বঙ্গবন্ধুকে মনে করে কাঁদলেন মাহবুব তালুকদার

প্রকাশিতঃ 4:44 pm | March 26, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে নিজের কাজ করার স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে কেঁদেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এসময় তৎকালীন বঙ্গবন্ধুর সাথে কাটানো সময়ের কথা বলতে গিয়ে স্মৃতি-কাতর হয়ে যান তিনি।

মঙ্গলবার (২৬ মার্চ) নির্বাচন ভবনের মিলনায়তনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) উদ্যোগে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় মাহবুব তালুকদারের বক্তব্য দেয়ার সময় এমনই দৃশ্যের অবতারণা হয়।

মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘আজ আমার কার কথা মনে পড়ছে আপনারা জানেন? আমার মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর কথা। আমার পরম সৌভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সরকারিভাবে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। অনেক স্মৃতি। আজ মাত্র দু’টি বলবো।’

‘১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই দিনই তিনি আমায় ডেকে বলেন-মাহবুব তুমি আমার সঙ্গে থাকবা। আমাকে রাষ্ট্রপতির সহকারী প্রেস সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়। পদবি বড় কথা নয়, দায়িত্ব অর্পিত হওয়ার পর স্বভাবতই আমি খুব খুশি হই।’

স্মৃতি-কাতর মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘আমার দায়িত্ব পড়ে, বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর ডিকটেশন নেওয়ার। সিদ্ধান্ত হয়-দুপুরে খাওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর বিশ্রামের সময়টুকুতে আমি তার রুমে ঢুকে যাবো। তিনি আমাকে বলেন-যদি কোনো অজুহাতে ডিকটেশন দেয়ার জন্য তিনি সময় না দিতে পারেন, তাহলে আমি যেন জোর করে ডিকটেশন নিই।’

তিনি বলেন, ‘সেই মতে, আমি পরপর তিনদিন বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর ডিকটেশন নিই। তাঁর ডিকটেশন রেকর্ডও করি। চতুর্থ দিন এসে বঙ্গবন্ধু বেঁকে বসেন। বলেন, তোমার জন্য তো আমি বিশ্রামটুকুও নিতে পারছি না। আমি তাঁকে বলি-আইয়ুবের শাসন, আপনার ছয় দফা, পাকিস্তানের জেলে বন্দির দিনগুলো, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা-এ রকম গুরুত্বপূর্ণ সব অধ্যায়ের বিষয়গুলো নিয়ে তো আপনাকে ডিকটেশন দিতে হবে। আপনার বিশ্রামের সময় আপনাকে বিরক্ত করা আমারও ভালো লাগে না। তাই আপনি আমাকে অন্য একটা সময় বের করে দিন।’

ইসি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বলেন- আমি সমস্ত কাজ গুছিয়ে আনছি, পরিবারের (সদস্য) বিয়ে শাদি শেষ করছি। সামনেই ডিকটেশন নেয়ার সময় বের করে দেবো। কোনো কিছুই আটকে থাকবে না। এরপরই ঘটে সেই ঘৃণ্য আগস্ট,’ বলেন এই নির্বাচন কমিশনার।

মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘দ্বিতীয় ঘটনাটি ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসের। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লূৎফর রহমান যেদিন মারা যান, সেদিন আমি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সারাদিন ছিলাম। চল্লিশার দিনে ঠিক হয়, বঙ্গবন্ধু টুঙ্গীপাড়ায় যাবেন। সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ, তিন বাহিনীর প্রধান ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা থাকবেন।’

‘গাজী জাহাজে টুঙ্গীপাড়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয়। আমার জাহাজ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা না থাকায়, কাপড়-চোপড় সঙ্গে নেয়ার কথা মনে হয়নি। রাতে জাহাজ ছাড়লে দেখি, আমার শোবার কোনো জায়গা নাই। একপাশে একটি খালি সোফা পেয়ে শুয়ে পাড়ি। পাশেই তখনকার এডিসি রাব্বানী সাহেব ছিলেন। মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। দেখি, রাব্বানী জেগে আছেন। আমার মাথার নিচে বালিশ। আমি অবাক হয়ে রাব্বানীকে জিজ্ঞেস করি-এই বালিশ আমার মাথার নিচে কে দিলেন? রাব্বানী বলেন-রাতে বঙ্গবন্ধু রাউন্ডে এসেছিলেন। তিনি দেখেন- আপনি মাথার নিচে হাত দিয়ে সোফায় শুয়ে আছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর রুমে গিয়ে বালিশ নিয়ে এসে আপনার মাথার নিচে রেখে গেছেন।’

এই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন মাহবুব তালুকদার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলতে থাকেন-‘আমি জানতাম বঙ্গবন্ধুর দু’টি বালিশ ছাড়া ঘুম হয় না। তখন আমি বালিশ ফিরিয়ে দিতে বঙ্গবন্ধুর রুমের দিকে যাওয়ার কথা বলি। কিন্তু রাব্বানী জানান, গিয়ে লাভ নেই। বঙ্গবন্ধু দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছেন।’

‘‘ভোর পাঁচটা। জাহাজ চলছে। সুনশান নীরবতা চারদিকে। জাহাজের সামনের দিকে এগিয়ে দেখি, একটি ইজি চেয়ারে বসে বঙ্গবন্ধু কবিতা আবৃত্তি করছেন। ‘নমো নমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি/গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ-সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।’ আর কবিতা আবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে তিনি পা দুলাচ্ছেন,’ বলতে থাকেন মি. তালুকদার।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণের এ পর্যায়ে পুরো মিলনায়তনে যেন নীরবতা ছড়িয়ে পড়ে। তবে বক্তৃদা চালিয়ে যাচ্ছেন জাতির পিতার সান্নিধ্য পাওয়া তৎকালীন তরুণ অফিসার মাহবুব তালুকদার।

তিনি বলতে থাকেন-‘আবৃত্তি শেষে বঙ্গবন্ধু আমাকে খেয়াল করেন। বলেন- মাহবুব, রাতে ভালো ‍ঘুম হয়েছে তো? আমি বললাম-না। কেন? আমি তো তোমার মাথার নিচে বালিশ দিয়ে আসলাম। উত্তরে বঙ্গবন্ধুকে বলি, আপনি আমার মাথার নিচে বালিশ দিয়ে এলেন। আপনিই বলুন, আপনি কারো মাথার নিচে বালিশ দিয়ে এলে তার পক্ষে কি আর ঘুমনো সম্ভব!’

এরপর আর কোনো কথা বলতে পারছিলেন না মাহবুব তালুকদার। অস্পষ্ট স্বরে কেবল সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে নিজের আসনের দিকে চলে যান এই অভিজ্ঞ কর্মকর্তা। মাঝে বক্তব্য দেয়ার সময় অশ্রুসজল চোখ মুছতেও দেখা যায় তাকে। অন্যদের চোখেও তখন চিকচিক করছিল জলে।

অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ( সিইসি) কেএম নূরুল হুদাসহ অন্য নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশন সচিবসহ সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

কালের আলো/এমএইচএ