। তবু তোর হত্যার বিচার হবে না।’
বৈধ না অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, প্রশ্ন শান্ত’র
শাওনের খুনিদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহিত উর রহমান শান্ত দৈনিক কালের আলো’র সঙ্গে আলাপকালে এমন সব কথা বলেছেন যা হত্যাকান্ডের মোটিভ উদঘাটনে যথেষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘শাওনের পেটে দু’টি গুলি লেগেছে। নিশ্চিতভাবে এটি হত্যাকান্ড।
এ হত্যাকান্ডে বৈধ না অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে এ বিষয়টিও কেউ জানলো না। এ হত্যাকান্ড নিয়ে পুলিশের চুপিচুপি ভূমিকায় আমি মর্মাহত।
তিনি বলেন, শাওনের হত্যাকান্ডের বিচার না হলে ময়মনসিংহের ভবিষ্যত রাজনীতির জন্য এটি হবে অশনিসংকেত। ছাত্রলীগের সাবেক একজন কর্মী হিসেবে আমি শাওনের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’
শান্ত দাবি করেন, সাধারণ একজন পরিবারের সন্তানের খুন হওয়া আর একজন রাজনৈতিক নেতার সন্তানের খুন হওয়ার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। প্রভাবশালী মহলের চাপে শাওনের পরিবার নির্বিকার। পুলিশও স্বপ্রণোদিত হয়ে কোন অ্যাকশন নেয়নি। অন্যান্য হত্যাকান্ডের বেলায় থানায় মামলা না হলেও পুলিশ আসামিদের গ্রেফতার করে। এক্ষেত্রে সেটি হয়নি।
আমি আল্লাহ’র কাছে বিচার চাই
এ বিষয়ে শাওনের বাবা জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম.এ.কুদ্দুস বলেন, আমি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর কাছে বিচার চাই না। আমি আল্লাহ’র কাছে বিচার চেয়েছি।’
জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে আইনগত পদক্ষেপ না নেয়ার আবেদনের বিষয়ে তিনি বলেন, মূলত আমি পোস্টমর্টেম ছাড়াই আমার ছেলের দাফন সম্পন্ন করতে এ আবেদন করেছি।’
পুলিশের হাতে সিসি ক্যামেরা ফুটেজ নেই
অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে ময়মনসিংহ-ঢাকা মহাসড়কের ৬৫ কিলোমিটার এলাকা সিসি ক্যামেরা নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হলেও ময়মনসিংহ মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়নি। এজন্য ‘প্রদীপের নিচে অন্ধকার’।
ফলে আলোচিত শাওন হত্যাকান্ডের কোন ফুটেজ পুলিশের হাতে নেই। অথচ এখানে সিসি ক্যামেরা থাকলে শাওন হত্যাকান্ডের খুনিদের সহজেই সনাক্ত করা সম্ভব হতো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি নিবাস চন্দ্র মাঝি দৈনিক কালের আলোকে জানান, ময়মনসিংহ নগরীতে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অচিরেই সিসিক্যামেরা বসবে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে।’
কালের আলো/আরএম/এএ