ছবি যেন শুধু ছবি নয়
প্রকাশিতঃ 12:19 pm | August 21, 2025

মোস্তফা কামাল:
নির্বাচিত-অনির্বাচিত, মনোনীত-আরোপিত যে কোনো রাষ্ট্রপতিকে সরানোর বহু ব্যবস্থাই আছে। কেবল চেয়ার থেকে নয়, দুনিয়া থেকেও আল বিদা করা যায়। এর কিছু কিছুর দৃষ্টান্ত রয়েছে আমাদের এ বাংলায়ও। দৃষ্টান্ত হিসেবে নতুনত্ব যোগ হয়েছে ছবি সরানো নিয়ে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি মিশন, দূতাবাস ও কনস্যুলেট অফিস থেকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ছবি সরানোর নির্দেশনা দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নির্দেশনা মতো বহু দেশের বাংলাদেশি দূতাবাস থেকে রাষ্ট্রপতির ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে, তা ছিল বেখবরে। এ সংক্রান্ত নির্দেশও কাগজে নয়, ফোনে ফোনে। এক আচানক নজির। তাও আবার কেন বা কি কারণে রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর এই নির্দেশনা, তাও অস্পষ্ট।
অনিয়মকে নিয়ম করার সংস্কৃতিতে বরাবরই আমাদের ভিন্নমাত্রার চর্চা রয়েছে। রাষ্ট্রপতির ছবি তুলতেও আমাদের নিয়ম লাগে না। নামাতেও লাগে না। বিগত সরকার আমলে আইন করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি টাঙানোর। রাষ্ট্রপতির ছবি রাখার কোনো আইন ছিল না। তারপরও বহু অফিসে সেটা টাঙানো হয়েছে। তা কোন আইনে বা কার নির্দেশে-এ প্রশ্ন কেউ তোলেওনি। মোটকথা চলেছে একটা লুকোচুরি।
বাংলাদেশের সংবিধানের চার অনুচ্ছেদে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রধান ও শাখা কার্যালয়, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনসমূহে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ব্যবহারের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর বাইরে সরকারপ্রধানের ছবি ব্যবহার করা নিয়ে কোনো আইন, বিধি বা সাংবিধানিক নির্দেশনা শেখ হাসিনার শাসনামলে হয়নি।
একজন রাষ্ট্রপতি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, জানাজা, কখনো কখনো পুকুরে মাছের পোনা অবমুক্ত করা আর মাঝেমধ্যে গাছের চারা রোপণ ও এর গোড়ায় একটু পানি ঢালার ফটোসেশন করা ছাড়া রাষ্ট্রপতির আর তেমন কোনো কার্যকর কাজ থাকলো না। এ বাস্তবতায় কারও কারও আরও খেদোক্তি ছিল, ‘আলংকারিক’ এ পদটি রাখারই বা কী দরকার? বছরে কোটি কোটি টাকা খরচ হয় এই পদের পেছনে। জনগণের টাকায় রাজার হালে খেয়ে-পরে জনগণের জন্য কী করেন এই পদে থাকা মহামান্যরা।
তবে, ২০০২ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রীদের কার্যালয়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাস ও সব স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিকৃতি কিংবা ছবি টাঙানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই নির্দেশ মোতাবেক সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও পরবর্তীতে শেখ হাসিনার ছবি ব্যবহার হয়ে আসছিল।
৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর অবশ্য সরকারপ্রধান হিসেবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এ ধরনের কোনো নির্দেশনা দেননি। এটির কোনো প্রাসঙ্গিকতাও ছিল না। এখন ফোনাদেশে রাষ্ট্রপতির ছবি নামানোর হিড়িকের মাঝে জোর গুঞ্জন, রাষ্ট্রপতিকেও কী সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে? শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবিতে বিভিন্ন ব্যানারে বিক্ষোভ হলেও সাংবিধানিক সংকটের আশঙ্কা থেকে অধ্যাপক ইউনূসের সরকার সে পথে হাঁটেনি। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিভিন্ন জায়গায় সরকারি দপ্তর বা আদালত থেকে শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামিয়ে ফেলা হয়। এ সংক্রান্ত কোনো নির্দেশ লাগেনি।
আসলে গোটা বিষয়টির মধ্যেই এক অস্পষ্টতা। কার ছবি কোথায় টানাতে হবে সেই নির্দেশ কেবিনেট থেকে ইস্যু করা হয়। সরকার যে কোনো সময় যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। কিন্তু এবার কেবিনেট বা কোনো দফতর থেকে সেরকম নির্দেশনা আসেনি। ফোনে বা মৌখিকভাবে হঠাৎ এই নির্দেশনা কেন দেওয়া হলো, কোথাও থেকে জবাব নেই। দৃষ্টান্ত হিসেবে এটি একদম নতুন। কিন্তু কোনো ধরনের নির্দেশনা না থাকার পরও রাষ্ট্রপতির ছবি বিভিন্ন দূতাবাস কার্যালয়ে কেন ব্যবহার করা হয়-এর যুক্তিও নেই। তারপরও ধারণা করা হয়, প্রত্যেকটা দেশে রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার যারা থাকেন, সেখানে তাদের দেশের রাষ্ট্র প্রধানের ছবি থাকে, এটা একটা কাস্টম। এবং এটা দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। এবং সেই হিসেবেই হয়তো রাষ্ট্রপতির ছবি ছিল।
