শুধু হাফ ভাড়ার সুরাহা নয়, নৈরাজ্যও বন্ধ হোক

প্রকাশিতঃ 11:35 am | November 30, 2021

মো. শাহ জালাল মিশুক:

বাংলাদেশে ডিজেলের মূল্য ২৩ শতাংশ বাড়লেও প্রতি কিলোমিটারে বাসভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত ৪ নভেম্বর থেকে তিন দিন ধরে ধর্মঘটের মুখে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং বাস মালিকদের দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টার বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়। অনেকটা বলা চলে, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে জনগণকে জিম্মি করে ধর্মঘট ডেকে গাড়িভাড়া বাড়িয়ে নিলেন পরিবহন মালিকরা। তাঁদের ইচ্ছানুযায়ীই ভাড়া নির্ধারিত হলেও অভিযোগ রয়েছে, তাঁরাই আবার বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন যাত্রীদের কাছ থেকে। অন্যদিকে সিটিং বা গেটলক সার্ভিস বন্ধের ঘোষণা দিয়ে সেটিও তাঁরা মানছেন না। বাসে উঠলেই পুরো পথের ভাড়া নিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

সরকারের পক্ষ থেকে বাসভাড়া বাড়ানোর পর থেকেই গণপরিবহনে শুরু হয়েছে নতুন আরেক নৈরাজ্য। শিক্ষার্থীরা এমন নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামল, যদিও সেটি হাফ ভাড়ার দাবিতে। হাফ ভাড়ার ইস্যুটি পুরনো।

সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ঘটনা গণমাধ্যমেও উঠে এসেছে। এর মধ্যে ভাড়া নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে হেনস্তা, সরকারি তিতুমীর কলেজের চার শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে আহত, ইম্পেরিয়াল কলেজ ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঝামেলা উল্লেখযোগ্য। এরপর বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ ও হাফ ভাড়ার দাবি জানিয়েছে। হাফ পাসের দাবিতে গত বৃহস্পতিবারও রাজধানীর আট স্থানে সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। ছাত্রদের দাবি, ‘হাফ পাস’ তাদের অধিকার। বাস মালিকরা বলছেন, ‘হাফ পাস’ দেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে বিআরটিএ কার্যালয়ে বৃহস্পতিবারের বৈঠকে কোনো সুরাহা হয়নি।

শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার দাবি দীর্ঘ ৫২ বছরের। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার বৈষম্যের পটভূমিতে ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা এক ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং অচিরেই এ আন্দোলন গণ-আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। ১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাসে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের মেনন ও মতিয়া গ্রুপ রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলে। এ দুই সংগঠন ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে এবং আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে ১১ দফা দাবি ঘোষণা করে। এই বহুল আলোচিত ১৯৬৯ সালের সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার অন্যতম ছিল বাস-ট্রেন-লঞ্চে শিক্ষার্থীদের ‘হাফ ভাড়া’ নেওয়ার দাবিটি। সেখানে বলা হয়, “ট্রেনে, স্টিমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের ‘আইডেন্টিটি কার্ড’ দেখাইয়া শতকরা ৫০ ভাগ ‘কন্সেসনে’ টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে।”

১৯৬৯ সালের সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১টি দফার মধ্যে ১ নম্বর দফার ‘ঢ’ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল বাস-লঞ্চ-ট্রেনে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার দাবিটি; কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছর অতিবাহিত হলেও এখনো শিক্ষার্থীদের সেই দাবি বাস্তবে রূপ নেয়নি। সম্প্রতি ব্যাপক হারে গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির পর দাবিটি আবারও সামনে এসেছে।

আইনগতভাবে যদিও বাসে হাফ ভাড়ার বিষয়টির কোনো ভিত্তি নেই, এর পরও ঢাকার গণপরিবহনে সেটি একটি চিরায়ত প্রথা। ২০১৫ সালের অক্টোবরে বিআরটিসির কার্যালয়ে বাস ডিপো ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে এক বৈঠকে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘আমি এই মুহূর্ত থেকে নির্দেশ দিচ্ছি, রাজধানীতে চলাচলরত বিআরটিসির পাশাপাশি অন্যান্য পরিবহনেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নেবে। আর না নিলে দায়ী পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের সড়ক আন্দোলনে তোলপাড় হলো গোটা দেশ। সেই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির একটি ছিল, ঢাকাসহ সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সে সময়ই মন্ত্রিসভায় একটি খসড়া ট্রাফিক আইন অনুমোদন করলেও সেখানে হাফ ভাড়ার বিষয়টি ছিল না।

মোদ্দাকথা হলো, বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকেই হাফ ভাড়ার প্রচলন ছিল। এমনকি তখন বাস মালিকরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নিতে পরিবহন শ্রমিকদের বলে দিতেন। এর জন্য অনেকাংশেই তাদের আইডি কার্ডও দেখা হতো না। পাশাপাশি বিশ্বের অনেক দেশেই সরকারি ও বেসরকারি গণপরিবহনগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়। বাংলাদেশেও তাই এমন কোনো অবস্থা তৈরি করা উচিত নয়, যাতে শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবহন খাতে ব্যয় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

তাই অতি দ্রুত সরকার থেকে পদক্ষেপ নিয়ে বাস মালিকদের সঙ্গে বসে ছুটির দিন ছাড়া শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য একটি প্রজ্ঞাপন দিয়ে আইন করলে বিষয়টি মীমাংসা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক সিট রেখে হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করা উচিত। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সারা দেশে বিআরটিসির বাসে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা বিআরটিসিকে গণপরিবহনে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হবে। রাজধানীর সব রুটে বিআরটিসির বাস চালু করলে পরিবহন খাতের নৈরাজ্য অনেকটাই কমে আসবে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

shahjalalmisuk@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email