চীনে আমাদের ঈদ ও ধর্মকর্ম
প্রকাশিতঃ 10:43 am | May 15, 2021

আলিমুল হক:
আমি কর্মসূত্রে চীনে আসি ২০১২ সালের আগস্টের ঠিক মাঝামাঝিতে। কর্মস্থলে যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করলাম, সেদিনটির কথা স্পষ্ট মনে আছে। বাংলা বিভাগের পরিচালক ইয়ু কুয়াং ইয়ুয়ে (যিনি বাংলাদেশে আনন্দি নামে সুপরিচিত) আমাকে ব্রিফ করলেন। সবশেষে বললেন, ‘আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন?’ আমি তখন তাকে বললাম, ‘ম্যাডাম, আমি অফিসের ঠিক কোন জায়গাটায় নামাজ পড়তে পারি?’ প্রশ্ন শুনে তিনি মোটেও অবাক হলেন না। মুচকি হেসে বললেন, ‘আপনি আমার পাশের এই যে খালি জায়গাটুকু আছে, সেখানে নামাজ পড়তে পারেন। অথবা, আমাদের স্টুডিওর পাশে একটি ছোট্ট করিডোর আছে, সেখানে নামাজ পড়তে পারেন। উর্দু বিভাগের একজন পাকিস্তানি বিশেষজ্ঞ সেখানে নামাজ পড়তেন।’ আমি বললাম, ‘আমি সেখানেই নামাজ পড়ব।’
শুরুর দিকে আমি অফিসে আমার জন্য বরাদ্দকৃত ড্রয়ারে একটি জায়নামাজ রাখতাম। অফিসে কোনো ওয়াক্তের নামাজের সময় হলে সেটি নিয়ে চলে যেতাম ওই ছোট্ট করিডোরে। কিছুদিন পর জায়নামাজটি করিডোরের একটি উঁচু জায়গায় একটি কাপড়ের ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখতে শুরু করলাম। নামাজের সময় হলে সেখানে গিয়ে নামাজ পড়ে আবার যথাস্থানে তা রেখে দিই। এভাবেই চলছে গত প্রায় সাড়ে আট বছর ধরে। সেই জায়নামাজ ও সেই কাপড়ের ব্যাগ আজও আছে। নামাজির সংখ্যা অবশ্য বেড়েছে! আমার অন্য বাঙালি কলিগরা সেই জায়নামাজটি ব্যবহার করেন। উর্দু বিভাগের পাকিস্তানি বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউও মাঝেমাঝে সেটি ব্যবহার করেন।
আমি যখন চীনে প্রথম আসি, তখন শুনেছিলাম, চীনে ধর্মকর্ম করা যায় না; বিশেষ করে মুসলিমরা এখানে নামাজ-রোজা করতে পারেন না। চীনে আসার পর বাংলাদেশ থেকে আমার পরিচিত কেউ কেউ জানতেও চেয়েছেন যে, আমি চীনে নামাজ-রোজা করতে পারি কি না। আমার উত্তর শুনে তারা অবাক হতেন। তাদের অনেকে তখন বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত খবরাখবর আমাকে শেয়ার করতেন। বিশেষ করে রমজান মাসে। একবার একটি সচিত্র প্রতিবেদন শেয়ার করলেন এক পরিচিতজন। প্রতিবেদনের সঙ্গে একটি ছবিও আছে। ছবির ক্যাপশানটা অনেকটা এমন: রোজা রাখতে না-দেয়ায় চীনা মুসলিমদের বিক্ষোভ-মিছিল। আমি ছবিটা দেখে খানিকটা অবাক হলাম। ছবিতে দাড়ি-টুপি পরা চীনা মুসলমানদের মিছিল তো দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সেটাকে বিক্ষোভ-মিছিল মনে হচ্ছে না মোটেই! ছবিতে তারা একটা চীনা ভাষায় লেখা ব্যানার বহন করছিলেন। আমি আমার চীনা সহকর্মীকে ছবিটা দেখিয়ে শুধু জানতে চাইলাম, ‘ব্যানারে কী লেখা আছে?’ তিনি ভালো করে দেখে বললেন, ‘ঈদের আনন্দমিছিল!’
