বাণিজ্যিক চিন্তা থেকে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার
প্রকাশিতঃ 2:13 pm | April 26, 2024
কালের আলো ডেস্ক:
ফার্মের গরুর দুধ কিনে আগুনে জ্বাল দিলে ওপরে ভেসে ওঠে হলুদ আস্তরণ। ব্রয়লার মুরগি কিনে মাংসে পাওয়া যায় বিষ। চাষ করা মাছের মধ্যেও আছে ক্ষতিকর উপাদান। সবকিছুই ঘটছে অ্যান্টিবায়োটিকের মিশ্রণে।
অণুজীববিজ্ঞানী ও গবেষকরা বলছেন, যেসব কোম্পানি পশুখাদ্য তৈরি করে, তারা গরু, মুরগি, মাছের খাবারে মানুষের জন্য তৈরি অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ মিশিয়ে দিচ্ছে। আবার প্রাণীর জন্য যে অ্যান্টিবায়োটিক, তাও তাদের খাওয়ানো হচ্ছে।
বাজারে বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগির দেহে অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রা পরীক্ষা করে দেখা যায়, কোনো কোনো মুরগির মাংসে, বিশেষ করে কলিজায় অ্যান্টিবায়োটিকের হার আশঙ্কাজনক। মুরগির মাংস অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত ৫৫ শতাংশ। মৎস্য, পশু ও পোল্ট্রি শিল্পে ১৯ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার করা হচ্ছে। শাক-সবজি উৎপাদনেও ব্যবহার হয় অ্যান্টিবায়োটিক।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটির (সিভাসু) সহকারী অধ্যাপক অভিজিৎ দত্ত ও চট্টগ্রাম বিসিএসআইআর এর রিসার্চ ফেলো জান্নাতুল ফেরদৌস এর মতে, পোলট্রি মুরগিকে অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া, গবাদিপশুকে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করানো, অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ, রোগীর পরিমাণমতো অ্যান্টিবায়োটিক না খাওয়া, হাসপাতালের বর্জ্য যেখানে সেখানে ফেলা সহ নানা কারণে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স (প্রতিরোধী) হয়। এতে মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে, ৭০ শতাংশ পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষ জ্বর সর্দি-কাশিতে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করেন। ভুল অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছেন প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ। মাথাব্যথা, হাত ও পা ব্যথার মতো বিভিন্ন উপসর্গেও খাচ্ছেন অ্যান্টিবায়োটিক। ২১ শতাংশ পার্বত্যবাসী এজিথ্রোমাইসিন ও ১৯ শতাংশ এমোক্সিসিলিন সেবন করছেন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই। ৬০ শতাংশ লোকেরই অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের প্রতিক্রিয়া ও অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা নিয়ে ধারণা নেই।
চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (সিআইএমসিএইচ) ফার্মাকোলজি বিভাগ ও কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের উদ্যোগে নগরের চান্দগাঁও ওয়ার্ডের অর্ধশত ফার্মেসির ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা যায়, সামান্য জ্বর থাকা রোগীদের ক্ষেত্রেও ৭২ শতাংশ ওষুধ বিক্রেতা চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অ্যাজিথ্রোমাইসিন নামের অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করা হয় ৪৪ শতাংশ, সিপ্রোফ্লক্সাসিন বিক্রি করা হয় ২৪ শতাংশ, সেফ্রাডিন ১২ শতাংশ, সেফিক্সিম ১০ শতাংশ এবং লিভোফ্লক্সাসিন ৮ শতাংশ। পাশাপাশি ৩৬ শতাংশ রোগী তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়ার আশায় ওষুধ বিক্রেতাকে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে বাধ্য করেন।
সিআইএমসিএইচ’র ফার্মাকোলজি বিভাগের প্রভাষক ডা. মোহাম্মদ রাকিব হাসান বলেন, কোনো ফার্মাসিস্ট ছাড়া অনভিজ্ঞ কিছু লোক ফার্মেসিতে প্রয়োজন ব্যতিরেকে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করছে। অথচ এসব অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের ফলে রোগীর যেসব শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, সে সম্পর্কে তারা জানে না।
গত ২৪ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের আয়োজনে অনুষ্ঠিত সিম্পোজিয়ামে বক্তারা বলেন, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণজনিত রোগের পর অনেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করেন। কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর আর কেউ পর্যাপ্ত অ্যান্টিবায়োটিক খেতে চান না। ফলে শরীরের ব্যাকটেরিয়া সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস না হয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এরপর আর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না।
