শিক্ষাবান্ধব শিক্ষক দরকার

প্রকাশিতঃ 8:19 pm | January 24, 2019

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী:

শিক্ষা একটি সার্বজনীন বিষয়। এর মাধ্যমে মানুষের সুপ্ত প্রতিভা জাগ্রত হয়। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষার ইতিবাচক প্রভাব মানুষের মধ্যে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে কিনা সেটি গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন। একসময় মনে করা হতো শিক্ষা মানুষের মধ্যে উন্নত চিন্তাধারা তৈরি করে। মানুষকে উদার ও সার্বজনীন হতে সাহায্য করে। এর সঙ্গে যদি সশিক্ষার বিষয়টি যুক্ত থাকে তবে প্রকৃত অর্থেই মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পদে পরিণত হয়।

কিন্তু প্রথাগত যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত, তা অনেক ক্ষেত্রে ইতিবাচক আবার অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলছে। এর কারণ বাস্তবমুখী ও জীবনঘনিষ্ঠ যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার ছিল, তার পরিবেশ এখন পর্যন্ত তৈরি করা সম্ভব হয়নি। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনার মুখ্য বিষয় ছিল নান্দনিকতা, মানবিকতা ও আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা লাভ। পুঁথিগত শিক্ষার চেয়ে তিনি প্রকৃত জ্ঞান অর্জনকে শিক্ষার প্রধান অংশ বলে বিবেচনা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনা প্রসঙ্গে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-ভাবনা তার সময়ের চেয়ে অগ্রসর ছিল। প্রকৃতির সঙ্গে ব্যক্তির, ভাবনার সঙ্গে কর্মের, জ্ঞানের সঙ্গে মনুষ্যত্ববোধের, স্থানিকতার সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার, আহরণের সঙ্গে প্রকাশনের, আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা লাভের যে চিন্তা তিনি করেছিলেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক।’ কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এ বিষয়গুলো অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত অর্থে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ফলে দেখা যাচ্ছে, অনেক শিক্ষিত মানুষের মধ্যে উন্নত চিন্তাধারার পরিবর্তে রক্ষণশীল চিন্তাধারা তৈরি হচ্ছে, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। শিক্ষার সঙ্গে যেমন শিক্ষার্থীর সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি রয়েছে শিক্ষকেরও সম্পর্ক।

এ তিনটি বিষয়ের মনস্তাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক সমন্বয়হীনতা থাকলে তা সমাজ ও মানসিকতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ের জঙ্গিবাদের বিষয়টি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। এই জঙ্গিবাদের সঙ্গে যেমন শিক্ষার্থীরা সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে, তেমনি শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও জঙ্গিবাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টি সহজভাবে দেখার সুযোগ নেই। আর এখানেই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ধরনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। যদি শিক্ষকের মানসিকতা রক্ষণশীল ও পশ্চাৎমুখী হয়, তবে একজন শিক্ষকের মাধ্যমে অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে একই ধারণা তৈরি হতে পারে।

কারণ একজন শিক্ষক খুব সহজেই একজন শিক্ষার্থীকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। দেশে সবচেয়ে আলোচিত জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত অনেকেই শিক্ষকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। গুলশানের হলি আর্টিজান হামলার সঙ্গেও একজন সাবেক শিক্ষকের জড়িত থাকার অভিযোগ এসেছে। এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘শিক্ষকতা পেশায় থেকে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়ে পড়া শিক্ষকদের টিকতে দেয়া হবে না। আপনারও খেয়াল রাখবেন, শিক্ষকদের ভেতর যেন কুশিক্ষক, কুলাঙ্গার ঢুকে না পড়ে।’

শিক্ষকতার সঙ্গে নৈতিকতা ও সততার বিষয়টি গভীরভাবে সম্পর্কিত। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি যদি নৈতিকতা ও সততার ভিত্তিতে গড়ে তোলা না যায় তবে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। সাম্প্রতিকালে এ প্রসঙ্গটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ছাত্রী নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে।

শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, স্কুল ও কলেজের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও যৌন হয়রানির অভিযোগ এসেছে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে, যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো পবিত্র স্থানে কোনোভাবেই চিন্তা করা যায় না। তবে কতিপয় শিক্ষকের নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে সমগ্র শিক্ষক সমাজকে দায়ী করা যায় না। তবে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- যখন সমাজ পচনের দিকে অগ্রসর হয় তখন এর বিস্তৃতি ঘটতে পারে। আর কোনোভাবেই যাতে এর বিস্তার না ঘটে সেজন্য তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আগেই কঠোরভাবে দমন করতে হবে।

এ ধরনের ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে ঘটার কারণে শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্যহীন অবস্থা তৈরি হয়েছে। সমাজবিদদের মতে সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে এই ঘটনাগুলো ঘটছে। আবার মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রেও যে এক ধরনের বিপর্যয় চলছে, তা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই প্রফেশনাল ইথিক্স বিষয়টি শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে পড়ানো হয়।

আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য, ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট যৌন হয়রানিকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এতে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে আচরণবিধি তৈরি করার নির্দেশ দেয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন সেল গঠন এবং হাইকোর্টের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী আচরণবিধি তৈরি করার নির্দেশ দেন। তবে যৌন নিপীড়ন সেল বাস্তবে কাজ করছে কিনা অথবা আচরণবিধি তৈরির যে নির্দেশনা রয়েছে সে ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে কিনা এ বিষয়ে সরকারকে লক্ষ রাখতে হবে।

কেননা শিক্ষাক্ষেত্রে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। এপিজে আবদুল কালাম বলেছেন, ‘তিনজনই পারেন একটি দেশ ও জাতিকে বদলাতে। তারা হলেন, বাবা, মা ও শিক্ষক।’ এখানে শিক্ষকদের সমাজ ও রাষ্ট্র পরিবর্তনের রূপকার হিসেবে চিন্তা করা হয়েছে। একজন শিক্ষককে হতে হবে দার্শনিকের মতো। তার জ্ঞানের গভীরতা, ব্যক্তিত্ব ও সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রসারিত হয়ে শিক্ষার্থীকে বিকশিত করে তুলবে। একজন শিক্ষকের ব্যক্তিত্বের প্রধান বিষয় হবে তার চারপাশের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। কেননা শিক্ষকতা একটি মহান পেশা।

শিক্ষা একজন শিক্ষককে শুধু আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবেই বিবেচনা করে না, বরং এ পেশার উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে একজন শিক্ষক গৌরবান্বিত হয়। কিন্তু যখন কোনো শিক্ষক পুঁথিগত শিক্ষার সঙ্গে সশিক্ষার সমন্বয় ঘটাতে পারে না, তখন তার আর যাই হোক মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার ক্ষেত্রে তার মধ্যে এক ধরনের সংকীর্ণতা কাজ করে। শিক্ষক হয়ে যায় সন্ত্রাসী।

অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির সঙ্গেও শিক্ষকদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠছে। ফলে কিছুসংখ্যক শিক্ষকের কারণে শিক্ষকসমাজ তার প্রকৃত চরিত্র ও গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। শিক্ষকদের মূল কাজ হচ্ছে তার শিক্ষার্থীকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করা। আবার গবেষণামনস্ক শিক্ষার্থী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। বাস্তবে শিক্ষা ও গবেষণার মননশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শিক্ষকরা যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে কিনা এ বিষয়টি শিক্ষকদেরই ভেবে দেখতে হবে।

আবার গবেষণার ক্ষেত্রের নৈতিকতার বিষয়টি নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। আমেরিকার অ্যারিজনা স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ম্যাথিউস তার বইয়ের কিছু অংশ অন্য একটি বই ও প্রবন্ধ থেকে কপি করার কারণে তার বিরুদ্ধে নৈতিকতা লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়। পরে শাস্তি হিসেবে তাকে অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপকের নিন্মপদে নামিয়ে দেয়া হয়। আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার অধ্যাপক জেমস টুইচেলকে একই ধরনের অপরাধের কারণে ৫ বছরের জন্য বিনা বেতনে বরখাস্ত করা হয়।

পরে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণে বাধ্য করা হয়। বাংলাদেশের শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে কিনা তা ভেবে দেখা দরকার। না হলে যে কোনো সময় একজন শিক্ষক নিজের অজান্তে অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারেন।আরেকটি বিষয় খতিয়ে দেখা দরকার তা হলো শিক্ষকদের কৃত্রিম প্রাচীর তৈরির কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে কিনা | অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা প্রদানের বদলে অনেকক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্ধি হিসেবে ভাবছে | ফলে শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্য শিক্ষকের সংখ্যা ক্রমশ কমছে | এই আত্মঘাতী চরিত্রের পরিবর্তন দরকার |

শিক্ষকতা একটি মহান পেশা হিসেবে পরিচিত। তবে কোনোভাবেই এটিকে পেশা হিসেবে না ভেবে জ্ঞান বিতরণের উৎস হিসেবে ভাবা উচিত। এটাকে পেশা হিসেবে ভাবায় পেশাদারিত্ব বাড়ানোর জন্য শিক্ষালয়ে সময় দেয়ার প্রবণতা কমছে; কিন্তু রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। শিক্ষকদের মধ্যে যখন গবেষণা আর শিক্ষা মুখ্য বিষয় না হয়ে বাণিজ্যকরণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয় তখন শিক্ষক হয় দুর্বৃত্ত, শিক্ষা হয় ভূলুণ্ঠিত আর শিক্ষার্থী হয় নির্যাতিত। অবারিত শিক্ষার দ্বার সময়ের গণ্ডিতে রুদ্ধ হয়, শিক্ষার্থীতে পূর্ণ থাকে শিক্ষালয় আর শিক্ষালয় থাকে শিক্ষকশূন্য।

বাণিজ্যকরণের পক্ষে চলে লাগামহীন যুক্তি আর শিক্ষার ঘটে অপমৃত্যু। ভাবুন তো বিষয়টি কত নির্মম। এখন যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ তা হল, শিক্ষক নিজেকে কি দেবতার আসনে বসাতে পারবেন? নাকি ভয়ানক দৈত্য হয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেবেন? এই সিদ্ধান্ত শিক্ষকদেরই নিতে হবে তাদের বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকে।

লেখক: শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

Print Friendly, PDF & Email