তামিমের বর্ণনায় ক্রাইস্টচার্চের সেই ভয়াবহ ঘটনা

প্রকাশিতঃ 6:58 pm | March 17, 2019

স্পোর্টস ডেস্ক, কালের আলো:

আর একটু হলেই সর্বনাশ হতে পারতো। মৃত্যুর সামনে থেকে কোনো মতে বেঁচে ফিরেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। সেদিন নিউজিল্যান্ডের আল নূর মসজিদে যাওয়া দলের সঙ্গে ছিলেন তামিম ইকবাল। দেশে ফিরে ক্রিকেটের জনপ্রিয় মাধ্যম ক্রিকইনফোকে মৃত্যুকে কাছে থেকে দেখা সেই ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন দেশসেরা এই ওপেনার। তামিমের চোখে দেখা ক্রাইস্টচার্চের সেই ঘটনা বিবরণ নিচে তুলে ধরা হলো।
বাসে উঠার আগে কী হয়েছিল, সেটাই আগে বলি, তাহলে বুঝতে পারবেন, মাত্র দুই-তিন মিনিট সময় কীভাবে আমাদের জীবন-মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য তৈরি করেছিল।

জুমার নামাজে মুশফিক ও রিয়াদ ভাই খুতবার সময় মসজিদে হাজির হতে চান। সেজন্য আমরা ওইদিন আগেই নামাজে যেতে চেয়েছিলাম। দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে মাঠ থেকে আমাদের বাস ছাড়ার কথা ছিল। কিন্তু রিয়াদ ভাই ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে যান। সেখানে কিছুটা সময় দেরি করে ফেলেন। সংবাদ সম্মেলন শেষ করে রিয়াদ ভাই ড্রেসিং রুমে ফেরেন।

ড্রেসিং রুমে আমরা সবাই হালকা চালে ফুটবল খেলায় ব্যস্ত ছিলাম। সেই খেলায় তাইজুল হারতে চাইছিল না। কিন্তু বাকি সবাই তাকে খেলায় হারানোর জন্য উঠে পড়ে লাগে। তাইজুল ও মুশফিক ওয়ান টু ওয়ান খেলছিল। আমরা সবাই সেটা দেখছিলাম। সেখানে আমাদের আরও কিছুটা সময় দেরি হয়ে যায়। এই সামান্য দেরিটাই যে আমাদের জীবন বাঁচিয়ে দিল!

ফুটবল খেলা শেষ করে আমরা বাসে উঠে বসলাম। উদ্দেশ্যে ছিল- মসজিদ থেকে বেরিয়েই আমরা একই বাসে টিম হোটেলে ফিরে যাব। তাই আমাদের সঙ্গে সৌম্য সরকার ও টিম অ্যানালিস্ট শ্রীনিবাসন চন্দ্রশেখরও বাসে উঠে আসে। যেহেতু ম্যাচের আগের দিনের এই অনুশীলনটা ছিল ঐচ্ছিক অনুশীলন সেশন। তাই যাদের অনুশীলন ছিল না তারা হোটেলে থাকবে, আর যাদের অনুশীলন ছিল তারা মাঠে আসবে। এটাই ছিল পরিকল্পনা।

টিম বাসে আমি সবসময় বামদিকের ছয় নম্বর সিটে বসি। আমাদের বাস মসজিদের কাছাকাছি যেতেই বাসের সবাই ডানদিকে বাইরের তাকাতে শুরু করে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে আমিও দেখলাম একজন লোক মাটিতে পড়ে আছে। এসব ক্ষেত্রে যা হয়. প্রথমে সেই চিন্তাই আমরা করলাম, ভাবলাম হয়তো মাতাল বা অজ্ঞান হয়ে কেউ মাটিতে পড়ে আছে!

বাস আরেকটু সামনে বাড়লো। সামনেই মসজিদ চত্বর। কিন্তু তখনো সবার মনোযোগ সেই পেছনের মাটিতে পড়ে থাকা অজানা লোকের দিকেই। তখনই আমি দেখলাম সামনে আরেকজন লোক পড়ে আছে, রক্তাক্ত! উপুড় হয়ে! তখনই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শুরু!

