উদ্বোধনের অপেক্ষায় দেশের এভিয়েশন খাতের সবচেয়ে বড় প্রকল্প থার্ড টার্মিনাল
প্রকাশিতঃ 5:09 pm | September 30, 2023

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নয়নাভিরাম থার্ড টার্মিনালের উদ্বোধন হবে আগামী ৭ অক্টোবর। প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা এ মেগা প্রকল্পের আংশিক উদ্বোধন করবেন। তার আগেই কাজ শেষ করতে রাতদিন কাজ করছে হাজার হাজার কর্মী।
সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক এ মেগা প্রকল্পে যাত্রীদের জন্য থাকছে অত্যাধুনিক সব সুবিধা। ই-গেট, হাতের স্পর্শ ছাড়া চেকিং, নিজেই নিজের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করা যাবে এ টার্মিনালে। সুপরিসর অ্যাপ্রোন, বিশাল গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত লাগেজ বেল্ট যাত্রীদের দেবে নতুন অভিজ্ঞতা। শাহজালাল বিমানবন্দরের এই টার্মিনাল এখন উদ্বোধন হলেও ২০২৪ সালের শেষ দিকে এটি ব্যবহার করতে পারবেন যাত্রীরা। এক বছর টার্মিনালে ফ্লাইট পরিচালনায় গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং চুক্তি, যন্ত্রপাতি স্থাপন, জনবল নিয়োগসহ যাবতীয় প্রস্তুতি নেবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। তারপর বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের আধুনিক সব সেবা নিতে পারবেন যাত্রীরা।
জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এখন চলছে ময়লা পরিষ্কার ও ধোয়া-মোছার কাজ। বেবিচক ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মিলে কাজগুলো তদারিক করছে। টার্মিনালের দক্ষিণ প্রান্তে প্রথম বোডিং ব্রিজটি প্রস্তুত হয়ে গেছে। সেটি সাধারণ ও ভিআইপি যাত্রীরা ব্যবহার করতে পারবেন। এজন্য উদ্বোধনের দিন ট্রায়াল রান হিসেবে একটি বিমান সেখান থেকে ডিপার্টচার করা হবে। আর বোডিং গেটগুলো লাগানো হয়েছে এয়ারক্রাফটের ধরন অনুযায়ী।
২০১৫ সালে শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ২০১৭ সালে ২৪ অক্টোবর তা অনুমোদন পায়। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩ হাজার ৬১০ কোটি ৪৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। কিন্তু পরে তা বেড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়। জাপানের সিমুজি ও কোরিয়ার স্যামসাং যৌথভাবে এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম (এডিসি) বাস্তবায়ন করছে টার্মিনালটি।
থার্ড টার্মিনালটির ভবন হবে তিন তলা। ভবনটির আয়তন ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার। এটির নকশা করেছেন স্থপতি রোহানি বাহারিন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অত্যাধুনিক থার্ড টার্মিনালে একসঙ্গে ৩৭ থেকে ৪২টি এয়ারক্রাফট পার্কিং করা যাবে। আর এই এপ্রোনে দুটি হাই স্প্রিড ট্যাক্সি যুক্ত হবে। আর যেটি সরাসরি যুক্ত হবে শাহজালালের মূল রানওয়ে থেকে। বর্তমানে শাহজালালে যে দুটি টার্মিনাল আছে বছরে সেগুলো সেবা দিতে পারে প্রায় ৮০ লাখ। নতুন টার্মিনাল তৈরি হলে সেই সেবার সক্ষমতা পৌঁছবে ২ কোটি ৪০ লাখে।
বেবিচক সূত্র জানিয়েছে, নতুন টার্মিনালে নানা সুবিধার দেওয়ার জন্য ২৬টি বোর্ডিং ব্রিজ, ১১৫টি বহির্গমন চেক-ইন কাউন্টার, ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রণ কাউন্টার, ৬৬টি বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টার, ৫টি স্বয়ংক্রিয় আগমনী চেক-ইন কাউন্টারসহ মোট ৫৯টি কাউন্টার, ১৬টি ব্যাগেজ বেল্ট, ২৭টি হোল্ড ব্যাগেজ স্ক্যানিং মেশিন, ৪০টি কেবিন ব্যাগেজ স্ক্যানিং মেশিন, ৫২টি মেটাল ডিটেক্টর, ১১টি বডি স্ক্যানার মেশিন। এছাড়াও থাকছে হাজারের বেশি গাড়ি পার্কিং করার মাল্টিলেভেল কার পার্কিং।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, থার্ড টার্মিনালে মোট বোডিং ব্রিজ থাকবে ২৬টি। আপাতত ১২টি হবে। পরে বাকিগুলো হবে। আরেকটি প্রকল্পে সেই কাজ সম্পন্ন করা হবে। তবে ডলারের দাম বাড়ায় আগের দামে নতুন বাকি বোডিং ব্রিজগুলো তৈরি সম্ভব হবে না। এজন্য নতুনভাবে নতুন খরচে সেগুলো তৈরি হবে। তবে সেটির জন্য বেবিচক এখন জাইকার অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। তারা অনুমোদন দিলে বাংলাদেশ সরকারও অনুমতি দেবে। তখন ১২টার জায়গায় ২৬টি বোডিং ব্রিজ হবে। তখন গেটের সংখ্যাও বাড়বে। এটিকে ক্ষমতা বৃদ্ধি মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
