নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের আবেদন করলো কারা?

প্রকাশিতঃ 10:46 am | November 10, 2022

আমীন আল রশীদ

আমীন আল রশীদ :

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য যে ৯৮টি দল আবেদন করেছে, তার মধ্যে কয়েকটি দলের নাম অদ্ভুত; যেমন মুসকিল লীগ, বাংলাদেশ ইত্যাদি পার্টি, বৈরাবরী পার্টি, নাকফুল বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বেকার সমাজ (বাবেস), বাংলাদেশ গরীব পার্টি, বাংলাদেশ সৎ সংগ্রামী ভোটার পার্টি ইত্যাদি।

প্রশ্ন হলো, যে দলের নাম মুসকিল পার্টি, তারা নিবন্ধন পেলেই বা কী করবে? তারা রাজনীতিতে মুসকিলের জন্ম দেবে না ‘আহসান’ করবে? ‘বৈরাবরী’ শব্দের অর্থ বাংলা একাডেমির অভিধানে খুঁজে পাওয়া গেলো না। এর অর্থ কী বা এটি কোন ভাষার শব্দ? একটি রাজনৈতিক দলের নাকফুল হয় কী করে? ইত্যাদি পার্টি একটি দলের নাম হতে পারে? বাংলাদেশ হিন্দু লীগ নামেও একটি দল নিবন্ধন চেয়েছে। মুসলিম লীগ থাকলে হিন্দু লীগও নিশ্চয়ই থাকতে পারে।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, বৈরাবৈরী পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় উল্লেখ করা হয়েছে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার আজগানা ইউনিয়নের কুঁড়িপাড়া গ্রাম। কিন্তু কার্যালয় তো দূরে থাক, ওই গ্রামের কেউই এই নামে কোনও দল আছে তা কখনও শোনেননি। একইভাবে নৈতিক সমাজ নামে একটি কথিত পার্টির অফিসের ঠিকানা রাজধানীর পুরানা পল্টন। কিন্তু ওই ভবনের নিরাপত্তারক্ষীই জানেন না এই ভবনে এই নামে কোনও পার্টির কার্যালয় আছে।

বাংলাদেশ বিদেশ প্রত্যাগত প্রবাসী ও নন-প্রবাসী কল্যাণ পার্টির ঠিকানা ৮৫/১, নয়াপল্টন। কিন্তু এখানে কে কখন আসেন বা যান, তা পাশের ফ্ল্যাটের কেউ জানেন না। বরং এই ফ্ল্যাটে বিদেশ ফেরতদের টাকা পয়সা নিয়ে অনেক ঝামেলার কথা শুনেছেন প্রতিবেশীরা। বাংলাদেশ আমজনতা পার্টি আবেদনে তাদের ঠিকানা দিয়েছে ঢাকার ২০৫, বিজয় নগর। এই ঠিকানায়ও কোনও দলের কার্যালয় নেই।

আশপাশের লোকজনও এমন কোনও দলের কথা জানেন না। বাংলাদেশ জনমত পার্টিরও একই অবস্থা। পরিচিত লোকের ভবন দলের ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করলেও এমন কোনও দলের কার্যালয় নেই রাজধানীর তোপখানা রোডের ২৭/৮-এ তৃতীয় তলায়। নেই কোনও সাইনবোর্ডও। (ঢাকা মেইল, ২ নভেম্বর ২০২২)।

পুরোনো ঢাকার কোর্ট হাউজ সড়কের ২৭ নম্বর বাড়ির নিচতলায় মুদি ও স্টেশনারি দোকান। ষষ্ঠতলায় একটি কক্ষে বাড়িটির তত্ত্বাবধায়ক পরিবার নিয়ে বাস করেন। আরেক কক্ষে দুটি টেবিল, চারটি চেয়ার, আলমারি ও বুকশেলফ। এই কক্ষটিই বাংলাদেশ ন্যাশনাল গ্রিন পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। যদিও ভবনের অন্য বাসিন্দারা এই দল সম্পর্কে কিছুই জানেন না।

