রেলে আয়ের চেয়ে উচ্চ ব্যয়
প্রকাশিতঃ 11:20 am | October 19, 2024

মো.শামসুল আলম খান, কালের আলো:
দুর্নীতি ও অপরিকল্পিত ব্যয়ে বছরের পর বছর লোকসানের মুখে রয়েছে রেল। গত দুই যুগেও দেখেনি লাভের মুখ। অথচ এক সময় এই খাতটি ছিল লাভজনক। গত ১৫ বছরে রেলে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা। বিপরীতে লোকসান হয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছর গড়ে লোকসানের পরিমাণ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, রেলে আয়ের চেয়ে ব্যয় কমপক্ষে আড়াই গুণ বেশি। শুধু তাই নয়, গত এক যুগে রেললাইন, সেতু, ভবন নির্মাণ এবং ইঞ্জিন- কোচ কেনায় ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে, গত এক দশকের রেলের বহরে যুক্ত হয়েছে প্রায় ৮০০ কোচ এবং মাত্র ৩০টি লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন)। তবে যথাযথ পরীক্ষা না করে কেনায় ভারী এসব ইঞ্জিন পুরনো রেল সেতুগুলোতে চলতে পারে না। ফলে চাহিদা অনুযায়ী ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি ইঞ্জিনগুলো।
লোকসানের তিক্ত ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেও নতুন করে ৯৩টি কমিউটার ট্রেন পুনরায় চালুর পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। কর্তৃপক্ষ এগুলোকে সংস্কার করে দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রী পরিষেবা হিসেবে চালুর কথা ভাবছে। তবে এতে নতুন করে রেলকে লোকসানের মুখে পড়তে হবে কীনা এ নিয়েও প্রশ্ন ওঠেছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সীমাহীন দুর্নীতির পাশাপাশি বিনা টিকিটে ভ্রমণ এবং প্রায় সব ট্রেনে অর্ধেকের কম কোচ (বগি) নিয়ে চলাচলের কারণে লোকসানের পরিমাণ বেড়েছে ক্রমশ। এজন্য বিনা টিকিটে ভ্রমণ শূন্যের কোঠায় নামাতে হবে। বন্ধ করতে হবে অপরিকল্পিত ব্যয়। এটি সম্ভব হলে লোকসান কমে আসবে। এছাড়া শতভাগ কোচ নিয়ে ট্রেন পরিচালনা করতে হবে, জনপ্রিয় রুটে ট্রেনের সংখ্যা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি পণ্য পরিবহনে মনোযোগী হতে হবে। তাহলে রেলকে পুনরায় লাভজনক করা সম্ভব হবে।
রেলওয়ের গত ১৫ বছরে ব্যয়ের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই সময়ে রেলের অবকাঠামো খাতে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। ২০০৯ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ৮৯টি প্রকল্পে ২১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। চলমান ৩২টি প্রকল্পের জন্য ১ লাখ ৪১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে, যার মধ্যে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৬৬ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত ১৫ বছরে রেলের উন্নয়নে মোট ৮৭ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রেলের অপারেটিং রেশিও ছিল ১৫৮ দশমিক ৯২ শতাংশ, অর্থাৎ ১ টাকা আয় করতে ১ টাকা ৫৯ পয়সা ব্যয় হয়েছে। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরের তথ্য অনুযায়ী, অপারেটিং রেশিও বেড়ে ২৫৮ শতাংশ হয়েছে, যার মানে ১ টাকা আয় করতে ২ টাকা ৫৮ পয়সা খরচ হচ্ছে। এই সময়ে রেলের লোকসান হয়েছে ১ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা।
রেলওয়ের হিসাব বলছে, বছরে ৯ কোটি ২৭ লাখ যাত্রী ট্রেনে ভ্রমণ করে। অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ ৫৩ হাজার যাত্রী। এ যাত্রীর বড় অংশই বিনাটিকিটে চলাচল করে। এ হিসাবের বাইরে লক্ষাধিক যাত্রী অতিরিক্ত চলাচল করে, যাদের প্রায় সবাই বিনাটিকিটে চড়ে। রেলওয়ে অপারেশন ও ট্রাফিক দপ্তর সূত্র বলছে, রেলে লোকবলের অভাব রয়েছে। বিভিন্ন সময় নামমাত্র একটি স্টেশনে ঘণ্টাখানেক অভিযান চালালে বিনাটিকিটি ধরা পড়ে শত শত। এক একটি স্টেশন থেকে গড়ে ৫০ হাজার থেকে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা আদায় করা হয়। ৯৫ শতাংশ স্টেশন উন্মুক্ত থাকায় অভিযান পরিচালনার সময় মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বিনা টিকিট ধরে জরিমানা করা সম্ভব হয়।
