সুনীল অর্থনীতির বিকাশে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার; আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ‘নন্দিত’ নৌবাহিনীর হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভিসের সেবা

প্রকাশিতঃ 11:32 pm | June 21, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

বিস্তীর্ণ সমুদ্র অঞ্চলের সম্পদের সুরক্ষা এবং সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্রমধারা আরও গতিশীল রাখতে হাইড্রোগ্রাফিক কর্মকাণ্ডের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। একই সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে সমুদ্র সচেতনতা বাড়াতে ও সুনীল অর্থনীতির বিকাশকে বেগবান করতে সমুদ্রভিত্তিক কার্যক্রমসমূহের টেকসই উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে ‘বিশ্ব হাইড্রোগ্রাফি দিবস’।

আন্তর্জাতিক হাইড্রোগ্রাফিক সংস্থা (আইএইচও) প্রতিষ্ঠার দিনকে স্মরণীয় করে রাখার প্রয়াসে এবং বিশ্বব্যাপী হাইড্রোগ্রাফি পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের অসামান্য অবদানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার লক্ষ্যে ‘সামুদ্রিক কার্যক্রমে নিরাপত্তা, দক্ষতা ও টেকসই উন্নয়নে হাইড্রোগ্রাফিক তথ্যের গুরুত্ব’ এই স্লোগান নিয়ে এবারও বাংলাদেশে পালিত হয়েছে ‘বিশ্ব হাইড্রোগ্রাফি দিবস’। শনিবার (২১ জুন) বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় ঢাকায় সামরিক জাদুঘর মাল্টিপারপাস হলে দিবসটিকে ঘিরে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমুদ্রে দেশি-বিদেশি জাহাজসমূহের নিরাপদ চলাচল, সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই আহরণ ও কার্যকরী ব্যবহারে হাইড্রোগ্রাফিক তথ্য-উপাত্ত মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে বলে মত দেওয়া হয়।

সেমিনারে প্রধান অতিথি নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন ও বিশেষ অতিথি নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান হাইড্রোগ্রাফি সংক্রান্ত উদ্ভাবনী প্রযুক্তি এবং তথ্য-উপাত্তের প্রায়োগিক ব্যবহারের মাধ্যমে সমুদ্র সম্পদের নিরাপদ, টেকসই ও কার্যকরী ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সমুদ্র বিজ্ঞানী, সমুদ্র ব্যবহারকারী সংস্থা ও দেশসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে বলেও মনে করেন তাঁরা।

‘বিশ্ব হাইড্রোগ্রাফি দিবস’ উপলক্ষ্যে চলতি বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়- ‘সী-বেড ম্যাপিং : এনাবলিং ওশেন অ্যাকশন’ যা একটি সমৃদ্ধ সামুদ্রিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে হাইড্রোগ্রাফির উল্লেখযোগ্য ভূমিকাকে নির্দেশ করে।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইড্রোগ্রাফিক কমিটির সদস্য, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও মেরিটাইম সংস্থার সদস্য ও গবেষকদের স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণে সেমিনারটিতে সমুদ্র ব্যবস্থাপনা এবং ব্লু ইকোনোমির নিমিত্তে পরিকল্পনা প্রণয়ন, সমুদ্রতলের পরিবর্তন, অফ-শোর অ্যাকুয়াকালচার এবং মৎস্য উৎপাদনশীলতা, সামুদ্রিক জিনগত সম্পদ বৃদ্ধি এবং সমন্বিত মহাসাগর পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে সমুদ্রতলের মানচিত্রায়ণ ইত্যাদি বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। বক্তারা আলোচনার মাধ্যমে দিবসটির প্রতিপাদ্য ও গুরুত্ব তুলে ধরেন। হাইড্রোগ্রাফিক তথ্য-উপাত্তের প্রায়োগিক ব্যবহারের মাধ্যমে সমুদ্র সম্পদের নিরাপদ, টেকসই ও কার্যকর উপযোগিতার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করা হয়।

আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, হাইড্রোগ্রাফিক তথ্য-উপাত্তের প্রায়োগিক ব্যবহারের মাধ্যমে সমুদ্র সম্পদের নিরাপদ, টেকসই ও কার্যকর উপযোগিতার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করা হয়। এছাড়াও, বিভিন্ন মেরিটাইম সংস্থাসমূহের অংশগ্রহণে হাইড্রোগ্রাফিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সমুদ্র বিজ্ঞানী, সমুদ্র ব্যবহারকারী সংস্থা ও দেশসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে জ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয় সাধন হবে বলে আশা করা যায়।