‘অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের দুই সপ্তাহ পর মুরগি বিক্রি করলে সাধারণত দেহে ক্ষতিকর মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক থাকে না। কিন্তু অনেক খামারি অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের দিনেও মুরগি বিক্রির জন্য বাজারে তোলেন। ফলে এসব অ্যান্টিবায়োটিক মানুষের দেহে পৌঁছে যাচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে চিকিৎসককে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প পেয়ারা, পেঁপে, লবঙ্গ, কাঁচা হলুদ- এ ধরনের খাবার খেতে হবে। কারণ, এতে ব্যাকটেরিয়ার প্রতিষেধক আছে’।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বাণিজ্যিক চিন্তা থেকে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিকের দাম বেশি। আর বেশি দামি ওষুধ বিক্রিতে বেশি লাভ। আশঙ্কার বিষয় হলো- বর্তমানে রোগীদের শরীরে আইসিইউতে রাখা রিজার্ভ অ্যান্টিবায়োটিক যেমন: ‘মেরোপেনা’ কাজ করছে না। বিভিন্ন হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসা নেওয়া শতকরা ৫২ শতাংশ রোগীর মাঝে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স পাওয়া গেছে। হৃদরোগ, কিডনী, শিশু ও নবজাতক বিভাগের রোগীদের মাঝে এই হার ২১.৫ শতাংশ।
অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ে যৌথভাবে গবেষণা করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি। সেই গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক রোগীদের দেওয়া হচ্ছে। বেশি ব্যবহৃত ১০টি অ্যান্টিবায়োটিক অনেক ক্ষেত্রে রোগ নিরাময়ে কাজে আসছে না।
গবেষকেরা ৭ হাজার ৬৫৮ জন রোগীকে দেওয়া অ্যান্টিবায়োটিক পর্যালোচনা করেছেন। তাতে দেখা গেছে, ১০টি অ্যান্টিবায়োটিক সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। এই তালিকায় আছে- সেফট্রিয়াক্সোন, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, সিপ্রোফ্লোক্সাসিন, ফ্লুক্লক্সাসিলিন, মেরোপেনেম, সেফিক্সিম, অ্যামোক্সোসিলিন ও ক্যালভুলানিক অ্যাসিড, সেফুরোক্সিম, মস্কিফ্লক্সাসিন ও মেট্রোনিডাজল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় সেফট্রিয়াক্সোন। অ্যান্টিবায়োটিকটি ৩৬ শতাংশের বেশি রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে ৭৬ শতাংশ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সেফট্রিয়াক্সোন কাজ করে না, বেসরকারি হাসপাতালে তা ৪৩ শতাংশ।
এর আগে চবি এবং চট্টগ্রাম মা-শিশু ও জেনারেল হাসপাতালের গবেষণায় উঠে আসে, চট্টগ্রামের ৭০ ভাগ মানুষের শরীরেই অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করছে না। গবেষণায় দেখা যায়, নগরের আগ্রাবাদ, ডবলমুরিং, পাঁচলাইশ, হালিশহর, বায়েজিদ ও বাকলিয়ায় সবচেয়ে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর রোগী পাওয়া গেছে। এছাড়া উপজেলার মধ্যে সীতাকুণ্ড, পটিয়া, হাটহাজারী ও চন্দনাইশ এলাকাতেও মিলেছে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর রোগীর সংখ্যা।
অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে গবেষণায় যুক্ত চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ডা. মাসুদ রানা বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো- সাম্প্রতিক সময়ে অত্যধিক মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার। অনেকেই জ্বর, মাথাব্যথা হলেই চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করেন। আবার অনেকে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক নিলেও সেটার পূর্ণ কোর্স সম্পন্ন করেন না। কয়েকটি খাবার পর ভালো বোধ করলেই ছেড়ে দেন। ফলে ওই ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিকের আর কোন প্রভাব থাকে না। আবার অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ম করে খাওয়া সত্ত্বেও শিশুরাও অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের শিকার হতে পারে। এর কারণ প্রকৃতি-পরিবেশে অ্যান্টিবায়োটিকের বিস্তার।
কালের আলো/এমএইচ/এসবি