বৈচিত্র্যময়-মনোমুগ্ধকর বিজয় দিবস প্যারেড, কথা রেখেছেন সেনাপ্রধান

প্রকাশিতঃ 6:23 am | December 17, 2021

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো :

৫৬ হাজার বর্গমাইলের মানচিত্র আর লাল-সবুজের পতাকা-সবকিছুই এক সুতোয় গেঁথে ১৯৭১’র ১৬ ডিসেম্বর ভূ-গোলকে লেখা হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের নাম। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনকারী দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ উদযাপনে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে থাকলো জাতীয় প্যারেড স্কয়ারের বৃহস্পতিবারের (১৬ ডিসেম্বর) কুচকাওয়াজ।

বিজয়ের রঙিন আবহে মাতৃভূমির সুবর্ণজয়ন্তী ও জনকের জন্মশতবার্ষিকী- এ দু’য়ের আনন্দে পূব আকাশে উদিত রবির কিরণে এবারের সম্মিলিত কুচকাওয়াজকে বিশেষ বৈচিত্র্যময় ও মহিমান্বিত অবয়বে ফুটিয়ে তোলার ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ।

দেশের মানুষের আশা-ভরসার মূর্ত প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর-একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত শেখ রোকন উদ্দিন আহমেদের সন্তান বলেই কীনা তাঁর মানষপটে সদা জাগ্রত স্বাধীনতার গৌরবগাথা আন্দোলন-সংগ্রামের স্পিরিট, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বিজয় ইতিহাসের নির্মাতা, ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ বঙ্গবন্ধুর অবিনশ্বর চেতনা ও মৃত্যুঞ্জয়ী আদর্শ।

মঙ্গলবার (১৪ ডিসেম্বর) জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে শেষ মুহুর্তের প্যারেড প্রস্তুতি পরিদর্শনকালে দেশের বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার সঙ্গে গৌরবের, আনন্দের, অহঙ্কারের, আত্মমর্যাদার ও আত্মোপলব্ধির জায়গা থেকে দৃঢ়কন্ঠে জেনারেল শফিউদ্দিন বলেছিলেন, ‘এই শুভক্ষণ আর আসবে না। এটি ইতিহাসে একবারই এসেছে একবারই এটা থাকবে। এই প্যারেডটাকে যতটা সুন্দর এবং কালারফুল করা সম্ভব আমরা চেষ্টা করেছি। যাতে করে এই উৎসবের উদযাপনটি ইতিহাসের গুরুত্বের সঙ্গে মানানসই হয়।’

বাস্তবিক অর্থেই কথার সঙ্গে নিজেদের কাজের মিল রেখেছেন সেনাপ্রধান। রক্তনদী পেরিয়ে জন্ম নেওয়া শৃঙ্খলমুক্ত, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছরের পূর্তির দিনের জাতীয় প্যারেড স্কয়ারের এবারের কুচকাওয়াজে উঠে এসেছে উন্নয়ন-অগ্রগতিতে বিশ্বের বিস্ময় অদম্য এক বাংলাদেশের বর্ণিল চিত্র।

বাঙালির যুদ্ধজয়ের উচ্ছ্বাস আর আত্নপরিচয় পাওয়ার সুবর্ণজয়ন্তীর এই দিনটিতে স্থলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের দৃপ্ত পদভারে মুখর ছিল রীতিমতো। বারবারই যেন মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছিল পিতা মুজিবের সেই অমর বাণী- বাঙালি জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।

আকাশ থেকে নেমে আসা দু:সাহসিক প্যারা কমান্ডো সদস্যদের ফ্রিফল জাম্প, অপারেশনের অ্যাকশন কিংবা অত্যাধুনিক সামরিক বিমানের সক্ষমতার নজির স্থাপন করে আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মিলিয়ে যাওয়ার ঘটনাপ্রবাহ ছিল রীতিমতো মনোমুগ্ধকর। বৃহস্পতিবার (১৬ ডিসেম্বর) নজরকাড়া এই আয়োজনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো.আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সঙ্গী হয়েছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। বিমুগ্ধ বিস্ময়ে তাঁরা উপভোগ করেন জাঁকালো এই আয়োজন।