মসজিদ চত্বরের কাছে একটি কারের সামনে এসে আমাদের বাস থামলো। দেখলাম আমাদের বাসচালক জানালার কাঁচ নামিয়ে গাড়ির পাশে থাকা এক নারীর সঙ্গে কথা বলছে। সেই নারী চরম আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় কাঁপছিল! চোখেমুখে তার ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। কথা বলছিল সে কান্নার ভঙ্গিতে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে! শুনতে পেলাম সেই নারী বলছে-‘সামনে কিছু হয়েছে, যেও না, যেও না!’

আমাদের বাস ড্রাইভার সেই নারীকে বলল,বাসের এরা সবাই মসজিদে যাবে। তখন সঙ্গে সঙ্গে সেই নারী চিৎকারের ভঙ্গিতে জানালো, ‘না, না, না, মসজিদে যেও না!! ওখানেই তো ভয়াবহ কিছু হয়েছে।’

এইটুকু বলেই সেই মহিলা কাঁদতে শুরু করলো! বাসের মধ্যে আমরা সবাই সেটা দেখলাম। ড্রাইভারের সঙ্গে তার কী কথা হচ্ছিল, সেটাও শুনলাম। তখনই আমাদের টেনশন আরো বেড়ে গেল। মসজিদ থেকে আমরা তখন মাত্র ২০ গজ দূরে দাঁড়িয়ে। এক অর্থে এতই কাছে যে, বাস থেকে নেমে মসজিদে একদম প্রবেশের মুখেই তখন আমরা!

তখনই আমরা আরো ভয়াবহ দৃশ্য দেখলাম; মসজিদের চারপাশে অনেক রক্তে ভেসে যাওয়া অনেক মানুষ পড়ে আছে। হঠাৎ করে চারধারে এত মৃত মানুষ দেখে আমরা ঠিক বুঝে উঠতেই পারছিলাম না, কী করব? কোথায় যাব? মাথায় নামাজের টুপি পরা আমাদের কয়েকজন ভয়ে আতঙ্কে মাথা থেকে টুপি খুলে ফেলে! পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, এখানে ভয়াবহ কিছু হয়েছে। যারা পাঞ্জাবি পরেছিল তারা সেই পাঞ্জাবির ওপর জ্যাকেট পরতে শুরু করে। যাতে পাঞ্জাবি দেখা না যায়! এছাড়া আর কী করতাম আমরা?

চারধারের এই পরিস্থিতিতে আমরা সবাই বাসের মধ্যে ফ্লোরে মাথা নিচু করে শুয়ে পড়ি। প্রায় সাত-আট মিনিট পর্যন্ত এমন চরম আতঙ্কের মধ্যেই কাটলো। বুঝতেই পারছিলাম, ভয়াবহ কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা এখানে ঘটেছে। কিন্তু সেটা ঠিক কী এবং কোন অবস্থায় আছে, সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই আমাদের ছিল না।

সেই সময়টাই ছিল আমাদের জন্য সবচেয়ে আতঙ্কের মুহূর্ত। কেউ ঠিকমতো কথাও বলতে পারছিলাম না! বাস চালককে আমরা বললাম, এখান থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যাও। কিছু একটা করো! কিন্তু বাসচালক কোনো নড়াচাড়াই করেনি। সবাই আতঙ্কে বাস চালকের দিকে চিৎকার করে তাকে বাস সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য বলে। আমি নিজেও চিৎকার করলাম। এভাবেই কাটলো আরো ছয় থেকে সাত মিনিট। তখনো চারধারে একজন পুলিশও নেই!

ভয়াবহ এই অবস্থার মধ্যে টেনশন, উদ্বেগে আমাদের সবার রক্ত শুকিয়ে যাবার জোগাড়! তখনই দেখলাম, কয়েকজন পুলিশ এসেছে। সাধারণ কোনো পুলিশ নয়, বিশেষায়িত পুলিশ। তারা এসেই মসজিদে ঢুকে পড়ে, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। আমরা পাথরের মূর্তির মতো হয়ে গেলাম যেন। নড়তে চড়তেই ভুলে যাই সবাই। কারো মুখে কোনো কথা নেই। দেখলাম আমার পুরো শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মসজিদ থেকে তখন রক্তভেজা শরীর নিয়ে আরো লোকজন বেরিয়ে আসছে।

এমন পরিস্থিতিতে আমরা নিজেদের আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলাম না। বেশ কয়েকজন চিৎকার শুরু করলো। একজন চিৎকার করে বললো, ‘চলো বাস থেকে বেরিয়ে যাই!’

সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন বললো, ‘বাইরে বের হলে যদি অস্ত্রধারীরা আমাদের গুলি করতে শুরু করে, তখন কী হবে?’ পাশ থেকে একজন বললো, ‘বাসের মধ্যে এভাবে আটক হয়ে বসে থাকলেও তো আমরা বড় বিপদে পড়ব!’

আমিও ভাবলাম, বাস থেকে নেমে গেলে হয়তো আমাদের বাঁচার একটা সম্ভাবনা আছে। বরং বাসের মধ্যে থাকলেই হয়তোবা সহজ টার্গেট হয়ে পড়ব। কিন্তু যাব কীভাবে? বাসের সামনের এবং মাঝের দু’টো দরজাই যে বন্ধ!

ঠিক তখনই বাসের চালক ঠিক কেন জানি না, আরও দশ মিটারের মতো সামনে বাড়লো। আমি ঠিক জানি না, কেন সে এটা করলো? আমরা তখন তার ওপর ভয়ানক ক্ষেপে গেলাম। তেড়েও গেলাম। সবাই তখন দিশেহারা! বাসের মাঝখানের দরজায় আমরা কয়েকজন লাথি মারতে শুরু করলাম। বাস চালক তখন দরজাটা খুলে দিল। আমি তখন ক্রিকইনফোর বাংলাদেশ প্রতিনিধি মোহাম্মদ ইসাম ভাইকে ফোন করলাম। ইসাম ভাই প্রথমে মনে করলো, আমি বোধকরি তার সঙ্গে কৌতুক করছি! পরে যখন বললাম, ইসাম ভাই আমরা এখন মজা করার মতো অবস্থায় নেই। আপনি কি আমাদের অবস্থা বুঝতে পারছেন না? তখনই দেখলাম আরেক সাংবাদিক মাজহারউদ্দিন আমাকে ফোন করছে। আমার তখন মাথাও ঠিক মতো কাজ করছে না। কী করবো কোনো কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।

অবশেষে আট মিনিট পরে আমরা বাস থেকে নেমে পড়লাম। সবাই বলল, পার্কের ভেতর দিয়ে দৌড়ে চলে যাই। কয়েকজন বলল, খোলা পার্কের মধ্যে আমরা আরও সহজ টার্গেট হয়ে পড়ব। যদি বন্দুকধারী গুলি করতে শুরু করে, তবে খোলা জায়গায় সবাই মারা যাব। হাতে ধরে ব্যাগ নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলে পুলিশ আবার কী ভেবে বসে, সেই চিন্তায়ও মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় আমাদের। ঠিক তখনই দেখলাম, আমাদের তিনজন সাংবাদিক এদিকে এগিয়ে আসছেন। আমি আসলে তখন বুঝতে পারিনি, তবে পরে বুঝতে পারছি, আপনাদের তখন ডেকে বিপদেই ফেলে দিয়েছিলাম।

দুনিয়ায় খুব কম লোক আছে এমন বিপদের দিনে পাশে এসে ছুটে দাঁড়ায়। আমার তো মনে হয়, খুব কাছের কোনো মানুষজনও এমন বিপদের সময় ছুটে আসতো না। যেমনটা আপনারা (সাংবাদিকরা) এসেছেন। একসঙ্গে এত পরিচিত সাংবাদিকদের দেখে আমি সত্যিকার অর্থে স্বস্তি পেলাম। তখন আমরা সবাই একসঙ্গে হাঁটতে শুরু করলাম। খানিকবাদে মসজিদ থেকে দূরুত্ব একটু বাড়তেই কয়েকজন দৌড়াতে শুরু করল, যাতে দ্রুত মাঠে যাওয়া যায়।

আমরা সেদিন মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে নিজ চোখে দেখেছিলাম! পুরো শরীর শীতল হয়ে গিয়েছিল। সেই ভয়াবহ সময় কখনো ভোলার নয়। আমরা সেখান থেকে ফিরে আসার পর প্রতি ঘণ্টায় সেই দুঃস্মৃতি আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে! হয়তো এখন আমরা হাসছি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমরা পুরোই ভেঙে পড়েছি। উফ! যে নৃশংসতা দেখেছি!

এই দুঃসময় কাটতে আমাদের লম্বা সময় লাগবে। পরিবারের সাহায্য লাগবে।

কালের আলো/এমএইচএ

Print Friendly, PDF & Email