বিভিন্ন মেসে পুলিশের অভিযান, শিক্ষার্থীদের বাড়ি যাওয়ার নির্দেশ

প্রকাশিতঃ 4:05 pm | July 25, 2024

নিজেস্ব প্রতিবেক,কালের আলো:

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মেসে মেসে পুলিশ অভিযান চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার না করলেও রাতের মধ্যে ঢাকা ছেড়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাদের।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, অনেক মেসে গিয়ে পুলিশ বিনয়ের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বাড়ি ফেরার অনুরোধ জানিয়েছে। এতে বাধ্য হয়ে অনেকেই বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু দূরপাল্লার পরিবহন চলাচল না করায় বিপাকে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। অনেকে আবার ঢাকায় থেকে যেকোনও মূল্যে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এদিকে মেস মালিক ও বাড়িওয়ালারাও শিক্ষার্থীদের মেস ছেড়ে বাড়ি যাওয়ার চাপ দিয়েছেন। বাড়িওয়ালারা শিক্ষার্থীদের সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, হয়তো বাড়ি যেতে, নয়তো একেবারে মেস ছাড়তে হবে।

অনেক বাড়িওয়ালা বলেন, ‘আমাদের কিছু করার নেই। আমাদের যেমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, আমরা তা-ই করেছি। নয়তো পরে আমরা বিপদে পড়বো।’ তবে অনেক বাড়িওয়ালা বলেছেন, ‘বাসায় থেকে শিক্ষার্থীরা যদি অনৈতিক কিছু না করে, তাহলে তাদের জোর করার অধিকার আমার নেই।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১৬ জুলাই রাত থেকে পুলিশ ঢাকা শহরের বিভিন্ন মেসে গিয়ে অভিযান চালিয়ে শিক্ষার্থীদের মেস ছাড়ার নির্দেশ দেয়। ১৭ ও ১৮ জুলাই পুলিশের এই অভিযান চলমান ছিল। ফলে রাজধানীর অধিকাংশ শিক্ষার্থী মেস ছাড়তে বাধ্য হন।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী শাহেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বুধবার রাতে (১৭ জুলাই) পুলিশ বাসায় এসেছে। তারপর আমাদের বলেছে সকালের মধ্যে যেন মেস ছেড়ে বাড়ি চলে যাই। তারা অবশ্য শুরুতে আমাদের অনুরোধ করেছে। তারা বলেছে, আমাদের ভালোর জন্যই যেন আমরা বাড়ি যাই। সব ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানোর জন্য বাড়ি যেতে। তবে ধমক দিয়ে বলেছে, পরদিন সকালে এসে দেখবে‌ আমরা মেস ছেড়ে বাড়ি গিয়েছি কি না।’

কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী মাইনুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুলিশ বুধবার রাত ১টায় বাসায় এসে সকাল ৮টার মধ্যে ঢাকা ছাড়ার আল্টিমেটাম দিয়ে গেছে। বলছে ঢাকা না ছাড়লে বিপদে পড়বো। এদিকে আমার টিউশনি আছে। গত মাসে অসুস্থতার জন্য এক সপ্তাহ পড়াতে পারিনি। এখন যদি বাড়ি চলে যাই, তাহলে তো টিউশনি টিকবে না। পরে তো ঢাকায় থাকতে কষ্ট হয়ে যাবে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি ঢাকা ছাড়বো না।’

আন্দোলনে গিয়েছেন কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে এই আন্দোলনে যাওয়া আমার নৈতিক দায়িত্ব। তা ছাড়া এই আন্দোলন আমাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন। এখানে যদি আমরা না যাই, তাহলে তো হবে না। আমার ভাইয়েরা এই আন্দোলনের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে আর আমি যদি পুলিশের ভয়ে ঢাকা ছেড়ে বাড়ি যাই, তাহলে আমার মতো কাপুরুষ আর নেই।’

পুরান ঢাকার অন্তত ২০টি মেসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানকার অধিকাংশ মেসেই পুলিশ গিয়ে সতর্ক করেছে এবং মেস ছাড়তে নির্দেশ দিয়েছে। তবে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী তা কর্ণপাত করেননি। আন্দোলন ছাড়াও মেস না ছাড়ার সবাই যৌক্তিক কারণ দেখিয়েছেন তারা। অনেকে বলছেন, মাসের এই মাঝামাঝি সময়ে বাড়ি ফেরার জন্য পকেটে তেমন টাকা নেই। যা ছিল তা মেসে মিলের জন্য দিয়ে দিয়েছি। তা ছাড়া টিউশনি ছেড়ে যাওয়ার উপায় নেই বলেও জানান অনেকে। অনেকে আবার আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পণ করে মেসে ছিলেন।

