ত্যাগের সমুদ্রে সৈনিক জীবনের তরী; সেনাপ্রধানের স্মরণের আলোয় চিরঞ্জীব সেনা বীর

প্রকাশিতঃ 9:51 pm | March 02, 2023

এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটরকালের আলো:

দায়িত্ব পালন করতে প্রতিমুহূর্ত মৃত্যু ঝুঁকি। সুশৃঙ্খল, গৌরবময় ও কর্মময় জীবনে নির্ভীক ও আপসহীন একেকজন সেনারা। মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় ধ্রুব সত্য জেনেও চোখজোড়া স্বপ্ন আর বুকে প্রত্যয়। একই সঙ্গে তাঁরা যোদ্ধা এবং শান্তির প্রবক্তা। বিশ্বময় অধরা নীলাকাশজুড়ে একেকজন সেনা সদস্য ছড়িয়ে দেন নিজের কর্মের দ্যুতি। ত্যাগের সমুদ্রে ভাসান সৈনিক জীবনের তরী।

অনেক ঝড়ঝঞ্ঝায় ভরা কঠিন এক লড়াইয়ের জীবনে ফলত সেনাবাহিনীর চাকরিকে চাকরি নয়, ‘জীবন যাত্রা’ বলেই মনে করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। সৈনিকের অনিত্য জীবনের দৈনন্দিনতায় আলোকরেখার সঞ্চার করেই বললেন, ‘সেনাবাহিনীতে আমরা যখন যোগদান করি আমরা জীবন উৎসর্গ করার ব্রত নিয়েই যোগদান করি।’ সেনাপ্রধানের চোখে দেশে ও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনকালে জীবন উৎসর্গকারী প্রতিটি সেনা সদস্য একেকজন বীর। চিরঞ্জীব বীরদের প্রকারান্তরে এই গুণীদের কদরের মাধ্যমেই স্মরণের আলোয় উপস্থাপন করেছেন জেনারেল শফিউদ্দিন।

সেনাবাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় দেশে ও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনকালে জীবন উৎসর্গকারী সেনাদের পরিবারের পাশে বরাবরই গভীর মমত্ববোধ আর ভালোবাসার নির্যাসে অভিভাবকত্বের ছায়ায় পাশে দাঁড়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ব্যতিক্রম ছিল না বৃহস্পতিবারও (২ মার্চ)। এদিন দুপুরে সাভারে আশুলিয়ার পাথালিয়া ইউনিয়নের খেজুরটেক সেনাপল্লীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অর্থায়নে নির্মিত ‘আস্থানীড়’ প্রকল্পের আওতায় জীবন দেওয়া পরিবারসমূহের মাঝে ২০ টি ফ্ল্যাট হস্তান্তর অনুষ্ঠানে নিজ বাহিনীর দায়িত্বশীল সদস্যদের সৎনিষ্ঠ চেতনাবোধকেই পুনরায় প্রজ্বলিত করেন সেনাপ্রধান।

এ সময় তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় দেশে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন ও পার্বত্য চট্টগ্রামে আভিযানিক ও সক্রিয় দায়িত্ব পালনকালে জীবন উৎসর্গকারী সেনাসদস্যদের পরিবারের উত্তরাধিকারীদের মাঝে ফ্ল্যাট হস্তান্তর সেনাসদস্যদের কল্যাণার্থে নি:সন্দেহে যুগোপযোগী, কল্যাণকর ও মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা তথা বাসস্থান সমস্যা নিরসনে একটি বৃহৎ এবং কল্যাণমুখী উদ্যোগ। সেনাসদস্যদের পরিবার যাতে সুখী, সমৃদ্ধ, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারেন, সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ফ্ল্যাট প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।’

বেদনার বিষাদকাব্যেও প্রবল সাহস, সততা ও আত্নপ্রত্যয়ের মধ্যদিয়ে লড়াকু সেনাজীবনে ভুবন জয় করা এক চিরসত্যকেও মোটাদাগে উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। বলে চলেন মানবতার জয়গান। সেনাপ্রধান দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, যখন মানুষ ভালো কাজের প্রতিদান পাবে তখন অবশ্যই তারা ভালো কাজে উৎসাহিত হবে।

