হাতিঝিলে সাংবাদিক মৃত্যু রহস্য

প্রকাশিতঃ 10:31 pm | August 28, 2024

কালের আলো রিপোর্ট:

রাজধানীর হাতিরঝিলের পানিতে ভাসমান অবস্থায় রাহানুমা সারাহ (৩২) নামে এক নারীর মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। তিনি বেসরকারি টেলিভিশন গাজী টিভির (জিটিভি) নিউজরুম এডিটর ছিলেন। মঙ্গলবার দিবাগত রাত পৌনে ২টার দিকে ওই নারীকে পথচারীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। রাহানুমার বাসা রাজধানীর কল্যাণপুরে। তাঁর বাবার নাম বখতিয়ার শিকদার। তিনি নোয়াখালী প্রেসক্লাবের সভাপতি। এ ঘটনায় শুরু হয়েছে তোলপাড়। এটি আত্মহত্যা না হত্যা, তা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য মেলেনি এখনো।

এর আগে ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি গভীর রাতে সাংবাদিক হাবীব রহমান (৪০) নিহত হন। মোটরসাইকেল আরোহী সাংবাদিক হাবীব রহমান দুর্ঘটনায় নাকি হত্যার শিকার হন সে রহস্য দুই বছরেও জানা যায়নি। হাবীব রহমান সময়ের আলোতে আওয়ামী লীগ বিটে কর্মরত ছিলেন।

একই বছর ৮ জুন হাতিরঝিল থেকে বেসরকারি টেলিভিশন ডিবিসি নিউজের প্রডিউসার আবদুল বারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ প্লাজার পাশে ফজলে রাব্বি পার্কের পেছনে লেকের ধার থেকে ক্ষতবিক্ষত মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। একমাস পর সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আব্দুল বারীর মৃত্যু রহস্য উদঘাটন করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।

তৎকালীন গোয়েন্দা-গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান জানান, ডিবিসি নিউজের প্রযোজক আব্দুল বারী খুনে কেউ জড়িত নন। তিনি ২০ টাকা দিয়ে ফল কাটার ছুরি কিনে নিজেই গলা কেটে আত্মহত্যা করেন। প্রচণ্ড মানসিক অবসাদ ও বিভিন্ন শারীরিক দুর্বলতার কারণে তিনি আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন।

‘জীবন্মৃত হয়ে থাকার চাইতে মরে যাওয়াই ভালো’
পুলিশ বলছে, ময়নাতদন্তের রিপোর্টের পর জানা যাবে মৃত্যুর আসল কারণ। সাংবাদিক রাহানুমা সারাহর বড় বোন রাবিতা সারাহ হাতিরঝিল থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করবেন। এ ঘটনার আগে ফেসবুকে দেওয়া একটি পোস্টে সারাহ লিখেছিলেন, ‘জীবন্মৃত হয়ে থাকার চাইতে মরে যাওয়াই ভালো।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে থাকা রাহানুমা সারাহর কয়েকজন সহকর্মী জানান, সহকর্মী হিসেবে তিনি অত্যন্ত একজন ভালো মনের মানুষ ছিলেন। কারও সঙ্গে কখনোই খারাপ ব্যবহার বা জোরে কথা বলেননি। তবে কেন, কী কারণে এ ঘটনাটি ঘটেছে এখন পর্যন্ত জানতে পারিনি।

আরেক সহকর্মী বলেন, ‘রাতে রাহানুমা হাতিরঝিলে গাছের নিচে বসে ছিলেন এবং একজন গার্ড তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এত রাতে এখানে বসে আছেন কেন। জবাবে বলেন, আমার গাড়ি আসবে, এলে চলে যাবো। এর কিছুক্ষণ পরই কেউ একজন পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে বলে শুনতে পান তিনি।’ তবে সাংবাদিক রাহানুমা সারাহর মৃত্যুর ঘটনায় বেসরকারি টেলিভিশন জিটিভির পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

কী বলছে রাহানুমার পরিবার?
রাহানুমা ঢাকার কল্যাণপুরের একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার ইসলামবাগ কৃষ্ণপুরে। তাঁর বড় বোন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর রাবিতা সারাহ বলেন, ‘আমরা ভোরে আমার বোন অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে আছে এমন সংবাদ পাই। পরে ঢাকা মেডিকেলে এসে দেখি আমার বোন আর বেঁচে নেই।’

তিনি বলেন, ‘আমার বোন হলিক্রস কলেজ এবং ঢাকা সিটি কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করেছে। সে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল। বাবা নোয়াখালী প্রেসক্লাবের সভাপতি। আমার বোনও একজন সাংবাদিক। কী কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে এখন পর্যন্ত জানতে পারিনি।’

সুরতহাল প্রতিবেদনের তথ্য
তদন্ত কর্মকর্তা হাতিরঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাসুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘সাংবাদিক রাহানুমা সারাহর শরীরে কোনো যৌন নিপীড়ন বা জখমের আলামত পাওয়া যায়নি। মৃত্যু সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। তার দেহ অচেতন অবস্থায় হাতিরঝিলের পানিতে ভাসমান ছিল। শরীরে বাহ্যিক কোনো আঘাত বা আঁচড়ের চিহ্ন নেই। কোনো যৌন নিপীড়নের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ে ময়নাতদন্তসহ অন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আত্মহত্যা নাকি হত্যা?
সাংবাদিক রাহানুমা সারাহর বন্ধুদের বক্তব্য, দীর্ঘদিন ধরে সারাহ মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত ছিলেন। জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মানসিক চাপ ও বিষণ্নতা থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। বিষণ্নতার উপযুক্ত চিকিৎসার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পরিবার ও বন্ধুদের এগিয়ে আসতে হবে। তারা যদি বুঝতে পারে তাদের বন্ধু বিষণ্নতায় আক্রান্ত তাহলে তার পাশে দাঁড়াতে হবে। মানসিক রোগ বা বিষণ্নতার চিকিৎসা না করলে মানুষটি আত্মঘাতী হতে চাইবে। এ রোগটিকে এড়িয়ে যাওয়া বা অবহেলার সুযোগ নেই।’

জানতে চাইলে হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মৃত সাংবাদিকের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মৃত্যুর কারণ ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এলে জানা যাবে। ভুক্তভোগীর পরিবারে থেকে বড় বোন রাবিতা সারাহ একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করবেন। অপমৃত্যুর মামলাটি প্রক্রিয়াধীন।’

কালের আলো/এমএএইচ/ইউএইচ

Print Friendly, PDF & Email