পরাধীনতার দীর্ঘ প্রহর শেষে পুরো জাতি যার নেতৃত্বে পেয়েছে স্বাধীন দেশ, একটি জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা, বিভিন্ন কবির অসংখ্য কবিতার পঙতিতে উঠে আসা সেই ধন্য পুরুষ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশালাকৃতির ম্যুরাল ছিল কুচকাওয়ারেজ পুরোভাগেই। ছিল সাত বীরশ্রেষ্ঠের প্রতিকৃতি ও জাতির সূর্য সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের সুসজ্জিত বাহন।

এবারই প্রথম ভারত, ভূটান, যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে ভারত, ভূটান ও রাশিয়ার কন্টিনজেন্ট অংশ নিয়েছে। পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। দৃষ্টি কাড়ে ভুটানের ৩৫ সদস্যের কনটিনজেন্ট।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সবার আগে স্বীকৃতি দেওয়া ভুটান এদিন বিদেশী কনটিনজেন্টের মধ্যে প্রথম রাষ্ট্রপতি মো.আবদুল হামিদকে সালাম জানায়। সবচেয়ে বেশি ভারতের ১২২ সদস্যের কনটিনজেন্টের বাদক দল যেন ছড়িয়ে দেয় ৫০ বছরের সুদৃঢ় বন্ধুত্বের বার্তা। আপদে-বিপদে সব সময় পাশে থাকার অঙ্গীকারই যেন জানান দিয়েছে বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র রাশিয়া।

বিজয় দিবস কুচকাওয়াজের অধিনায়ক ছিলেন নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও সাভার এরিয়ার এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মোহাম্মদ শাহীনুল হক। উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিশ্বস্বীকৃতি আদায়কারী বাংলাদেশের আদ্যোপান্তও উঠে আসে এই বর্ণিল আয়োজনে।

বাংলার মাটি দুর্জয়, নিজেদের সামরিক সক্ষমতায় এই বিষয়টি এদিন জানিয়ে দেয় সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী।
সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া ও যান্ত্রিক বহরে নিত্য নতুন সংযোজন, মিসাইল, অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান বাহিনীর মিগ-২৯সহ বিভিন্ন যুদ্ধবিমান আর আধুনিক সমরাস্ত্রের প্রদর্শনী ছিল অনন্য।

প্রকৃত অর্থেই জাঁকজমক এক প্যারেডই উপহার দিয়েছেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। ফলশ্রুতিতে সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদের প্যারেড প্রস্তুতির সেই বক্তব্যও বিজয়ের ৫০ ছোঁয়ার আনন্দে বিভোর দেশের মানুষের কাছে হয়ে উঠে গুরুত্বপূর্ণ এক উপজীব্য।

সব সময় ‘টিম ওয়ার্ক’ এ বিশ্বাসী সেনাপ্রধানের দিকনির্দেশনামূলক সেই বার্তা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সংশ্লিষ্টদের আরও অনুপ্রাণিত ও উদ্দীপ্ত করে তোলে। বিজয় দিবস কুচকাওয়াজের বর্ণাঢ্য আয়োজনে দুরন্ত-অদম্য বাংলাদেশের বিজয়গাঁথা উপস্থাপিত হয়েছে চমৎকারিত্বের মধ্যে দিয়েই। রাষ্ট্রপতির পাশে পুরো অনুষ্ঠানজুড়েই তাই সম্ভবত ফুরফুরে মেজাজেই ছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ।

সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্বগ্রহণের ৬ মাসের মাথায় সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বৃহৎ ইতিহাস সৃষ্টিকারী এক উদযাপনের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে পুরো বিশ্বকেই দেখিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে অর্থ-বাণিজ্যের সব সূচকে তাক লাগিয়ে দেওয়া, দুর্বার গতিতে সম্মুখপানে এগিয়ে চলা, সামরিক সক্ষমতায় শক্তপোক্ত এক বাংলাদেশকে। পাশাপাশি সম্মিলিত এই কুচকাওয়াজ যেন বিজয়ের মহত্বে দেশের সব মানুষকে একাত্ম করলো স্বয়ংসম্পূর্ণ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার এক অভিন্ন মনষ্কামে।

কালের আলো/এমএএএমকে

Print Friendly, PDF & Email