আইএসপিআর আরও জানায়, ২০০১ সালে বাংলাদেশ  আন্তর্জাতিক হাইড্রোগ্রাফিক সংস্থার ৭০তম দেশ হিসেবে সদস্যপদ লাভ করে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী আন্তর্জাতিক হাইড্রোগ্রাফিক সংস্থার দেশীয় প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৮৩ সাল হতে সমুদ্র ও সমুদ্র বন্দর সংলগ্ন নদীপথে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ পরিচালনা এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নটিক্যাল চার্ট প্রকাশের দায়িত্ব পালন করে আসছে। কাগজে মুদ্রণের পাশাপাশি এ সকল চার্ট ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতেও প্রকাশিত হচ্ছে, যা বঙ্গোপসাগরে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার জাহাজসমূহের নিরাপদ চলাচলে অপরিহার্য। হাইড্রোগ্রাফিক তথ্য-উপাত্ত সামুদ্রিক পরিবেশ সুরক্ষা ও ব্যবস্থাপনা, মৎস্য ও খনিজ সম্পদ আহরণ, সুনামি, উপকূলীয় ভূমি ব্যবস্থাপনা, সমুদ্র সীমানা নির্ধারণ ও সমুদ্র বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণায় অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে। এ সকল তথ্য-উপাত্ত অদূর ভবিষ্যতে মেরিন স্পেশাল ডাটা ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রস্তুতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে। হাইড্রোগ্রাফি সংক্রান্ত উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ও ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ এবং অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রসমূহ সমুদ্র অঞ্চলকে আরও নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর ও উৎপাদনশীল ভূমিকায় উন্নীত করতে সক্ষম হবে।

হাইড্রোগ্রাফিক ছাড়া ব্লু ইকোনমি বাস্তবায়ন সম্ভব নয় : নৌ উপদেষ্টা

নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেছেন, হাইড্রোগ্রাফি বিভাগ শুধু সামরিক ও নৌ-নিরাপত্তা নয়, বরং সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন, মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ, তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান এবং উপকূলীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

উপদেষ্টা হাইড্রোগ্রাফিক তথ্যকে ‘সমুদ্র সম্পদ ব্যবহারের রূপরেখা’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, বিশদ, হালনাগাদ ও নির্ভুল হাইড্রোগ্রাফিক তথ্যের কোনো বিকল্প নেই। এটা না থাকলে ব্লু ইকোনমি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। নৌ পরিবহন উপদেষ্টা বলেন, সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের অভাবের কারণে দেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক সময় পিছিয়ে পড়ছে।

তিনি বলেন, শুধু আজ নয়, শুরু থেকেই দেখা গেছে, মন্ত্রণালয়গুলো একে অন্যের সঙ্গে সমন্বয় না করে নিজেদের মতো কাজ করে যাচ্ছে। কেউ রাস্তা মেরামত করে, কিছুদিন পরই আরেক সংস্থা এসে তা কেটে ফেলে। এতে জনদুর্ভোগ বাড়ে, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় হয়।

সমুদ্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নৌবাহিনীর অগ্রণী ভূমিকা 

অনুষ্ঠানে নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান বলেন, বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় যে কোন ধরনের আগ্রাসন প্রতিরোধ, সামুদ্রিক স্বার্থ রক্ষা, সমুদ্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী নিয়মিতভাবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। পাশাপাশি সমুদ্রে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ পরিচালনা এবং ওশানোগ্রাফিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের দায়িত্ব বাংলাদেশ নৌবাহিনীর উপর অর্পণ করা হয়েছে। পরিবেশগত সুরক্ষা, বন্দরসহ উপকূলীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সামুদ্রিক দূষণ প্রতিরোধে হাইড্রোগ্রাফির ভূমিকা অপরিহার্য। এছাড়া, সুনীল অর্থনীতির প্রসার ও অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে আমাদের সাগর ও সমুদ্রতলের সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাইড্রোগ্রাফি বিভাগ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিগত ১৯৮৩ সালে সীমিত পরিসরে হাইড্রোফিক স্কুল এবং চার্ট ডিপো প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাইড্রোগ্রাফি বিভাগের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, আজ তা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে। আমাদের হাইড্রোগ্রাফি বিভাগ আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবল দ্বারা সমুদ্রে সকল ধরনের জাহাজের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি নিয়মিতভাবে জরিপ কার্য পরিচালনা এবং তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইলেকট্রনিক নটিক্যাল চার্ট প্রস্তুত ও বিতরণ করছে যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসা অর্জন করেছে। এছাড়াও প্রতিবেশী দেশসমূহের সাথে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন ও নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাইড্রোগ্রাফি বিভাগ প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছে, যা নৌবাহিনী তথা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সম্মান এবং গৌরব বয়ে এনেছে।

কালের আলো/এমএএএমকে