পুলিশ জাদুঘরে গৌরবের অনন্য ইতিহাস

প্রকাশিতঃ 11:38 am | March 26, 2022

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনেই প্রথম পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মর্টার, কামান, ট্যাঙ্ক আর ভারী অস্ত্রের বিরুদ্ধে কেবলমাত্র থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। সেদিন জীবন বাজী রেখে লড়াই করেছিলেন পুলিশ সদস্যরা। শহীদ হয়েছিলেন দেশের জন্য।

মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের সেই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে গড়ে তোলা হয়েছে ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রথম আক্রমণের শিকার হয়েছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন। সেখান থেকেই শুরু হয় প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ। সেই রাজারবাগ পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভের পাশেই দেড় বিঘা জমির ওপর নির্মিত পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের বর্তমান ডিআইজি হাবিবুর রহমানের একক প্রচেষ্টায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে টেলিকম ভবনে প্রতিষ্ঠিত হয় পুলিশ মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর। এটি একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দায়বদ্ধতা থেকেই পিতৃভূমি টুঙ্গিপাড়ার এই কৃতি সন্তানের এই উদ্যোগ। ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ এটি সর্বসাধারণের প্রবেশের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি ‘জাতীয় পুলিশ সপ্তাহ’র উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভের ঠিক পাশেই নব-নির্মিত জাদুঘর ভবনের উদ্বোধন করেন।

অত্যন্ত নান্দনিক শিল্পশৈলীতে নির্মিত এই জাদুঘরে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়বে বঙ্গবন্ধু গ্যালারি। গ্যালারির দু’পাশের দেয়ালে আছে বঙ্গবন্ধুর নানা সময়ের দুর্লভ সব আলোকচিত্র। পাশেই মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা প্রায় ২ হাজার বইয়ের সমন্বয়ে এক মনোরম লাইব্রেরি। যে কেউ লাইব্রেরিতে বসে বই পড়তে পারবেন। এছাড়া এখানে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদান বিষয়ে লেখা বিভিন্ন বই কেনারও ব্যবস্থা আছে।

বঙ্গবন্ধু গ্যালারির ঠিক মাঝ বরাবর একটি গোলাকার সিঁড়ি নেমে গেছে জাদুঘরের মূল কক্ষে। জাদুঘরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের ইতিহাসের বিশাল সংগ্রহশালা। যত্নের সঙ্গে সংরক্ষিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন পুলিশ বাহিনীর নানান স্মৃতিচিহ্ন, অস্ত্র, পোশাক, দলিল-দস্তাবেজ। এমনকি বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ব্যবহার করা .৩৮ বোর রিভলভারটিও সংরক্ষিত আছে এই জাদুঘরে।

জাদুঘরের মূল কক্ষে প্রবেশ করলেই শোনা যায় মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশাত্মবোধক বিভিন্ন গান। একদিকে আছে অডিও ভিজুয়্যাল গ্যালারি। সেখানে দর্শনার্থীদের জন্য ১৯৭১ সালে৪ ২৫ শে মার্চ কালরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধের ওপর নির্মিত ৪০ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি দেখার ব্যবস্থা আছে।

দর্শনার্থীরা গেলেই জাদুঘরে দেখতে পাবেন- পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত থ্রি নট থ্রি রাইফেল, শহীদ পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত পোশাক, চশমা, টুপি, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণার টেলিগ্রাম লেটার, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আইজিপি আবদুল খালেকের ব্যবহৃত চেয়ার, যুদ্ধের সময় উদ্ধারকৃত গুলি ও মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত হ্যান্ড মাইক, যুদ্ধের সময় দূর থেকে শত্রুর অবস্থান দেখার জন্য পুলিশ বাহিনীর সার্চ লাইট, রাজারবাগ পুলিশ লাইনের টেলিকম ভবনের দেয়াল ঘড়ি, যুদ্ধকালীন পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন চিঠিপত্র, ২৫ শে মার্চ রাতে সারা দেশে পুলিশ সদস্যদের রাজারবাগ আক্রমণের খবর দেওয়া হেলিকপ্টার ব্যাজ বেতার যন্ত্র, ওয়্যারলেস সেট, পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত বেঞ্চ, প্রথম প্রতিরোধের রাতে পুলিশ সদস্যদের একত্রিত করা পাগলা ঘণ্টাসহ শত শত ঐতিহাসিক নিদর্শন।

এই জাদুঘরে আরও আছে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ব্যবহার করা ৭.৬২ এমএম রাইফেল, রিভলভার, ২ ইঞ্চি মর্টার এবং মর্টারশেল, ৩০৩ এলএমজি, মেশিনগান, ৭.৬২ এমএম, এলএমজি .৩২ বোর রিভলভার, .৩৮ বোর রিভলভার, ১২ বোর শটগান, ৯ এমএম এমএমজিসহ বিভিন্ন অস্ত্রের সমাহার।

আছে খানসেনাদের দ্বারা নির্যাতিত নারীর চিঠিতে ২৫ শে মার্চের বর্ণনা, নির্যাতিত অনেক নারীর পরিবার বাবা-মার লেখা চিঠি, গেরিলা প্রশিক্ষণে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের আলোকচিত্রসহ অন্যান্য জিনিসপত্র।

এছাড়া কালে কালে নিরাপত্তা বাহিনী বা পুলিশ সদস্যদের বিবর্তনের ইতিহাসও পাওয়া যায় এ জাদুঘরে। মুঘল আমল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে পুলিশের ইউনিফর্ম, তরবারি, চাবুক, টহল পুলিশের শিঙ্গাসহ বিভিন্ন কিছুর সমাবেশ আছে এ জাদুঘরে।

কালের আলো/পিএসবি/এমএম

Print Friendly, PDF & Email