বাংলাদেশ ডেমোক্র্যাসি মুভমেন্ট নামে নিবন্ধনপ্রত্যাশী আরেকটি দলের কার্যালয়ের ঠিকানা রাজধানীর মিরপুর সেকশন ৬/বি, লেন ১, বাড়ি নম্বর ২৪। কিন্তু এখানে কোনও রাজনৈতিক দলের কার্যালয় আছে বলে জানেন না স্থানীয়রা। কখনও এখানে কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচিও কারও চোখে পড়েনি। (সমকাল, ৪ নভেম্বর ২০২২)।

এরকম ঠিকানাবিহীন বা নাম না জানা অনেক দলও এবার নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। সম্ভবত তারা নিজেরাও জানে যে তারা নিবন্ধন পাবে না। কিন্তু তারপরও কেন এই তৎপরতা? রাজনীতি বা রাজনৈতিক দল গঠন করে নিবন্ধন চাওয়া কিংবা নির্বাচন কি একটি খেলা কিংবা কৌতুকের বিষয়? যে রাজনীতিই হচ্ছে দেশ পরিচালনার হাতিয়ার, সেই রাজনীতি নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় মানুষ যে রসিকতা করছে; নিবন্ধন চেয়ে আবেদনকারী অদ্ভুত সব দল নিয়ে মানুষ যে হাসাহাসি করছে, সেটি কি সামগ্রিকভাবে রাজনীতিকেই খাটো করছে না? রাজনীতিকে যারা এভাবে খাটো করা বা প্রশ্ন করার উপলক্ষ তৈরি করে দিলেন, তারা কারা? তাদের উদ্দেশ্য কী?

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের বিধান অনুযায়ী, নিবন্ধন পেতে হলে আবেদনকারী দলকে অতীতের যেকোনও একটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে অন্তত একটি আসন পেতে হবে; অথবা যেকোনও নির্বাচনের একটিতে পাঁচ শতাংশ ভোট পেতে হবে; অথবা দেশের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ জেলা (২১টি) ও ১০০ উপজেলা বা থানা পর্যায়ে দলের কমিটি ও কার্যালয় থাকতে হবে। কিন্তু এবার যে ৯৮টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে, তাদের মধ্যে কতগুলো দলের অন্তত ২১টি জেলা ও ১০০ উপজেলা বা থানায় কমিটি ও কার্যালয় আছে? বাস্তবতা হলো, যারা আবেদন করেছে, তাদের মধ্যে এমনও অনেক দল হয়তো পাওয়া যাবে যাদের নেতাকর্মী ও সমর্থকের সংখ্যা সর্বমোট ১০০ হবে না।

এবার যেসব দল নিবন্ধনের আবেদন করেছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি সম্প্রতি রাজনৈতিক মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কেননা, দলটি জামায়াতের লোকেরা গঠন করেছেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। যেহেতু জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে, তাই তারা নতুন দল গঠন করেছেন। এরইমধ্যে নানা ফোরামে দলটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। অনেকেই এই দলকে নতুন বোতলে পুরোনো মদের সঙ্গে তুলনা করছেন। যদিও দলটির নেতারা দাবি করছেন, এই দল যারা গঠন করেছেন তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের পরের প্রজন্ম এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড তারা সমর্থন করেন না। যদিও এই দলটি শেষ পর্যন্ত জামায়াতের ছায়া থেকে কতটুকু বের হয়ে আসতে পারবে, তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান।

সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে গড়ে ওঠা ‘ছাত্র অধিকার পরিষদ’-এর নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নুরুল হক নুর, যার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ‘ছাত্র অধিকার পরিষদ’-এর নামের সঙ্গে মিল রেখে গণঅধিকার পরিষদ গঠন করেন প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া। এই দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী— যিনি সরাসরি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও নানা ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করেন। ভাসানী অনুসারী পরিষদ নামে যে সংগঠনের তিনি চেয়ারম্যান, সেটিও এবার নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। আওয়ামী লীগের ডাকসাইটে নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যকে নিবন্ধন দেওয়া হলেও পরে তা বাতিল করা হয়। এবারও তিনি নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছেন।

