নাগালের বাইরে ইলিশ
প্রকাশিতঃ 10:24 am | October 03, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:
সুস্বাদু ও জনপ্রিয় মাছ ইলিশ। দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের অন্যতম প্রাকৃতিক উৎস। আবহমান কাল থেকেই রুপালি ইলিশের উৎপাদন, চাহিদা ও জনপ্রিয়তা সবকিছুই বেশি বাংলাদেশে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় এই মাছটি একেবারেই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। বছরে একবার ইলিশের স্বাদ নিতে পারেন না এমন মানুষের সংখ্যাও অনেক।
ইলিশের দাম বাড়ার কারণ নিয়ে সম্প্রতি সমীক্ষা চালিয়েছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। এই সমীক্ষায় ইলিশের দাম বাড়ার পেছনে ১১টি কারণ সনাক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি বাণিজ্য এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠিয়েছে কমিশন। সম্প্রতি ইলিশের চড়া দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘বাজারে ইলিশের দাম কমাতে না পারাটা আমার কাছেও কষ্টের কারণ।’
জানা যায়, জেলে, মহাজন, আড়তদার, পাইকার- এসব সিন্ডিকেট ঘুরে সবশেষ যখন পাড়া-মহল্লার বাজারে পৌঁছায় তখন ইলিশের দাম হয় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। মাছের আকার যত বড় হয়, পাল্লা দিয়ে দামও তত বেশি নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে একে অপরকে দোষারোপ চলে নিত্যদিন। দাম বেশির জন্য খুচরা বাজারের বিক্রেতারা একচেটিয়া দোষ দিচ্ছেন পাইকারি বাজারের বিক্রেতাদের ওপর। পাইকারি বিক্রেতারা নিজেদের কাঁধে দায় নিতে নারাজ। তারা ঘাটেই দাম বেশিকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করান।
সরেজমিনে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এই বছরের আগস্ট মাসে দেড় কেজি বা তারও বেশি ওজনের ইলিশের প্রতি কেজির মূল্য ছিল ২ হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার টাকা। এক কেজি থেকে দেড় কেজি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশের গড় দাম ছিল ২ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকা। আর ৭৫০ গ্রাম থেকে এক কেজি সাইজের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৬০০ টাকা এবং আধা কেজি থেকে ৭৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি ছিল ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা।
বিটিটিসি এক প্রতিবেদনে ইলিশের দাম বাড়ার জন্য ১১টি কারণ চিহ্নিত করেছে। কারণসমূহ হচ্ছে- চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যহীনতা; অবৈধ মজুত ও মুনাফাখোর সিন্ডিকেট; জ্বালানি তেল ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি; মাছ ধরার খরচ বৃদ্ধি; নদীর নাব্য সংকট ও পরিবেশগত সমস্যা; অবৈধ জালের ব্যবহার; দাদন প্রথার প্রচলন; বিকল্প কর্মসংস্থান; নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরা; মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও রপ্তানির চাপ।
ইলিশ মাছের বাড়তি দামের অন্যতম কারণ অতিরিক্ত ‘রপ্তানি’ ও ‘সিন্ডিকেট’, এমনটিই বলছেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি নদীর পানি দূষণ, নাব্যতার সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসছে বলে জানান তারা। কয়েকজন ব্যবসায়ী দাবি করেন, এখন আর আগের মতো ইলিশ পাওয়া যায় না। ইলিশের উৎপাদন কম হচ্ছে। এ কারণে বাজারে ইলিশের প্রাপ্যতাও কমে যাচ্ছে। এতে করে পাইকারি বাজারেই দাম চড়া থাকছে।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করেছে, গত বছরের আগস্টে দেড় কেজি বা তারও বেশি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশের দাম ছিল ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা। এক থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৬০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায়। ৭৫০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশের কেজি ছিল ১ হাজার ১০০ টাকা থেকে ১ হাজার ১৫০ টাকা, ৫০০ থেকে ৭৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি ছিল ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় বাজারে আকৃতি ভেদে ৩ হাজার টাকা কেজি দরে ইলিশ বিক্রি হলেও এ বছর ভারতে প্রতি কেজি ইলিশের রপ্তানি মূল্য ১ হাজার ৫৩৩ টাকা।
ট্যারিফ কমিশন প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশও করেছে। সরবরাহ চেইনের ধাপ কমানোর জন্য একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি, ন্যায্য দামে ইলিশ বিক্রি নিশ্চিত করতে প্রধান শহরগুলোতে সরকারি উদ্যোগে ইলিশের বিশেষ বিপণন কেন্দ্র স্থাপন, কোল্ডস্টোরেজ তৈরি, আড়তদার ও পাইকারদের বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স, সরবরাহ ব্যবস্থার ধাপ অনুযায়ী যৌক্তিক মুনাফা বেঁধে দেওয়ার পাশাপাশি দাদন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কমাতে সহজ শর্তে জামানতবিহীন ঋণ দিতে জোর দিয়েছে তাঁরা।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ যেন সাশ্রয়ী দামে ইলিশ খেতে পারে, সে জন্য আমরা গবেষণা চালাচ্ছি। আসল সমস্যাটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।’
কালের আলো/জেএন/এমএসআইপি