রেলওয়ে ভূসম্পত্তি দপ্তর সূত্রে জানা যায়, রেলে বর্তমানে প্রায় ৪ হাজার একর জমি বেদখলে রয়েছে। অপরদিকে ১০৪ জোড়া যাত্রীবাহী ট্রেন ‘লোকসানের’ কারণে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। অনেকেরই দাবি, ট্রেন বন্ধ না করে, লোকসান কমাতে রেলের দখলকৃত জমি উদ্ধার করে আয় বাড়াতে পারে। টিকিটধারী যাত্রীদের বক্তব্য, ট্রেনের ভেতর চেকিং হয় যেন, নিজেদের (টিটিই) পকেট ভরতে। এক একটি ট্রেনে যে পরিমাণ বিনাটিকিটি ভ্রমণ করে, সবাইকে জরিমানার আওতায় আনতে গেলে প্রতি ট্রেনে ন্যূনতম আরও বেশি টিটিই প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুধু রাজনৈতিক কারণে গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে একের পর এক জোড়াতালি দিয়ে নতুন ট্রেন উদ্বোধন করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, চলমান ট্রেনের কোচ কেটে নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। এতে ব্যয় বেড়েছে লাফিয়ে, কিন্তু আয় বাড়েনি মোটেও। আরও অভিযোগ রয়েছে, বাস মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশের কারণে বছরের পর বছর ট্রেন সময়মতো চালানো হয় না, বাড়ানো হয় না কোচ। বাড়ানো হয় না সেবা।
৯৩টি কমিউটার ট্রেন পুনরায় চালুর পরিকল্পনা
আন্তঃনগর এক্সপ্রেসের ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি ক্রু, জনবল, ইঞ্জিন ও কোচ সংকটের কারণে গত ১৫ বছরে বন্ধ করা হয় ৯৩টি কমিউটার ট্রেন। এখন এসব ট্রেন পুনরায় চালুর পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ট্রেনগুলোর মধ্যে রয়েছে ৫০ বছরের পুরনো ট্রেনও।
জানা যায়, ১৯৭২ সালে চালু হওয়া ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটের ঈশা খাঁ এক্সপ্রেস ট্রেনটি পাঁচটি জেলার অন্তত ৩৪টি স্টেশনে থামতো। বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চলের কর্মজীবী মানুষেরা এই লোকাল ট্রেনে স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াতের পাশাপাশি নিত্যপণ্যও পরিবহন করতেন। আর চট্টগ্রাম-সিলেট রুটের জালালাবাদ এক্সপ্রেস ৭টি ছিল জেলার হাজারো মানুষের যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম। এছড়া, ময়মনসিংহ থেকে পাশের জেলা জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় সকাল-বিকাল চলাচল করতো দুটি ট্রেন। ট্রেন দুটির ওপর একইভাবে কর্মজীবী, বিভাগীয় শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ নিম্ন আয়ের মানুষ নির্ভরশীল ছিলেন। আর সিলেট থেকে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলা রুটের চারটি ট্রেনের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, গত এক দশকে ইঞ্জিন এবং কোচ আমদানি করা হলেও, দ্বিতীয় শ্রেণির কমিউটার ট্রেনের কার্যক্রম পুনরায় চালু কারার বিষয়টি বিগত সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের অনিচ্ছার কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। নানান সংকট দেখিয়ে এসব ট্রেন চালু করা না হলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় অজনপ্রিয় রুটে ব্যবহার করা হয়েছে নতুন আমদানিকৃত ইঞ্জিন ও কোচ।
জানতে চাইলে রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী বলেন, ‘গত এক দশকে আন্তঃনগর ট্রেনের কোচ ও ইঞ্জিন আমদানি করা হয়েছে। ফলে চাইলেও দ্বিতীয় শ্রেণির ট্রেনে তা যুক্ত করা সম্ভব হয়নি। আমরা চিন্তা করছি, দ্বিতীয় শ্রেণির ট্রেনগুলো কীভাবে চালু করা যায়। আন্তঃনগর ট্রেনের পুরাতন কোচগুলোকে কনভার্ট করে চালুর চিন্তা করছি। মিটারগেজের (পূর্বাঞ্চল) ইঞ্জিনের সংস্থান করতে না পারলেও ব্রডগেজের (পশ্চিমাঞ্চল) কিছু ট্রেন চালু করা যাবে।’
কালের আলো/এমএসএকে/এমএএএমকে