যদিও অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, যে ৯৮টি বা তারও বেশি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে, তাদের অধিকাংশই নিবন্ধন পাবে না। সর্বশেষ একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ৭৬টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। নিবন্ধন পায় মাত্র দুটি দল। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নিবন্ধন পায় মাত্র তিনটি দল। অথচ আবেদন করেছিল ৪৩টি দল। আর ২০০৮ সালে দেশে প্রথমবারের মতো যখন দলগুলোকে নিবন্ধন দেওয়া শুরু হয়, তখন আবেদন করেছিল ১১৭টি দল। নিবন্ধন পায় ৩৯টি দল।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে নিবন্ধন পায় বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএল, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট (মুক্তিজোট) এবং বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ। এরপর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে ২০১৯ সালে নিবন্ধন পায় দুটি দল জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম এবং বাংলাদেশ কংগ্রেস। যদিও রাজপথ এবং টেলিভিশনের টকশোতে অংশ নিয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে পরিচিত ও আলোচিত জোনায়েদ সাকির দল গণসংহতি আন্দোলন নিবন্ধনের জন্য বছরের পর বছর নির্বাচন কমিশনে ঘুরছে। তাদের নিবন্ধনের বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।

সবশেষ গত ৮ আগস্ট সাতটি দলের সমন্বয়ে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ নামে একটি নতুন জোটের আত্মপ্রকাশ হয়। জোটভুক্ত দলগুলো হলো, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। এরমধ্যে গণসংহতি আন্দোলনের নিবন্ধনের বিষয়টি আদালতে রয়েছে। বাকি চারটি দল এবার নিবন্ধনের আবেদন করেছে।

সেই ধারাবাহিকতায় ধরে নেওয়া যায় যে এবারও আবেদনকারী ৯৮টি দলের অধিকাংশই নিবন্ধিত হতে পারবে না। কিছু দল হয়তো নামের কারণেই বাদ পড়ে যাবে (যদিও নিবন্ধিত হওয়ার জন্য সুন্দর নাম বাধ্যতামূলক নয়)। তবে অধিকাংশই বাতিল হয়ে যাবে শর্ত পূরণের ব্যর্থতায়। ইসির কর্মকর্তারা নিশ্চয়ই আবেদনকারী দলগুলোর ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নেবেন। তারা অন্তত কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং ঢাকার বাইরে একাধিক জায়গায় দলগুলোর ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেবেন। কিন্তু যখনই দেখা যাবে যে এদের কার্যালয়ই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তখন অন্য বিষয়গুলো হয়তো আর অনুসন্ধানের প্রয়োজন হবে না।

রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন যেহেতু রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ফলে প্রতিটি দলের ব্যাপারে সরকারের অন্যান্য সংস্থাও খোঁজ খবর নেবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যাদের ব্যাপারে ক্লিয়ারেন্স দেবে না, তাদের পক্ষেও নিবন্ধন পাওয়া কঠিন হবে।

সর্বোপরি, নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন কারা পাবে বা পাবে না, সেখানে ক্ষমতাসীন দলেরও কিছু ভূমিকা থাকে। অর্থাৎ তারা যদি না চায় তাহলে সেই দলের পক্ষেও নিবন্ধন পাওয়া বেশ কঠিন। ফলে যে ৯৮টি দল নিবন্ধনের আবেদন করলো, তাদের মধ্যে শেষমেশ কতটি দল নিবন্ধন পাবে, বিশেষ করে সরকারবিরোধী দল হিসেবে পরিচিত নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ কিংবা বিডিপির মতো দলগুলোর ভাগ্যে কী জোটে—সেটি জানতে হলে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। সেইসঙ্গে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার এবং ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন নিয়ে রাজনীতির মাঠ যেভাবে এরইমধ্যে গরম হয়ে গেছে, সেখানে নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের ইস্যুটিও নতুন কোনও মাত্রা যোগ করবে কিনা—সেটি দেখার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, যাবতীয় তথ‌্য যাচাই-বাছাই করে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নতুন দলের নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করবে নির্বাচন কমিশন।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

Print Friendly, PDF & Email