এদিকে বাড়িওয়ালা ও মেস-মালিকরাও পুলিশের নির্দেশনায় বিপাকে পড়েছেন। পুরান ঢাকার সূত্রাপুর এলাকার খোকন মিয়া নামের এক মেস পরিচালক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুলিশ এসে আমাকে বলে গেছে মেস থেকে যেন সবাই চলে যায়। তাই আমিও সবাইকেই বলে দিয়েছি। এখন যাওয়া না-যাওয়া ওদের ব্যাপার। ওরা তো আমাকে ঠিকমতো ভাড়া দিচ্ছে। তা ছাড়া ওরা কোনও অনৈতিক কাজ বা অন্যায় করেনি। তাহলে আমি তো তাদের যাওয়ার জন্য জোর করতে পারি না। পুলিশ পরে এসে আবার কী ঝামেলা করে তা জানি না। আমি বাড়িওয়ালাকে বিষয়টি জানিয়েছি, তিনি আবার দেশের বাইরে থাকেন।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুরান ঢাকার এক বাড়িওয়ালা বলেন, ‘পুলিশ এমনভাবে আমাকে থ্রেট করেছে যে শিক্ষার্থীরা বাড়ি না গেলে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। আমার বাসায় দুইটা ছেলেদের মেস। প্রায় ২০ জনের মতো শিক্ষার্থী থাকে। সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কবি নজরুল কলেজেরও আছে কিছু। আমি তাদের পুলিশের নির্দেশনার বিষয়ে জানিয়েছি। এখন তারা যদি না যায়, আমার তো কিছু করার নেই। কয়েকজনকে দেখলাম বৃহস্পতিবার ভোরেই মেস ছেড়ে চলে গেছে। এখন কোথায় গিয়েছে, কীভাবে গিয়েছে বা ঢাকাতেই অন্য কোথাও গিয়েছে কি না তা জানি না।’

পুরান ঢাকার ধোলাইখাল এলাকায় মেসে থাকা আবির মাহমুদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ। বাড়ি যাওয়ার উপায় ছিল না। ঢাকার অবস্থা এতটা খারাপ হবে কল্পনা করিনি। বাসার পাশের গলিতে শিক্ষার্থীদের লাশ পড়ে ছিল। শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিচ্ছে পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করছে, সাউন্ড গ্রেনেড মারছে, শিক্ষার্থীরা পুলিশের দিকে ইট ছুড়ে মারছে, পুলিশও নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে।’

পুরান ঢাকা ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীদের মেসে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। বাড্ডা, সাতারকুল, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী—এসব এলাকার শিক্ষার্থীদের মেসেও পুলিশ অভিযান চালিয়েছে বলে একাধিক শিক্ষার্থী জানান।

তাদের একজন তিতুমীর কলেজের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ফারুক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পুলিশ মেসে এসে বাড়ি যাওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছে। আমরাও পুলিশের কথায় সম্মতি জানিয়েছি। ইতোমধ্যে কেউ বাড়ি চলে গেছে, কেউ মেসেই রয়ে গেছে। আমি আর আমার বন্ধু সোহাগ আন্দোলনের শুরু থেকেই ছিলাম। আমাদের দেখাদেখি আরও অনেক শিক্ষার্থী আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। এখন আমরা যদি ভয়ে পালিয়ে যাই, তাহলে অন্যরা সাহস হারাবে। তাই পুলিশ বললেও আমরা কয়েকজন কোথাও যাইনি।’

মেসে অভিযান চালানোর কথা স্বীকার করেছেন পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। শুক্রবার রাত ৯টার দিকে বাহাদুর শাহ পার্ক সংলগ্ন পুলিশ বক্সে দুজন পুলিশ কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মেসে পুলিশের অভিযানের পর শিক্ষার্থীরা বাড়ি চলে গেছে। যারা ঢাকায় ছিল, তারা আসলে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ছিল। এদের উদ্দেশ্য কোটা সংস্কার আন্দোলন নয়, এরা মূলত অরাজকতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য ছিল। পুলিশের এই অভিযান শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে পরিচালনা করা হয়েছে এবং এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা উপকৃত হয়েছে বলেও জানান পুলিশ কর্মকর্তা।

 

কালের আলো/এমএএইচ/ইউএইচ