থার্ড টার্মিনালের সঙ্গে যুক্ত থাকবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। আরও থাকবে বিআরটি ও এমআরটিআই। ফলে এই তিন মাধ্যমে ব্যবহার করে একজন যাত্রী বিমানবন্দরের ভেতরে প্রবেশ ও বের হতে পারবেন। আগের বিমানবন্দরে ভেতর থেকে বের হয়ে যেখানে মাইক্রোবাস বা অটোরিকশায় উঠতে হতো সেই সড়কটি তেমন প্রশস্ত নয়। কিন্তু থার্ড টার্মিনালের সড়কটি হবে প্রশস্ত। এ কারণে খুব সহজে যে কেউ ব্যক্তিগত বা ভাড়ায়চালিত গাড়ি নিয়ে আসতে পারবেন। এরপর তাকে মূল গেট দিয়ে ভেতর প্রবেশ করতে হবে। এই গেটগুলো চালু হলে বিভিন্ন নম্বর ও নাম দেওয়া হবে। মূল গেট হয়ে যাত্রী খুব সহজে টার্মিনালের প্রধান ভবনে প্রবেশ করতে পারবেন।
টার্মিনালের ভেতর প্রবেশ করে বোডিং সম্পন্ন করার জন্য বিভিন্ন কাউন্টার পাওয়া যাবে। এসব কাউন্টারের মাধ্যমে প্রথম যে চেকিং সেটি সম্পন্ন হয়ে যাবে। যেখানে একজন যাত্রী তার লাগেজ দেবেন। বোডিং সম্পন্ন করলে লাগেজ সোজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এয়ারক্রাফটে উঠবে। তবে এই বিভাগে এখনো প্রতিদিন পরীক্ষামূলক কাজ চলছে। যাতে কোনো লাগেজ আটকে না থাকে। দ্রুত চলে যেতে পারে এয়ারক্রাফটে।
এরপর একজন যাত্রীর কাজ শুরু হবে ইমিগ্রেশনের। তাকে ইমিগ্রেশন করার জন্য সেই কাউন্টারে যেতে হবে। কাঁচে ঘেরা অংশে হবে ইমিগ্রেশন। ইমিগ্রেশন শেষ হলে সোজা চেকিং কাউন্টারে। চেকিং কাউন্টারে বিমানবন্দরের সমস্ত কাজ শেষ হবে। এরপর তিনি উঠবেন এয়ারক্রাফটে। তবে যাওয়ার সময় যাত্রীকে লেভেল টু থেকে ওয়ানে নামতে হবে। এজন্য চলন্ত সিঁড়ি ও লিফটও ব্যবহার করা যাবে।
বেবিচক সূত্র জানায়, এই টার্মিনালে লাগানো স্ক্যানিং মেশিনগুলো অত্যাধুনিক। যারা লাগেজ দেবেন সেগুলো অটো স্ক্যানিং হবে। এগুলো পুরান মেশিনগুলো থেকেও বেশি আধুনিক। আগে এয়ারক্রাফটে ঢোকার আগে চেক করতে হতো কিন্তু নতুন মেশিনে সেটি আর করতে হবে না। যাত্রীদের চলাচলের সুবিধার্থে টার্মিনালে মুভি ওয়াকার (হাঁটার জন্য চলন্ত রাস্তা) রয়েছে। আর এগুলো থাকছে পুরো টার্মিনালজুড়ে। ফলে যাত্রীকে হাঁটতে তেমন বেগ পেতে হবে না। যা থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরগুলোতে দেখা যায়।
টার্মিনালটির ভবনের যাবতীয় কার্যক্রম চালাতে দিনে কোনো বিদ্যুৎ লাগবে না। বাড়তি বাতির প্রয়োজন হবে না। এজন্য ভবনটির চারপাশে গ্লাস বসানো হয়েছে এবং ওপরের দিকে স্কাই লাইট রাখা হয়েছে, যাতে সহজে দিনের আলো আসে সেই ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান মফিদুর রহমান বলেন, এটা আমাদের জন্য একটা আশার জিনিস যে থার্ড টার্মিনাল বাস্তবে রুপ নিচ্ছে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেই আমরা এই বিমানবন্দরটি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি।
তিনি আরও জানান, এই টার্মিনাল থেকে হাইওয়ে, মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ থাকবে। শুধু তাই নয়, আন্ডারগ্রাউন্ড যে মেট্রোরেল হবে তার জন্য আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল ইতোমধ্যে তৈরি করে রেখে দেওয়া হয়েছে। টার্মিনাল থেকে বের হয়ে যাত্রীরা সব ধরনের সুবিধাই পাবেন। এছাড়াও হাজিদের কষ্ট লাঘবে হজক্যাম্প থেকে সরাসরি বিমানবন্দর আসার জন্য একটি টানেল তৈরির প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সেই কাজও খুব শিগগির শুরু হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী।
কালের আলো/বিএসবি/এমএইচএ