এটাকে আইনি বা বেআইনি দুইটার কোনোটাই বলা যায় না। এখন সরকার যদি নির্দেশনা দেয় তাহলে নামিয়ে ফেলা আইন না হলেও বিধানের মতো। আইনি কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকার পরও দূতাবাস ও বিদেশে বাংলাদেশি মিশনে রাষ্ট্রপতির ছবি থাকলে সেটি সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের আনুষ্ঠানিক ও লিখিত সিদ্ধান্তে সরিয়ে ফেলা যেতো। সেটা না করে গোপনে ফোনে ফোনে এ ধরনের কাজ সাঙ্গ করা হলো।
মানুষের মুখ কিন্তু আটকে রাখা যায় না। অনেকে না বললেও কেউ না কেউ বলার কাজ সারিয়ে ফেলেন। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া কারও শাসন বারণ মানে না। তাদের কোনো সীমানাও নেই, যা ইচ্ছা বলা হচ্ছে। ছড়ানো হচ্ছে। তা মহামান্য নিয়েও। মান্য না করলে যে এ মহামান্য কিছুই নয়, তা ছবির এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আরেকবার প্রমাণ হলো। রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতি অবসানের পর সংসদীয় পদ্ধতিতে আসার পর একজন রাষ্ট্রপতি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, জানাজা, কখনো কখনো পুকুরে মাছের পোনা অবমুক্ত করা আর মাঝেমধ্যে গাছের চারা রোপণ ও এর গোড়ায় একটু পানি ঢালার ফটোসেশন করা ছাড়া রাষ্ট্রপতির আর তেমন কোনো কার্যকর কাজ থাকলো না। এ বাস্তবতায় কারও কারও আরও খেদোক্তি ছিল, ‘আলংকারিক’ এ পদটি রাখারই বা কী দরকার? বছরে কোটি কোটি টাকা খরচ হয় এই পদের পেছনে। জনগণের টাকায় রাজার হালে খেয়ে-পরে জনগণের জন্য কী করেন এই পদে থাকা মহামান্যরা।
এ টাইপের কথার বিপরীতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে কিছুটা ভারসাম্য আনার হেদায়েতি কথাবার্তাও হয়েছে। বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে একটু সাহসী-দাপটী মনে করা হতো। তার প্রোফাইল, বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি হয়েও দলীয় রাজনীতিতে তিনি একটু দাপুটেই ছিলেন। আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে তিনি বেশ শক্ত। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মাস কয়েক আগে নিজ এলাকা পাবনায় একদিন এক সমাবেশে তিনি বক্তৃতা শুরু করলে একটু ঝড়-বৃষ্টি নামে। তাকে তা মনে করিয়ে দিলে তিনি একটু চটে যান। বলে ওঠেন, আরে কীসের ঝড়। ঝড় তো তুলবো আমি।
বাস্তবে ঝড় তোলার আশপাশেও দেখা যায়নি তাকে। গত বছর জুলাই আন্দোলনের সময় মহামান্য বা রাষ্ট্রীয় মুরুব্বি হিসেবে তিনি দুটি উচিত কথাও বললেন না। রাষ্ট্রের হাজার হাজার মানুষকে যখন মেরে ফেলা হচ্ছে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গহীন করে ফেলা হচ্ছে, তখন দু-এ্কটা পরামর্শমূলক কথাও বললেন না। তার ওপর গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের বছর পূর্তিতে বিবৃতিতে বললেন, দেশ থেকে সমূলে ফ্যাসিস্ট বিনাস করতে হবে। তিনি বঙ্গভবনে যথারীতি আছেন। একবছর ধরে রাষ্ট্রে এত ‘সংস্কার’ হচ্ছে, সেখানে রাষ্ট্রপতির বিন্দুমাত্র কোনো ভূমিকা নেই। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনার শোরগোলের মাঝেও তা কোনো শব্দ নেই। এ নিশব্দতার মাঝেই বলা নেই, কওয়া নেই, তার ছবি নামানোর কাণ্ড।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের টানা আলোচিত বিষয়ের মাঝে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মতামতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলেছে। ঐকমত্য কমিশন মনে করে, রাষ্ট্রপতির পদটি ‘আলংকারিক’ না রেখে ‘ক্ষমতাশালী’ হওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদধারীদের নিয়োগ রাষ্ট্রপতির সরাসরি সিদ্ধান্তে হওয়া প্রয়োজন। ঐকমত্য কমিশন প্রস্তাব করেছে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান, এনএসআই প্রধান, ডিজিএফআই প্রধান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ ১২টি পদে নিয়োগে রাষ্ট্রপতির সরাসরি এখতিয়ার থাকা দরকার। ঐকমত্য কমিশনে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায়নের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে মূলত প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’র মধ্যে নিয়ে আসার অভিপ্রায় থেকে। কিন্তু, বাস্তবে এ কোন অভিপ্রায়ের প্রতিফলন?
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।