যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির কারণে ‘ইমেজ সংকটে’ পড়বে না পুলিশ : আইজিপি
প্রকাশিতঃ 5:12 pm | September 25, 2023

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির কারণে পুলিশ ‘ইমেজ সংকটে’ পড়বে না বলে জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেছেন, মার্কিন ভিসা রীতির কারণে পুলিশ ইমেজ (ভাবমূর্তি) সংকটে পড়বে, এমনটি আমি মনে করছি না।
সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর তোপখানা রোডে ট্যুরিস্ট পুলিশ সদর দপ্তরে এক সেমিনার শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি এসব কথা বলেন।
সাম্প্রতিক বিভিন্ন সংঘর্ষের সময় অস্ত্র প্রদর্শিত হয়েছে, অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশের তেমন কোনে তৎপরতা দেখা যায় না, জাতীয় নির্বাচনে এই অস্ত্র কোনো প্রভাব ফেলবে কি না- সাংবাদিকদের এমন এক প্রশ্নে জবাবে আইজিপি বলেন, ‘কেউই যখন কোন অস্ত্র প্রদর্শন করে, এটা নিয়ে আমরা কাজ করি। জাতীয় নির্বাচনে আমরা আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারব বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’
নির্বাচনের আগে অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ কোনো অভিযান পরিচালিত হবে কি না- সাংবাদিকের প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা যথা সময় এটা করব। তবে কৌশলগত কারণে এটা আমরা এখন বলছি না।’
ঢাকার রাজপথে প্রকাশ্যে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ভুবনের মৃত্যু, ব্যাংক থেকে পুলিশের ডাকাতি এসব ঘটনা প্রসঙ্গে আইজিপি বলেন, ‘যখনই কোন ঘটনা ঘটে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করি। পুলিশের কোনো সদস্য জড়িত থাকলে তাকেও আমরা ছাড় দেই না। প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করি।’
নির্বাচনকে সামনে রেখে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বাড়ছে, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে জানতে চাইলে আইজিপি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূন্নভাবে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সন্ত্রাসী যেই হোক কাউকে আমরা ছাড় দিচ্ছি না।’
আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন আসছে নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচনকালীন সময় কমিশন আমাদের যে দায়িত্ব দেবে সেই দায়িত্ব আমরা যথাযথভাবে পালন করব।’
এদিকে ট্যুরিস্ট পুলিশ সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সেমিনারে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, এখন আর রাত ১০টার মধ্যে পর্যটকদের হোটেলে প্রবেশের তাড়া নেই। পরিবর্তন এসেছে। বিভিন্ন আঙ্গিকে ট্যুরিস্ট পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। পর্যটকদের সেবায় ও নিরাপত্তায় বর্তমানে ট্যুরিস্ট পুলিশের ব্যাপক ভুমিকা রয়েছে।
ট্যুরিস্ট পুলিশ গঠনের পর দেশের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ২০১৩ সালে ছিল ২.৯ শতাংশ। সেখানে এখন ২০২১ সালে তা ৪.৪৪ শতাংশ হয়েছে। আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছি না, আমরা ট্যুরিস্ট পুলিশকে আরও গতিশীল করতে সেবার মান বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছি।
এদিকে, ২০১৫ সালে পর্যটন খাতে কর্মসংস্থান ছিল ১৭ লাখ, যা ২০২২ সালে হয়েছে ৪০ লাখ। ২০১৩ সালে পর্যটন থেকে রাজস্ব খাতে আয় ছিল ৬১৩ কোটি টাকা, যা ২০২১ সালের তথ্যানুযায়ী হয়েছে ২২৭৯ কোটি টাকা।
আইজিপি বলেন, ভ্রমণ পর্যটনে বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশ ২০১৭ সালে ছিল ১২৩তম অবস্থানে। সেখানে এখন হয়েছে ১০০তম দেশ। আমাদের অবস্থান এগিয়েছে। ২০১৭ সালে দেশি পর্যটক দেশি বিভিন্ন পর্যটন স্পটে ভ্রমণ করেছে এক কোটি ৩৬ লাখ। ২০২২ সালে তা হয়েছে ৪ কোটি ২৫ লাখ। ২০১৭ সালে বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছে ১ লাখ ৩৭ হাজার। ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত তা হয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার। এই বৃদ্ধিই প্রমাণ করে আমাদের পর্যটন খাত এগিয়ে যাচ্ছে।
আইজিপি বলেন, ট্যুরিস্ট পুলিশের আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। কারণ বাংলাদেশের পর্যটন খাত বিকশিত হচ্ছে। যে কারণে ট্যুরিস্ট পুলিশের ওপর দায়িত্ব ও প্রত্যাশাও বাড়ছে। তাদের আরও ট্যুরিস্ট বান্ধব হতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের আরও অনেক বেশি এগিয়ে যাওয়া দরকার। যে কেউ জাতীয় জরুরি সেবা-৯৯৯ এ ফোন করলে পুলিশ সেবা দিচ্ছে। চোরও ধরা পড়ার পর মারধর থেকে রক্ষা পেতে ৯৯৯ এ ফোন করে পুলিশের সহযোগিতা চাচ্ছে। সাগরে আটকে পড়া জেলেরাও ফোন করে উদ্ধারে সহযোগিতা নিচ্ছে। যেভাবে বিকশিত হওয়া দরকার, প্রত্যাশার সঙ্গে আমাদের সক্ষমতা ও সেবার মান বাড়ানোর চেষ্টা করছি।
