উগ্রবাদ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ৯ তরুণ-তরুণী, র্যাবের আরও একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ
প্রকাশিতঃ 10:40 pm | January 02, 2023

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:
কথিত হিজরতের নামে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন তাজকিয়া তাবাসসুম। ছেড়েছিলেন ঘর। তাঁর ভ্রান্ত পথেই সঙ্গী হয়েছিলেন আরও আট তরুণ-তরুণী। বান্দরবানে প্রশিক্ষণ নিতেও যাত্রা করেছিলেন। বিপর্যস্ত হয়েছিলেন মানসিকভাবে। বিদায়ী বছরের ২২ ডিসেম্বর তাদের উদ্ধার করে র্যাব। ওদের বাড়ি ছাড়ার পেছনে ধর্মের অপব্যাখ্যা ও ভুল ধারণা সম্পর্কে র্যাব বোঝালে তাজকিয়ারা সুপথে ফিরতে উদ্বুদ্ধ হয়।
সোমবার (০২ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কুর্মিটোলায় র্যাব সদর দপ্তরে ‘নব দিগন্তের পথে’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হিজরতে বের হওয়া নয় তরুণ-তরুণীকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন প্রধান অতিথি র্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) অতিরিক্ত আইজিপি এম খুরশীদ হোসেন। তিনি আলোর পথে ফেরা তাজকিয়া তাবাসসুম, আবু বকর সিদ্দিক, ফয়সাল হোসেন, মো. ফারুক হোসেন, মো. আলিফ খান, মুফলিয়া আক্তার, জান্নাতুল ফেরদৌস, রুনা আক্তার ও কানিজ ফাতিমা ইফতিকে আলাদা আলাদাভাবে দশ হাজার টাকা, বই ও ফুলের তোড়া উপহার দেন।
মূলত ‘ডি-রেডিক্যালাইজেশন’র মাধ্যমে সন্ত্রাস ও চরমপন্থার জীবন পরিত্যাগ করে সিদ্দিক ও আলিফদের শান্তির ধারায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয় র্যাব ফোর্সেস। র্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) অতিরিক্ত আইজিপি এম খুরশীদ হোসেনের নেতৃত্বের ৩ মাসের মাথায় যুগান্তকারী এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়েছে।
র্যাব সদর দপ্তর মনে করে, কেবলমাত্র আইনের আওতায় এনেই জঙ্গিবাদ নির্মূল করা সম্ভব নয়। এজন্যই ‘ডি-রেডিক্যালাইজেশন’র থিওরি প্রয়োগ করছে র্যাব। উগ্রবাদীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে ডি-রেডিক্যালাইজেশনের কোন বিকল্প নেই। নতুন এই উদ্যোগের মাধ্যমে র্যাব পথভ্রষ্টদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। তাদের সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে এনে বিভিন্ন পুনর্বাসন কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের সন্ত্রাসবিরোধী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

জানা যায়, জঙ্গিবাদের ভয়াল থাবার কবল থেকে দেশ ও জাতিকে সুরক্ষায় বুক চিতিয়ে লড়াই করছে অতিরিক্ত আইজিপি এম খুরশীদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন র্যাব। উগ্রবাদের অন্ধকার অধ্যায় থেকে আলোর পথে ফিরিয়ে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন উপহার দেওয়ার ফর্মুলাও র্যাবের অনবদ্য এক সৃষ্টি। এক অলৌকিক ঐশ্বর্য নিয়েই নিজেদের মেধা, শ্রম ও পরিশ্রমের মিশেলে সত্যের উজ্জ্বল প্রভা পথভ্রষ্টদের মাঝে যেন সঞ্চারিত করেছে র্যাব ফোর্সেস।
র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান জুয়েলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি, অপারেশনস) কর্নেল কামরুল হাসান ও এডিজি (প্রশাসন) ইমতিয়াজ আহমেদ। বিশেষ আলোচক ছিলেন মুফতি মানসুর আহমাদ।
র্যাব জানায়, জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরতে ‘জঙ্গিবাদীদের অপব্যাখ্যা এবং পবিত্র কুরআনের সংশ্লিষ্ট আয়াত ও হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যা’ সম্বলিত একটি বই প্রকাশ করেছে র্যাব। বইটি জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণায় বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।

গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের
সারাবিশ্বে অনেকেই ধর্মের অপব্যাখায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মধ্যপন্থা থেকে সরে এসে উগ্রবাদী চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি, অপরারেশন) কামরুল হাসান। তিনি বলেন, তারা অরাজকতা, বিশৃঙ্খলার মতো কাজ করছে। র্যাব এ ধরনের অরাজকতা এড়ানোর জন্য কাজ করছে।’
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিভিন্ন প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত করেন র্যাবের এই র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক। এ সময় ‘নিশ্চয় দ্বীন সহজ। দ্বীন নিয়ে যে বাড়াবাড়ি করে সে কখনও জয়ী হতে পারে না। কাজেই তোমরা মধ্যপন্থা অবলম্বন করো, মধ্যপন্থার নিকটে থাকো’ – মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর এই বাণী উল্লেখ করেন তিনি।
‘র্যাব বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী, তাদের নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসছে’ জানিয়ে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘২০১৬ সালে হলিআর্টিজান হামলার পর জঙ্গিদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে জঙ্গিবাদ স্থবির হয়ে যায়। অভিযানের পাশাপাশি যারা বিভিন্নভাবে বিভ্রান্ত হয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে তাদেরকে ডিরেডিক্যালাইজেশনের মাধ্যমে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করি। যাতে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসতে পারে।’

এই ধারাকে বেগবান করতে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী র্যাব ডি-রেডিক্যালাইজেশন শুরু করে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ২০ জনকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছি। তাদের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখি, যাতে তারা কোনোভাবে পূর্বের যে ভ্রান্ত ধারণা ছিল, সেটিকে পুনরুজ্জীবন করতে না পারে।’
‘অভিযান আমাদের সামগ্রিক কার্যক্রমের একটি ক্ষুদ্র অংশ’ উল্লেখ করে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, ‘যাদেরকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিচ্ছি তাদেরকে বলব, ব্যক্তিগতভাবে আমরা একজন ব্যক্তি হতে পারি কিন্তু পরিবারের কাছে আমরা কিন্তু গোটা পৃথিবী। পিতার কাছে একজন সন্তান, স্বামীর কাছে স্ত্রী বা স্ত্রীর কাছে স্বামী অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এবিষয় মাথায় রেখে আমরা যদি পরিবারের কাছে থাকতাম তাহলে কখনো ভুল ধারণায় বিপথগামী হতাম না।’
প্রক্রিয়াগতভাবে সমূলে জঙ্গি উৎখাত, বললেন র্যাব ডিজি
‘ডি-রেডিক্যালাইজেশন হল উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ ব্যক্তিকে চরমপন্থা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা ও সামগ্রিকভাবে সহনীয় নীতি বা মধ্যমপন্থায় উদ্বুদ্ধ করার প্রক্রিয়া’ বলে মন্তব্য করেছেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি র্যাবের মহপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘দেশকে জঙ্গিমুক্ত করতে সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি, নির্দেশনা ও আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করে থাকে। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী কঠোর অবস্থান তৈরি হয়। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে উগ্রবাদীদের সক্ষমতা কমে যায়। এমতাবস্থায়, জঙ্গিরা স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে না।

গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে বেড়ায়, সহিংসতার উপকরণ সংগ্রহ করাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তারা ফেরারী জীবনের অবসাদ থেকে বিষণ্নতায় ভোগে ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। এভাবে ধীরে ধীরে জঙ্গিদের সক্ষমতা; শক্তি, জনবল হ্রাস পেতে থাকে। এরপর জঙ্গিদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি আত্মসমর্পণের সুযোগ করে দেওয়া হয়। এভাবে প্রক্রিয়াগতভাবে সমূলে জঙ্গি উৎখাত করা হয়।’
র্যাব মহাপরিচালক বলেন, ২২ ডিসেম্বর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৯ জন তরুণ-তরুণী ধর্মের ভুল ব্যাখ্যায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কথিত হিজরতের জন্য একযোগে গৃহত্যাগ করেছিলেন। এ বিষয়ে তাদের পরিবার সংশ্লিষ্ট থানায় জিডি করেন। এই তথ্যের ভিত্তিতে র্যাবের গোয়েন্দা শাখা, র্যাব-৭ ও র্যাব-৮ এর সহযোগিতায় গত ২৫ ডিসেম্বর তাদের র্যাবের হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ সময় বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য কাউন্সেলিং করা হয়। কাউন্সেলিং এ তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। তারা ধর্মের ভুল ব্যাখ্যায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কথিত হিজরতের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একযোগে গৃহত্যাগ করেছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মুসলিম নারী ও শিশুদের নির্যাতনের ভিডিও ও ছবি দেখে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হন। তারা ভিডিও এবং ছবির লিংকগুলো তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ারের পাশাপাশি লাইক ও কমেন্ট করতেন। এদের মধ্যে একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা ওসব ভিডিও ও ছবি শেয়ার ও কমেন্ট করতের তাদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতের। যারা তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করতেন তাদের নিয়ে ‘দুনিয়া কিয়ে মুসাফির’ নামে আরেকটি মেসেঞ্জার গ্রুপ খুলে। ওই গ্রুপে মোট ৯ জন সদস্য ছিলো। তার মধ্যে ৪ জন পুরুষ ও ৫ জন নারী।’

র্যাব ডিজি বলেন, ‘তারা বিভিন্ন ইসলামিক ভিডিও পোস্ট করতেন এবং বিভিন্ন লেখকের বই ডাউনলোড করে গ্রুপে দিতেন। পরবর্তীতে অ্যাডমিন মাঝে মাঝে তাদের পড়াশোনার বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেন। একপর্যায়ে তাদের নির্বিঘ্নে ধর্ম পালন করতে হলে সব ফেৎনা থেকে দূরে সরে গিয়ে পাহাড়ি এলাকায় নিরিবিলি পরিবেশে যেতে হবে এবং সেখানে গিয়ে ধর্ম পালন করার নির্দেশ কোরআন ও হাদিসে আছে মর্মে ধর্মীয় ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করতেন। ৯ জন সদস্যই হিজরত করার বিষয়ে একমত পোষণ করেন। তখন তারা গুগল ম্যাপ বিশ্লেষণ করে রাঙ্গামাটি পাহাড়ি এলাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেই অনুযায়ী তারা গত ২২ ডিসেম্বর বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৩ ডিসেম্বর তারা চট্টগ্রামের একটি স্থানে একত্রিত হন। সেখান থেকে ওইদিনই বাসে করে রাঙ্গামাটি যান এবং সেখানে গিয়ে লোক সমাগম দেখে তারা হিজরতের জন্য অনুকূল কোন স্থান না পেয়ে চট্টগ্রামে ফেরত আসেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পরদিন তারা সবাই বান্দরবান গিয়েও সুবিধাজনক স্থান না পেয়ে একই দিন আবারো চট্টগ্রাম ফেরত আসেন। সুবিধাজনক স্থান না পাওয়ায় চট্টগ্রাম এসে তারা পরবর্তীতে কি করবে সে বিষয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। ইতোমধ্যে একজন নারী সদস্য অসুস্থ হয়ে পড়লে তারা স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করান। এ সময় গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম থেকে তাদের র্যাব হেফাজতে নেওয়া হয়।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে র্যাব ডিজি বলেন, ‘শীর্ষ জঙ্গিদের আইনের আওতায় আনার মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে র্যাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ২০১৬ সালের হলি আর্টিজানে হামলা, আশুলিয়ার জঙ্গিবিরোধী অভিযান, ২০১৭ সালে সিলেটের আতিয়া মহল, মিরপুরের জঙ্গিবিরোধী অভিযান এবং ২০১৯ সালে মোহাম্মদপুরের জঙ্গিবিরোধী অভিযান উল্লেখযোগ্য।’

কালের আলো/জিকেএম/এমএএএমকে