বাংলাদেশে ভয়াবহ সেই রাজনৈতিক শক্তি এখনও রয়ে গেছে : নওফেল
প্রকাশিতঃ 12:11 pm | August 20, 2022

চট্রগ্রাম প্রতিনিধি, কালের আলো:
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেছেন, বাংলাদেশে সেই ভয়াবহ রাজনৈতিক শক্তি এখনও রয়ে গেছে, যারা আমাদের জননেত্রী শেখ হাসিনাকে বোমা মেরে হত্যা করতে চেয়েছিল, যারা আমাদের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। সংখ্যালঘু শব্দটা আমি কখনোই বলতে চাই না, কারণ তারাই সংখ্যালঘু যারা বাংলাদেশের আদর্শকে মানে না, ধারণ করে না। আমরা নানা ধর্মের অনুসারীরা আমরা এই বাংলাদেশে আছি।
শুক্রবার (১৯ আগস্ট) রাতে চট্টগ্রাম নগরীর জে এম সেন হল প্রাঙ্গনে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় আয়োজন জন্মাষ্টমী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত এক ধর্ম সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে উপমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র দিয়ে গেছেন। কিন্তু যারা এই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছে, তাদের অজ্ঞতা এবং মূর্খতা এতটাই বেশি যে, তারা জানে না- নবী হযরত মুহম্মদ আরব দেশকে কিন্তু নিজেই ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেননি। ধর্মীয় রাষ্ট্রের চিন্তা ইসলাম ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও কখনো গ্রহণযোগ্য নয়, এটা মওদুদীবাদের সৃষ্টি। মানুষ ধর্মের অনুসারী হয়, কিন্তু রাষ্ট্র কোনো ধর্মের অনুসারী হতে পারে না। রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারে না। রাষ্ট্র তো নামাজ পড়তে পারে না বা পূজা করতে পারে না। রাষ্ট্র তো গীর্জায় যেতে পারে না। রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তি না, রাষ্ট্র একটা প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের মানুষের ধর্ম থাকবে, নিজ নিজ ধর্ম তারা পালন করবে।’
‘মওদুদীবাদী এবং উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো শরিয়তি আইন সমাজে সবার জন্য চাপিয়ে দেওয়ার রাজনীতি করে। তারা জঙ্গিবাদকে সহানুভূতি দিয়ে বাংলাদেশকে নিমজ্জিত করার কুপরিকল্পনা করে। এ জন্য অস্ত্র, বোমা একসময় রাষ্ট্রীয়ভাবে জঙ্গিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। আমরা সবাই জানি- দশ ট্রাক অস্ত্র ভারতে পাচারের জন্য নেওয়া হচ্ছিল, এর সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, সেই লোকগুলো তো এখনও বেঁচে আছে। তারা যে রাজনীতির ধারায় ছিল, এখনও সেটাতেই আছে। তাদের সঙ্গে আমাদের যে যুদ্ধ, এটি চলমান আছে।’
তিনি বলেন, ‘আদালত অঙ্গনেও নানাভাবে এই অপশক্তির পদচারণা আমরা দেখেছি। আদালত থেকে বিভিন্ন আলোচনা আমরা শুনছি, রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্য এটা অনেক চিন্তার বিষয়। কারণ তারা (অপশক্তি) সেখানেও নানাভাবে ঢুকে গেছে। সরকারের বাহিনী, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও তারা ঢুকে গেছে। সেজন্য আমাদের সজাগ থাকতে হবে, ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সাংগঠনিক ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকতে পারে, কিন্তু কঠিন সময়ে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা সংগঠনের স্বার্থে পরিহার করে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে।’
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিজেদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার থাকার আহ্বান জানিয়ে উপমন্ত্রী বলেন, ‘কারও অধিকার, সাংবিধানিক শুধু নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারও আমাদের যা আছে, আমাদের নাগরিক অধিকার যেটা সংবিধানে আছে, সেটা হরণ করার জন্য অপরাজনৈতিক শক্তি, সাম্প্রদায়িক শক্তি যখন সেখানে আক্রমণ করে, তখন কোনো সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠী নিশ্চুপ হয়ে থাকলে বা নিজের অধিকারের দায়িত্ব যদি নিজে নিতে না পারে এবং সেই অপশক্তিকে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করতে না পারে, তাহলে আমাদের জায়গাটা শক্তিশালী হবে না। পরিষ্কারভাবে বলতে চাই- শেখ হাসিনার প্রত্যেক কর্মী বাংলাদেশের সকল সম্প্রদায়ের সকল নাগরিকের পাশে আছে।’
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের সুযোগে বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থান হতে পারে আশংকা করে উপমন্ত্রী নওফেল বলেন, ‘সামনের দিনগুলোতে অর্থনৈতিক চাপ, অর্থনৈতিক সংকট যেভাবে আসছে সেটাকে বাংলাদেশে একটা সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়ার চেষ্টা করবে কেউ কেউ। বাংলাদেশকে যদি একটি উগ্রবাদী জঙ্গি রাষ্ট্র করা যায়, তাহলে প্রতিবেশি দেশ ভারতেও অস্থিতিশীলতা আসবে, মিয়ানমারেও আসবে। আন্তর্জাতিকভাবে এটা একটা গৃহযুদ্ধপূর্ণ এলাকায় পরিণত হবে, আফগানিস্তানে যেটা হচ্ছে। আফগানিস্তান এখন অরাজকস্থানে পরিণত হয়েছে। ধর্মের অপব্যবহার করতে করতে তারাই সে পর্যায়ে নিজেদের রাষ্ট্রকে নিয়ে গেছে।’
