উদ্ধত মৃত্যুর ফণার মাঝেও ফ্রন্টলাইনার পুলিশ, মানবিক দায়িত্বশীলতার শাণিত শপথ আইজিপির

প্রকাশিতঃ 8:38 pm | March 18, 2021

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

করোনার উর্ধ্বগতি সংক্রমণের জেরে ঘরের দুয়ারে আবারও উদ্ধত মৃত্যুর ফণা। কিন্তু প্রাণহানির শঙ্কাকে তুচ্ছ করেই বৃহত্তর জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করেই আবারও মলিন ও রঙবিহীন সময়ে মানবিকতার উজ্জ্বলতার নতুন ধারায় নিজেদের সমর্পণ করতে প্রস্তুত প্রায় সোয়া দুই লাখ সদস্যের বিশাল পুলিশ বাহিনী।

অপ্রত্যাশিত বৈশ্বিক অভিঘাত করোনাভাইরাস পরিস্থিতি এক বছর পেরিয়ে গেলেও পুনরায় আবারও নতুনভাবে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে জনসাধারণের মাস্ক পরিধান নিশ্চিতসহ কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানাতে আর মাত্র তিন দিন বাদেই পুরোদমে সক্রিয় হতে যাচ্ছে পুলিশ।

করোনার দহন যন্ত্রণায় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাসেও আনন্দের আবর্তে ঘূর্ণি তুলেছে বেদনাবিধুরতাও। কিন্তু বাঙালি জাতির যে কোন দুর্যোগে-সঙ্কটেই দ্বিধাহীন সম্মুখসারির যোদ্ধা পুলিশ। করোনার গভীর দহনদিনে ফের ২০২০ সালের চেহারায় দেশের সাধারণ মানুষের সুরক্ষায় নবতর চেতনায় উজ্জীবিত হয়েই মাঠে নামছে মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিদের প্রথম প্রতিরোধ করা দেশপ্রেমিক এ বাহিনীটি।

বৃহস্পতিবার (১৮ মার্চ) প্রায় ৮ ঘন্টা আগে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জনসাধারণের মাস্ক পরিধান নিশ্চিতসহ কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানাতে নিজেদের তৎপরতা শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) ড.বেনজীর আহমেদ, বিপিএম (বার)।

মাস্ক নিশ্চিত করতে ‘বাধ্য’ করার থিউরির পরিবর্তে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন তিনি। ‘সবাই নিজের জন্য, পরিবারের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন’- এমন প্রত্যাশার কথাও উচ্চারণ করেছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক।

আগামী ২১ মার্চ থেকে ‘মাস্ক পরার অভ্যেস, কোভিড মুক্ত বাংলাদেশ’ স্লোগান নিয়ে দেশব্যাপী বিশেষ উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচির কথা জানিয়ে পুলিশপ্রধান মাঠপর্যায়ে জনসাধারণকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনুপ্রেরণা ও উদ্বুদ্ধ করতে নিজেদের লক্ষ্যস্থির করেছেন।

এদিন সকালে রাজারবাগ পুলিশ অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নিজের প্রাজ্ঞ অভিব্যক্তির সঙ্গে দায়িত্বশীলতার শাণিত শপথ আর সময়ের প্রতিটি স্পন্দনের ঘটমানতাকে ড.বেনজীর আহমেদ সামনে তুলে এনেছেন বহুমাত্রিক সৃজনশীলতায়।

পুলিশপ্রধান স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘জনসাধারণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করতে আগামী ২১ মার্চ থেকে বিশেষ কর্মসূচী শুরু করবে পুলিশ। জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করা, প্রেষনা ও অনুপ্রেরণা যোগাতেই এই কর্মসূচী নেওয়া হয়েছে। কমিউনিটি পুলিশিং ও বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে গ্রামে-গঞ্জেও জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করা হবে, প্রয়োজনে বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ করা হবে।’