ট্যুরিস্ট পুলিশ হেডকোয়ার্টারে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রফেসর ড. মো. মাসুদুর রহমান। ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে এ সময় আরও বক্তব্য দেন-টোয়াবের প্রেসিডেন্ট শিবনুল আজম কোরেশী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম বিভাগের চেয়ারম্যান সন্তোষ কুমারসহ আরও অনেকে।
সেমিনারে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাবেদ আহমেদ বলেন, ট্যুরিজম একা বিকশিত হয় না, এটা একার কারো না, এটা সবার। সবার দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু এটা বুঝতেই আমাদের অনেক সময় লেগে গেলো। প্রাইভেট সেক্টর ছাড়া যে পর্যটন খাতকে এগিয়ে নেওয়া যায় না, সেটা বুঝতেও আমাদের দেরি হয়েছে।
তিনি বলেন, ট্যুরিজমের বড় কাজ হচ্ছে প্রমোশন করা, আকৃষ্ট করা। এটা কোনো ঠুনকো ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের যে সৌন্দর্য সেটা ছড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের এখন পর্যন্ত অনেক সম্ভাবনাময় সেক্টর আছে, কিন্তু এখনও এগুলো আমরা বিশ্বের কাছে তুলেই ধরতে পারিনি।
পর্যটনের বিকাশে নিরাপত্তা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও এখনো পর্যটন শিল্পে সর্বত্র আমরা পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারিনি। এখনও পর্যটনে আগ্রহী অনেক পর্যটক নিরাপত্তা নিয়ে সন্দেহে থাকেন। আমাদের প্রমাণ করতে হবে পর্যটন স্পট ও পর্যটকের নিরাপত্তা নিশ্চিত।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ট্যুরিস্ট ব্যবস্থাপনায় হাইজিন খাবার গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীলঙ্কার ৬০ শতাংশ আয় পর্যটন খাতে। করোনাকালে তাদের সংকট তৈরি করেছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ নতুন করে পর্যটনখাতে বৈশ্বিকভাবে ঝুঁকি তৈরি করেছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকেই যাচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংক্রান্ত ঝুঁকিতে।
যে কোনো ঝুঁকিতে পর্যটনখাতে একটা প্রভাব আছে। ঝুঁকিগুলো পর্যটকদের মধ্যে সরাসরি প্রভাব ফেলে। যেকোনো রিস্ক ব্যবসায় সমস্যা তৈরি করে। হলি আর্টিসান হামলার পরে কিন্তু হোটেল, হসপিটালিটি, রেন্ট সার্ভিস, বিদেশি পর্যটক আসাসহ সার্বিক পর্যটনখাতে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন করেছিল যার প্রভাব এখনো রয়ে গেছে।
আরেকটি হচ্ছে, প্রাইভেট ট্রান্সপোর্ট সার্ভিস। পলিটিক্যাল, রিলিজিয়ন প্রভাব পড়ে পর্যটন খাতে। ঝুঁকির কারণে ইমেজ সংকট তৈরি করে। অথচ অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কিন্তু ইমেজ তৈরি করতে হয়। অথচ ধ্বংস হতে একটি সমস্যা বা রিস্কই যথেষ্ট। সোসাইটিতে নেগেটিভ আউটপুট আসে। ব্যক্তিখাতের নেতৃত্বেই থাকা দরকার পর্যটন খাত। কিন্তু সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ থাকা উচিত। সরকার যত রেগুলেটরি বডি তৈরি করে, তত খরচা বেড়ে যায়। যত বেশি রুলস, রেগুলেটরি তৈরি হবে খরচও বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, পর্যটনখাতে অনেক স্টেকহোল্ডার জড়িত। ৩০-৩২ টি সরকারি সার্ভিস পর্যটনখাতে জড়িত। পর্যটনখাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। পুলিশের প্রতি নির্ভরতা যেমন সবচেয়ে বেশি, তেমনী তাদের প্রতি নজর বেশি, পর্যটন খাতে এমন অনেক বিষয় আছে যেখানে ট্যুরিস্ট পুলিশের কিছু করার থাকে না।
বাংলাদেশ ট্যুুরিজম বোর্ডের পরিচালক (যুগ্মসচিব) শাহ আবদুল আলীম খান বলেন, আমরা যদি পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সেবা নিশ্চিত করতে চাই, দেশে যদি বিশ্বমানের পর্যটন ব্যবস্থা গড়তে চাই তাহলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেটা পুলিশ করছে। পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে ট্যুরিস্ট পুলিশের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের জনবল বাড়ানোর অনুরোধ জানান তিনি।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি শিবলুল আজম কোরেশী বলেন, ট্যুরিস্ট পুলিশের যাত্রাই শুরু হয়েছে দেরিতে, তাও সীমিত জনবলে। পর্যটনখাতে নিরাপত্তায় নিয়োজিত ট্যুরিস্ট পুলিশকে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা আরও বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।
কালের আলো/এনএল/ডিএস