ডেঙ্গুর চিকিৎসায় পর্যাপ্ত বিশ্রাম-তরল খাবারের সঙ্গে প্যারাসিটামলই যথেষ্ট

প্রকাশিতঃ 3:40 pm | June 24, 2025

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, কালের আলো:

ডেঙ্গুর চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যথানাশক, স্টেরয়েড ও ঘরোয়া প্রতিকার ব্যবহারের পরিবর্তে পর্যাপ্ত বিশ্রাম, তরল খাবার গ্রহণ এবং প্যারাসিটামল ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা।

মঙ্গলবার (২৪ জুন) বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে (বিএমইউ) অনুষ্ঠিত কনটিনিউইং মেডিকেল এডুকেশন (সিএমই) অনুষ্ঠানে ‘ডেঙ্গু গাইডলাইন ২০২৫ : হোয়াট হ্যাজ চেঞ্জড’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল হাসান।

তিনি বলেন, ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ, তাই এতে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন নেই, যদি না রোগীর দেহে নিশ্চিত ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ দেখা যায়, যেমন নিউমোনিয়া।

প্রবন্ধ নিয়ে ডা. মো. নাজমুল হাসান বলেন, ডেঙ্গু জ্বরের হালকা উপসর্গ যেমন ৩ থেকে ৫ দিনের জ্বর, মাথাব্যথা, গায়ে ব্যথা থাকলে রোগীকে হাসপাতালে না নিয়ে বাড়িতে বিশ্রাম ও পর্যাপ্ত তরল পানীয় (স্যালাইন, ফলের রস, স্যুপ) গ্রহণ করতে হবে। জ্বর কমাতে শুধুমাত্র প্যারাসিটামল ব্যবহার করা যাবে, যার দৈনিক সর্বোচ্চ মাত্রা ৩ গ্রাম। অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন এবং অন্যান্য ব্যথানাশক জাতীয় ওষুধ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ, কারণ এসব ওষুধ রক্তপাতের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

সতর্ক করে তিনি বলেন, স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ যেমন ডেক্সামেথাসন ও হাইড্রোকরটিসন ডেঙ্গু রোগীর জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। এসব ওষুধ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে এবং ফুসফুসে পানি জমার ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব ওষুধ ডেঙ্গু চিকিৎসায় কার্যকর নয়, বরং কিছু ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতা তৈরি করতে পারে। তবে অল্প কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষজ্ঞের পরামর্শে এবং নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে স্টেরয়েড ব্যবহার করা যেতে পারে।

তিনি বলেন, রোগী যদি জ্বর কমে যাওয়ার পর হঠাৎ শরীর খারাপ বোধ করে, বারবার বমি হয়, পেটে তীব্র ব্যথা দেখা দেয়, রক্তপাত শুরু হয়, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, অজ্ঞান হওয়া, মাথা ঘোরা বা চামড়া মলিন হয়ে আসে—তবে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে এসব উপসর্গ দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসা নিতে হবে।

নাজমুল হাসান বলেন, বর্তমানে দেশে অনেকেই ডেঙ্গু রোগীদের প্লাটিলেট বাড়ানোর ঘরোয়া পদ্ধতি হিসেবে পেঁপে পাতার রস ব্যবহার করছেন। কিন্তু এ বিষয়ে সতর্ক করে বলা হয়, এই ধারণার পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। পেঁপে পাতার রস অতিরিক্ত বা ভুল মাত্রায় গ্রহণ করলে বমি, পেটব্যথা এমনকি লিভারের সমস্যাও সৃষ্টি হতে পারে। এটি ডেঙ্গু চিকিৎসার কোনো বিকল্প নয়। প্লাটিলেট বাড়াতে পেঁপে পাতার ওপর নির্ভর না করে বিশ্রাম, তরল খাবার ও চিকিৎসকের পরামর্শমাফিক ব্যবস্থা গ্রহণ করাই সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি।

প্লাটিলেট প্রসঙ্গে বলেন, একজন ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন কেবল তখনই প্রয়োজন হয় যখন রোগীর প্লাটিলেট সংখ্যা ১০ হাজারের নিচে নামে, রক্তপাত দেখা দেয় অথবা কোনো অপারেশন বা ইনভেসিভ প্রসিডিউরের প্রয়োজন পড়ে। শুধুমাত্র প্লাটিলেট কম থাকার কারণে রক্ত দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিপজ্জনক হতে পারে। হিমোগ্লোবিন খুব কমে গেলে বা রক্তপাতজনিত শক দেখা দিলে সম্পূর্ণ রক্ত বা রেড ব্লাড সেল ট্রান্সফিউশন বিবেচনা করা যেতে পারে।

অনুষ্ঠানে আরও বলা হয়, দেশের প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নার ও ফিভার ক্লিনিক চালু করা উচিত। এসব ক্লিনিকে আইভি ফ্লুইড, রক্ত, রক্তের উপাদান এবং জরুরি চিকিৎসার সরঞ্জাম নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে চিকিৎসক ও নার্সদের ডেঙ্গু শনাক্তকরণ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

অন্যান্য বক্তারা বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। এজন্য বাড়ির ভেতরে ও বাইরে জমে থাকা পানি পরিষ্কার রাখা, জলাধার ঢেকে রাখা এবং সপ্তাহে অন্তত একবার পানি ফেলে ব্লিচিং করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে কমিউনিটি পর্যায়ে স্প্রে অভিযান ও প্রচারণা জোরদার করতে হবে। অনুষ্ঠানে স্পষ্ট করে বলা হয়, ডেঙ্গু একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। কিন্তু ভুল চিকিৎসা, অপপ্রচার ও গুজবের কারণে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। সরকারি চিকিৎসা নির্দেশনা ও স্বীকৃত চিকিৎসা ব্যবস্থা অনুসরণ করলে ডেঙ্গুর ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম। সভাপতিত্ব করেন উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ও ইন্টারন্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. মুজিবুর রহমান হাওলাদারসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, শিক্ষক, চিকিৎসক, রেডিডেন্টরা।

কালের আলো/এমডিএইচ