‘ধর্ম নিয়ে যদি আমরা বাড়াবাড়ি করি, সাম্প্রদায়িকতার প্রতিফলন যদি আমরা ঘটাতে যাই, তাহলে দেশ আর দেশ থাকবে না, নরকে পরিণত হবে। নরক আমরা চাই না, দোজখ আমরা চাই না। আমাদের শক্তভাবে মাটি কামড়ে প্রতিহত করতে হবে। অপশক্তি থাকবে, এদের গডফাদাররা বিদেশে বসে আছে। দেশি-বিদেশি শক্তি মিলে বাংলাদেশে অরাজকতা করতে চায়। আমাদের অর্জনগুলোকে তারা পিছিয়ে নিয়ে যেতে চায়। আমাদের অনেক সমস্যা, কিন্তু আমরা চেষ্টা করছি জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশকে একটি স্থিতিশীল ও নিরাপদ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে’— বলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী।
একই সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি অস্তিত্বের প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ছাড় না দেওয়ার জন্য ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন— এদেশের মাটিতে সবার রক্ত মিশে আছে। সবার রক্তের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছে, কাউকে ভাগ করা যাবে না। ধর্মীয় বিভাজনের মধ্য দিয়ে কাউকে খাটো করা যাবে না। আপনারা কখনোই একথা ভাববেন না। আপনাদের শক্ত অবস্থান নিতে হবে। আপনাদের অধিকার এদেশের প্রতিটি মানুষের মতো অধিকার। কখনও সাহস হারাবেন না।’
‘আপনাদের কেউ কেউ ধর্মীয় কারণে, কেউ কেউ অন্য উদ্দেশে খাটো করার চেষ্টা যে কারণে আমরা যুদ্ধ করেছি, যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন, একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, একটি আধুনিক, ক্ষুধামুক্ত, শিক্ষিত নাগরিকের বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। যারা বাংলাদেশকে সেই জায়গায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সেটাকে রুখে দাঁড়াতে হবে, সেটাকে ঠেকাতে হবে। আপনাদের কাছে এই আবেদন, আপনাদের অবস্থান শক্ত হওয়া দরকার।’
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের উদাহরণ টেনে মন্ত্রী বলেন, ‘আমেরিকায় কালো মানুষের সংখ্যা ১০ শতাংশেরও কম। কিন্তু তারা প্রচণ্ড সাহসী, প্রচণ্ড প্রতিবাদী। যখন তাদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন আসে, তারা বিন্দুমাত্র ছাড় দেয় না। এ কথা বলা এ জন্য যে, আপনারা কেন দুর্বল হবেন, কোনো কারণ নেই। আপনাদেরও তাদের মতো সাহসী ভূমিকা পালন করতে হবে।’
‘আমাদের দেশ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে। এদেশের মূল যে শিকড় সেটি বাঙালি জাতিসত্তা। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ হয়েছিল পাকিস্তান। আমরা কিন্তু সেটিকে ফেলে দিয়ে বাংলাদেশ করেছি। এখানে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগাভাগির কোনো সুযোগ নেই। যারা করতে চান তারা এদেশের মূলে আঘাত করতে চান। অন্যায়ের কাছে, বিভক্তির কাছে মাথানত করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু সেই স্বপ্ন আমাদের দেখিয়েছিলেন- অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, উন্নত বাংলাদেশ। সেই পথ থেকে হারিয়ে গেলে বাংলাদেশের আর কোনো মূল্য থাকবে না। এদেশটা আমাদের অনেক রক্তে পাওয়া’— বলেন বাণিজ্যমন্ত্রী
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আইনজীবী ও মানবাধিকার সংগঠক তানিয়া আমীর হিন্দু জনগোষ্ঠীর নারীদের আইনগত অধিকারে বিভিন্ন বঞ্চনার কথা উল্লেখ করে ‘সার্বজনীন পারিবারিক আইন’ প্রণয়নের দাবি তোলেন। তিনি বলেন, ‘সনাতন ধর্মের নারীদের অধিকার আমরা অবহেলা করছি। আমাদের দেশের আইনে পরিস্কার বলা আছে, রাষ্ট্র কোনো বৈষম্য করবে না। আইনের চোখে সব নাগরিক সমান। কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলাদেশের জন্মের আগে যেসব আইন ছিল সেগুলো এখনও বহাল আছে। এগুলো কি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়? ভারতে মুসলিম আইন সংস্কার হয়নি, হিন্দু আইন হয়েছে। বাংলাদেশে হিন্দু আইন সংস্কার হয়নি, মুসলিম আইন হয়েছে।’
‘কিন্তু আমার দেশের সংবিধানে আছে— সকল নাগরিকের জন্য একই আইন। ২০২২ সালে এসে সার্বজনীন পারিবারিক আইনের কথা কি আমরা চিন্তা করতে পারি না? সার্বজনীন পারিবারিক আইন সময়ের দাবি। সিভিল আইনে, ফৌজদারি আইনে কার কী ধর্ম প্রাসঙ্গিক না। চুরি করলে কার কি ধর্ম সেটা প্রাসঙ্গিক না, একই সাজা। তাহলে সার্বজনীন পারিবারিক আইনে এত দ্বিধা কেন ? আপনাদের ভেতর অনেকেরও দ্বিধা আছে। সেটাকে অতিক্রম করতে হবে। আমরা যখন মানবাধিকারের কথা বলি, কেবলমাত্র একটি গোষ্ঠী বা বিশেষ মানুষের জন্য না, এটা নারী-পুরুষ, ধর্ম-গোত্র নির্বিশেষে সবার জন্য। আমরা যদি সাম্য চাই, সেটা করতে হবে সবার জন্য’- বলেন তানিয়া আমীর
সম্মেলনে জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারাও বক্তব্য রাখেন।
কালের আলো/ডিএস/এমএম