চীন বড় দেশ। বিগত সাড়ে আট বছরে এই বিশাল দেশটার খুব সামান্যই দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। তবে, যতটুকু দেখেছি, তাতে কখনও মনে হয়নি যে, এদেশের সরকার বা জনগণ মুসলিম-বিদ্বেষী বা তাদের ধর্মকর্ম করা নিয়ে বিরক্ত। আমি ও আমার সহকর্মীরা (বাংলাদেশের ও অন্যান্য মুসলিম দেশের) এখানে সরকারি চাকরি করেও কখনও নামাজ-রোজা করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হইনি। আমরা যেই প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, সেই প্রতিষ্ঠানের ক্যান্টিনে এমনকি একটি হালাল কাউন্টারও আছে। যেই কাউন্টারে মুসলিম কর্মীদের হালাল খাবার দেয়া হয়। আমার ছেলে কিন্ডারগার্টেনে যখন পড়ত, তখন তাকে আলাদাভাবে হালাল খাবার দেয়া হতো। এখন স্কুলেও তাকে আলাদাভাবে হালাল খাবার দেয়া হয়। তাকে যে ওয়ানটাইম ইউজ ট্রেতে খাবার দেয়া হয়, সেটির রঙও সবুজ! বাকিদের ট্রে-র অন্য রঙ। জানি না, সবুজকে মুসলিম রঙ মনে করেই একটা করা হয়েছে কি না। তবে, আমাদের ক্যান্টিনের হালাল কাউন্টারেও সবুজ রঙের ট্রেতে খাবার দেয়া হয়।
আমি বেইজিংয়ের তিনটি মসজিদে এ পর্যন্ত নামাজ পড়েছি। একটি তো বেইজিংয়ের বিখ্যাত মসজিদ, যেটি নিউচিয়ে মসজিদ নামেই আমাদের কাছে পরিচিত। তবে, সেটি বেশি দূরে হওয়ায়, কাছাকাছি মোশিখো নানলি-তে অবস্থিত মসজিদেই বেশি গিয়েছি। একবার গিয়েছিলাম আরও কাছাকাছি মুশিডি-তে অবস্থিত আরেকটি মসজিদে। তবে, একমাত্র বেইজিংয়েই যে মসজিদের সংখ্যা ৮৩টি, এ তথ্যটা জেনেছি অনেক পরে। যেই সিনচিয়াং নিয়ে এতো কথা, সেই সিনচিয়াংয়ে মসজিদের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার (যতদূর জানি, গোটা যুক্তরাষ্ট্রেও এতো মসজিদ নেই!)। আর গোটা চীনজুড়ে আছে ২৯ হাজারের বেশি মসজিদ।
না, এসব মসজিদ খালি পড়ে থাকে না। এগুলোতে নামাজিদের ভিড় জমে ওয়াক্তে ওয়াক্তে। চীনে ১০ সংখ্যালঘু জাতি আছে, যারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এই দশটি জাতি হচ্ছে: হুই, উইগুর, কাজাখ, তুংসিয়াং, কিরগিজ, সালার, তাজিক, উজবেক, পাও’আন, ও তাতার। এই দশটি জাতির লোকসংখ্যা কয়েক কোটি। তারা এসব মসজিদে নামাজ পড়েন। শুধু চীনা মুসলিমরা নন, চীনে বসবাসকারী অনেক বিদেশি মুসলিমের যাতায়াতও আছে এসব মসজিদে। চীনে ৮ লাখ ৪৫ হাজার ৬৯৭ বিদেশির বাস। এটা ২০২০ সালের হিসেব। এখন সংখ্যাটা আরেকটু বড় হবার কথা। তো, এদের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে মুসলিম। আবার চীনে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীই আছে প্রায় ১২ হাজার। আমার মতো কর্মসূত্রে বা ব্যবসাসূত্রে কতো বাংলাদেশি চীনে বাস করেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান আমার হাতে নেই। তবে অনুমান করি, খুব কম হবে না। তাদের একটা বড় অংশ আবার মুসলিম।
এই বাংলাদেশি মুসলিমদের মধ্যে যারা ধর্মচর্চা করেন, তাদের নিয়মিত যাতায়াত আছে চীনের বিভিন্ন মসজিদে। ঈদের সময়ও চীনের বিভিন্ন জায়গায় বাংলাদেশি মুসলিমরা সেসব মসজিদে ঈদের নামাজ পড়েন। অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঈদের জামাতের ছবি পোস্ট করেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অনেকে আমাকে ব্যক্তিগতভাবেও ছবি পাঠিয়েছেন, ভিডিও পাঠিয়েছেন। একটি ভিডিওতে দেখলাম রীতিমতো বিশাল মিছিল করে নামাজিরা ঈদের নামাজ পড়তে যাচ্ছেন। তাদের বেশিরভাগই চীনা মুসলিম, বাকিরা বিদেশি। অনেকের মুখে মাস্ক আছে, অনেকের মুখে নেই।