তিনি বলেন, ‘গুণীদের গুণগান না গাইলে গুণী তৈরি হয় না। যে বীররা আমাদের জন্য জীবন উৎসর্গ করে গেছেন তাদেরকে আমাদের মনে রাখতে হবে। দেশের জন্য ও আমাদের অর্গানাইজেশনের জন্য যারা প্রাণ উৎসর্গ করবে তাদের জন্য অবশ্যই আমাদের কিছু করতে হবে। আমরা সবসময় চেষ্টা করি যেভাবে পারি আমাদের সীমাবদ্ধতার ভেতর থেকেও কর্তব্যরত অবস্থায় যারা শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার। সেখানে আজ একটা নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। আমরা আজ ২০ টি পরিবারকে সারাজীবনের জন্য একটা করে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করতে পারলাম।’

শফিউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘যিনি শহীদ হয়েছেন তিনি আর আসবেন না। আমরা চাই তার পরিবার যেন সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে, তার সন্তানরা যেন পড়ালেখা করে মানুষ হতে পারে। একইসঙ্গে তাদের সন্তানরা যেন ভবিষ্যতে তার পিতার অর্জনকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এমন একটা কাজ করতে পেরে আমরা সত্যিই আনন্দিত। আশা করছি আমরা ভবিষ্যতে আরও ভালো কাজ করতে পারব।’

ফায়ারিং প্রতিযোগিতা অনুপ্রেরণার উৎস
একই দিনে ৯ পদাতিক ডিভিশন সদর দপ্তরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে সাভার সেনানিবাসের ক্ষুদ্রাস্ত্র ফায়ারিং রেঞ্জে চলতি বছরের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ফায়ারিং প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী ও সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ।

প্রশিক্ষণের উপর গুরুত্বারোপ করে এ সময় তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনীর পেশাগত উৎকর্ষতা অর্জনের জন্য ফায়ারিং এ দক্ষতা অত্যন্ত জরুরী। ফায়ারিং অনুশীলন সেনাবাহিনীর মৌলিক প্রশিক্ষণের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের মান উন্নয়নে এই ফায়ারিং প্রতিযোগিতা অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করবে’।

আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সদর দপ্তর ৯ পদাতিক ডিভিশনের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত এই ফায়ারিং প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সকল ফরমেশনসহ লজিষ্টিকস্ এরিয়া ও ৫টি স্বতন্ত্র ব্রিগেড এবং প্যারা কমান্ডো ব্রিগেডসহ সর্বমোট ১৭টি দল এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ফায়ারিং প্রতিযোগিতায় সেনাবাহিনীর ৩৩ পদাতিক ডিভিশন চ্যাম্পিয়ন ও ৫৫ পদাতিক ডিভিশন রানারআপ হওয়ার গৌরব অর্জন করে। এই প্রতিযোগিতায় ১০ পদাতিক ডিভিশনের কর্পোরাল মো. হযরত আলী শ্রেষ্ঠ ফায়ারার এবং ২৪ পদাতিক ডিভিশনের সৈনিক আশিক হোসেন দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ফায়ারার হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।

পরে সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ সাভারের বাইপাইল এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) এর ট্রেনিং একাডেমিতে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ক্যাম্পিং’র সমাপনী কুচকাওয়াজের অভিবাদন গ্রহণ করেন ও বিএনসিসি ক্যাডেটদের মনোমুগ্ধকর ডিসপ্লে প্রদর্শনী অবলোকন করেন। তিনি শ্রেষ্ঠ ক্যাডেট ও রেজিমেন্টকে পুরস্কার প্রদান করেন। গত ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া প্রশিক্ষণে সেনা, নৌ ও বিমান শাখার মোট ৬০০ ক্যাডেট অংশগ্রহণ করেন। তাদের ড্রিল, অস্ত্র প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন সামরিক ও অসামরিক বিষয়াবলীর ওপরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সেনাপ্রধান বলেন, ‘প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিএনসিসির ক্যাডেটরা নিজেদের আরো সমৃদ্ধ করবে, যা তাদের দেশসেবার কাজে লাগবে।’ এ সময় করোনাকালীন সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দেশের জনগণের জন্য খাদ্য, চিকিৎসাসহ নানাবিধ সহযোগিতার জন্য বিএনসিসির সদস্যদের কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানান।

প্রতিটি অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) লেফটেন্যান্ট জেনারেল আতাউল হাকিম সারওয়ার হাসান, সেনা সদর দপ্তরের অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল (এজি) মেজর জেনারেল মো. নজরুল ইসলাম, নবম পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) ও সাভারের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মোহাম্মদ শাহীনুল হক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

কালের আলো/এমএএএমকে

Print Friendly, PDF & Email