প্রাণসংহারী করোনার প্রথম ধাপে সম্মুখ সমরে লড়াই করে মানবিকতার উজ্জ্বলতায় নতুন ধারায় নিজেদের উপস্থাপন করতে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিল গোটা পুলিশ বাহিনী। পুলিশের ৩৯ তম আইজিপি ড.বেনজীর আহমেদের নেতৃত্বে চিরায়ত পুলিশিং থেকে বেরিয়ে নিজেদের কর্মেও তাঁরা এনেছিলেন বৈচিত্র্য। জীবন যুদ্ধে থমকে দাঁড়ানো অর্ধাহার-অনাহারে থাকা মানুষের হৃদয়-মন জয় করেছিলেন।

কর্মের উজ্জ্বল দ্যুতিতেই করোনার মহাদুর্যোগে নিজেদের সম্পর্কিত প্রচলিত সব ধ্যান-ধারণাই আমুল বদলে দিয়েছিলেন। বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। অস্ত্রহীন এ যুদ্ধে মানবিকতা, সহনশীলতা, ভ্রাতৃত্ববোধের অনন্য এক নজির স্থাপন করেন পুলিশের এই আইজি।

নিজ বাহিনীতে করোনাকে হার মানাতে তাঁর দূরদর্শিতা, সুদূরপ্রসারী চিন্তা, অসাধারণ দৃঢ়তা, সম্মোহনী ও তেজস্বী বাগ্মীতা সদস্যদের সাহস এবং মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে।

সময়ের চেয়েও অগ্রসর এবং উদার মানবিক গুণসম্পন্ন ড.বেনজীর করোনাকালীন নেতৃত্বের পুরোটা সময় নিজের ভাবনার সঙ্গে ইতিবাচক কর্মের প্রতিফলন মোটা দাগে তুলে এনেছেন। প্রাসঙ্গিক চিন্তাভাবনায় স্বমহিমায় ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছেন। অপরিসীম মমত্ব ও কর্তব্যবোধে চেতনার গভীরতম প্রদেশে অধিষ্ঠিত করেছেন মানবিকতাকে।

নিজের চৈতন্যে সঞ্চারিত করেছেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের মানবিক চেতনার প্রতিধ্বনি। করোনাকালে গভীর বিষণ্নতাবোধের সময়েও নিজের নেতৃত্বাধীন পুলিশ বাহিনীর অক্ষয় ত্যাগের কথা স্মরণ করেছেন নিজের বিনয়ী কন্ঠে, বারংবার। বলেছেন, ‘মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করলে মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায়। এর প্রমাণ করোনাকালে পুলিশ পেয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রীর সফল উদ্যোগে করোনা মোকাবিলা
বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের এক বছর পার হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফল উদ্যোগ ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্ব এবং দেশের জনগণের সার্বিক সহযোগিতায় আমরা করোনা মোকাবিলায় সক্ষম হয়েছি-এমন মন্তব্য পুলিশপ্রধানের।

তিনি বলেন, ‘করোনা মোকাবিলায় যে ৮টি দেশ সাফল্য দেখিয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। করোনা মোকাবিলায় সাফল্যের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ প্রথম। আবার, করোনার টিকা পাওয়া ২২টি দেশের তালিকায়ও রয়েছে বাংলাদেশ।’

ড.আহমেদ আরও বলেন, ‘এ পর্যন্ত দেশের ৪৫ লাখ মানুষ করোনার টিকা নিয়েছেন। করোনারি টিকা নিলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হয়। আমাদের দেশের লোকসংখ্যা ১৮ কোটি। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রম গতিশীল হওয়ার সাথে সাথে করোনা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় শিথিলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।’

প্রতিদিন গড়ে আক্রান্ত হচ্ছে এক হাজার মানুষ
আইজিপি বলেন, আমরা আকস্মিকভাবে বর্তমানে করোনা সংক্রমণে ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করছি। প্রতিদিন গড়ে প্রায় এক হাজার মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছে। আমাদেরকে করোনা সংক্রমণ মোকাবেলা করতে হবে। আবার, দেশের অর্থনীতিও সচল রাখতে হবে। আমরা চাই না, অনাকাঙ্খিতভাবে কেউ অসুস্থ হোক অথবা কারো মৃত্যু হোক। এজন্য করোনা মোকাবিলায় প্রত্যেককে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় অবশ্যই মাস্ক পরতে ভুলে না যাওয়ার জন্য সকলের প্রতি আন্তরিক অনুরোধও জানান তিনি।