কিন্তু যাদের মুখে মাস্ক নেই, তাদেরকে যে মসজিদে ঢোকার সময় মাস্ক পরতে হয়েছে, সেটা নিশ্চিত। কারণ, এটাই নিয়ম। চীনে মহামারি নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু মহামারি-প্রতিরোধকব্যবস্থা শিথিল করা হয়নি একটুও। মসজিদে তারাই যেতে পারবেন, যারা মহামারিসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শর্ত পূরণ করতে পারবেন। বেইজিংয়ের কথা বলি। বেইজিংয়ে কেউ মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে চাইলে, তাকে আগেভাগেই নির্দিষ্ট মোবাইল অ্যাপে রেজিস্ট্রেশান করাতে হবে- এই হচ্ছে নিয়ম। শুনতে জটিল মনে হলেও, কাজটা আসলে সোজা। অ্যাপে নিজের টেলিফোন নম্বর ও পাসপোর্ট নম্বর (বিদেশিদের ক্ষেত্রে) এবং মসজিদের নাম ইনপুট দিলেই রেজিস্ট্রেশান হয়ে যাবে।
আমি ঈদের আগের দিন পরীক্ষামূলকভাবে নিউচিয়ে মসজিদের জন্য নাম রেজিস্ট্রেশান করিয়েছি। ৩০ সেকেন্ডের মামলা। মোবাইল অ্যাপে দেখলাম ৭২টি মসজিদের নাম-ঠিকানা আছে (চীনা ও ইংরেজি ভাষায়)। আপনি যে-কোনো মসজিদে নামাজ পড়তে পারবেন। শুধু মসজিদ নয়, এই অ্যাপের মাধ্যমে অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত আছে। এসব ধর্মের মধ্যে আছে বৌদ্ধ ধর্ম, তাও ধর্ম, ক্যাথলিক ধর্ম, খ্রিষ্টান ধর্ম, ইত্যাদি। এসব ধর্মের লোক যদি উপাসনালযে যেতে চায়, তবে তাদেরকেও এই অ্যাপের মাধ্যমে আগে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নিতে হবে। কোনো বৈষম্য নেই। সকল ধর্মের মানুষের জন্য একই নিয়ম!
রেজিস্ট্রেশন করিয়েও আমি ঈদের নামাজ পড়তে পারিনি। এবারের ঈদ-উল-ফিতরের দিনে আমার সকাল থেকে অফিস। আর বেইজিংয়ের মসজিদগুলোতে ঈদের জামাত সকালেই হয়। ফলে, আমার পক্ষে জামাতে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। আমার অন্য দুই বাংলাদেশি সহকর্মীর একজনের ছুটি থাকায় তিনি ঈদের জামাতে শরিক হন। অন্যজনের রাতের ডিউটি। তার সুযোগ ছিল ঈদের জামাত পড়ার। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগত কারণে ঈদের জামাতে শরিক হতে পারেননি। এদিকে, অফিসে ঈদ উপলক্ষ্যে কেক কাটা হয়েছে। আমাদের বস কেকের ব্যবস্থা করেছেন আমাদের না-জানিয়ে, সারপ্রাইজ দেবার জন্য। ক্ষণিকের জন্য হলেও একটা উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়েছিল তখন। কিন্তু ছেলেকে নিয়ে ঈদের জামাতে শরিক হতে না-পারার আক্ষেপটা রয়েই গেল।
প্রতি ঈদেই বেইজিংয়ে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসে একটা উদ্যাপনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সাধারণত এ অনুষ্ঠান হয় রাতে। আর দুর্ভাগ্যক্রমে প্রায় সময়ই রাতে ডিউটি থাকার কারণে আমি সেসব অনুষ্ঠা্ন মিস্ করি। এবার আমার সকালে ডিউটি থাকায় দূতাবাসের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেলাম। বাংলাদেশের দূতাবাসের অনুষ্ঠান মানেই কয়েক ডজন বাংলাদেশির সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ। ছেলেকে বললাম: ‘দেখ বাবা, দূতাবাস হচ্ছে একটি মিনি বাংলাদেশ। ওখানে প্রায় সবাই বাঙালি, বাংলায় কথা বলে। তুমি তাদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলবে, সালাম দিবে। এক-দু’জন চীনা অতিথি থাকতেও পারেন। তাদের সঙ্গে তুমি চাইলে চীনা ভাষায় কথা বলতে পারো।’ ছেলে বাধ্য সন্তানের মতো মাথা দুলিয়ে বলল: আচ্ছা।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)