অর্থনীতি-জীবন চালিয়ে যেতে হবে, মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধিও
এদিন সংবাদ সম্মেলনে পুলিশপ্রধান জনসাধারণের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘কখনোই মাস্ক নিয়ে আসতে ভুলবেন না, ঘর থেকে বেরুনো মানেই মুখে মাস্ক। অর্থনীতি ও জীবন চালিয়ে যেতে হবে, পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধিও মানতে হবে।’

সমাবেশ-গণজমায়েতের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এগুলো পরিহার করাই ভালো। একান্তই যদি করতে হয় তাহলে অবশ্যই অনুমতি নিবেন এবং কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করবেন।’

লকডাউনের সম্ভাবনার বিষয়ে জানতে চাইলে ড.বেনজীর আরও বলেন, ‘পরিস্থিতি বিবেচনা সাপেক্ষে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ মূহুর্তে মাস্ক ও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। বেপরোয়া চলাফেরা কঠোরভাবে পরিহার করতে পারলে আমরা করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবো। আর বেপরোয়া চলাফেরা অব্যাহত থাকলে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতে মোড় নিতে পারে।’

করোনায় দায়িত্বের বাইরে গিয়ে গণমানুষের সঙ্গে ছিলাম
ড.বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘গত বছরের শেষ থেকে এই বছরের শুরুতে করোনা পরিস্থিতি মোটামোটি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কিন্তু চলতি মাসে আবারও করোনার উর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকেই পুলিশ কখনোই দায়িত্ব থেকে পিছপা হয়নি, বরং দায়িত্বের বাইরে গিয়ে গণমানুষের সঙ্গে ছিলাম।

দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে ৮৭ জন পুলিশ সদস্য মৃত্যুবরণ করেছেন আর আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ২০ হাজার সদস্য। এবারও আমরা গণমানুষের সঙ্গে মিলে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় দায়িত্ব পালন করতে চাই।’

অবহেলা-অবজ্ঞা করে করোনা থামানো যাবে না
ড.বেনজীর জানান, ‘গত এক বছরের মধ্যে করোনায় ফেব্রুয়ারিতে সবচেয়ে কম আক্রান্ত ছিল। মার্চে আবার ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে। এ পর্যন্ত ৪৬ লাখ মানুষ টিকা নিয়েছেন, তবে এটা প্রথম ডোজ। এক ডোজে করোনা প্রতিরোধ সম্ভব না, দুই ডোজ লাগে। অবহেলা ও অবজ্ঞা করে করোনা থামানো যাবে না।

তিনি বলেন, ‘সবাইকে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। মাস্ক পরতে হবে, সাবান দিয়ে বারবার হাত ধুতে হবে। প্রয়োজনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখতে হবে। জনসমাগম বা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় গেলে সেখান থেকে বাসায় ফিরে কাপড় খুলে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।’

করোনার দ্বিতীয় ধাপে পুলিশের যতো উদ্যোগ
করোনা প্রতিরোধে পুলিশের নির্দেশিকা বিতরণ; বাংলাদেশ পুলিশের লোগো সম্বলিত ফ্রি মাস্ক বিতরণ; করোনার ভ্যাকসিন গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণ; সচেতনতামূলক মাইকিং, লিফলেট ও পোস্টার বিতরণ; সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখা; করোনায় মৃত্যুবরণকারীদের দাফন; পুলিশের অব্যবহৃত স্থাপনা আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে রূপান্তর, ইমিগ্রেশন পুলিশ কর্তৃক বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তিদের শনাক্তকরণ ও কোয়ারেন্টাইনে প্রেরণ; জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর মাধ্যমে করোনা সংক্রান্ত আগত কলের সাড়া প্রদান; পুলিশ হাসপাতালে পিসিআর ল্যাব স্থাপন করে কোভিড পরীক্ষা ও চিকিৎসা প্রদান; পুলিশ হাসপাতালে পুলিশ ব্যতীত অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের চিকিৎসা সেবা প্রদান উল্লেখযোগ্য।

কালের আলো/এমএএএমকে