জেলহত্যা : বাতাসে এখনও নাগিনীর বিষাক্ত নিঃশ্বাস

প্রকাশিতঃ 11:05 am | November 03, 2020

বিভুরঞ্জন সরকার :

পঁচাত্তরের আগস্ট ও নভেম্বর ট্র্যাজেডি বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করেছিল, সাড়ে চার দশকেও তা পূরণ করা সম্ভব হয়েছে বলে দাবি করা যাবে না। আজ দেশে যে হিংসার রাজনীতি দানবের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তার বীজ রোপিত হয়েছে পঁচাত্তর-হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যার বিচার সম্পন্ন করে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে।তবে রাজনীতি এখনো ষড়যন্ত্র মুক্ত হয়নি। নাগিনীর বিষাক্ত নিঃশ্বাস এখনও বাতাসে ছড়িয়ে আছে। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সংঘটিত হয়েছিলো বর্বরোচিত ও নারকীয় হত্যাকাণ্ড। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত চার সহযোগী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে নৃশংসভাবে জেলের ভেতর হত্যা করা হয়েছিলো। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন বর্বরতা নজিরবিহীন। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়েই খুনিচক্র এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলো।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের রাজনীতির গতিমুখ পরিবর্তনের সূচনা হয়। একাত্তরের পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে, দেশের রাজনীতিকে প্রগতিবিমুখ ও পাকিস্তানমুখী করে প্রতিশোধ গ্রহণ করেছিলো। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে কয়েকজন সেনা সদস্য প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্ব দিলেও এর পেছনে ছিলো দেশি-বিদেশি নানা শক্তি। আওয়ামী লীগের ভেতরেই ছিলো ঘাতকদের সহযোগীরা। কয়েকজন মাথা গরম জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা আকস্মিক হঠকারিতাবশত ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছিলো, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। এটা পূর্ব পরিকল্পিত এবং সে কারণই ছিলো অনিবার্য।

বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে, তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বসভায় মাথা তুলে দাঁড়ালে যাদের গায়ে জ্বালা ধরতো তারা শুরু থেকেই সুযোগের সন্ধানে ছিলো। আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই বিশ্বাসঘাতক বাছাই করা হয়েছিলো। খন্দকার মুশতাক, কে এম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম, তাহের উদ্দিন ঠাকুররা একদিনে তৈরি হয়নি। তারা যে তলে তলে সর্বনাশের তালে ছিলেন, সেটা বঙ্গবন্ধুও জানতেন। তবে তিনি তাদের ষড়যন্ত্রকে খুব পাত্তা দিতেন না। বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত উদার মনের এক অতি মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ। তিনি নিজে ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন না। কোনো ষড়যন্ত্রকারী তার কোনো ক্ষতি করতে পারে সেটাও তিনি বিশ্বাস করতেন না। কোনো বাঙালি তাকে হত্যা করবে, এটাও ছিলো তার ধারণাতীত। তার এই মানবিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে ঘাতকরা। ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতির ধারাকে তছনছ করে দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার ঘটনায় গোটাদেশ বিহŸল হয়ে পড়েছিলো। বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরাও ছিলো হতভম্ব এবং বিভ্রান্ত। খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট হওয়ায় এবং বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার প্রায় সবাই মোশতাককে সমর্থন করায় সাধারণ মানুষ ছিলো দিশাহীন। খুনিরা অতি সহজে সব কিছু নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়। তবে খুনি মেজরদের দৌরাত্ম্যে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে সেনাবাহিনীর মধ্যে তৈরি হচ্ছিলো বিরূপতা। সেনাবাহিনীতে চেইন অফ কমান্ড ফিরিয়ে আনার তাগিদ অনুভব করতে থাকেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং দক্ষ ও পেশাদার সেনা কর্মকর্তা। তার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সময় গড়ে উঠেছিলো এক দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনী। খালেদ মোশাররফ হয়তো আশা করেছিলেন তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য ‘কিছু একটা’ করবেন। কিন্তু অচিরেই তিনি বুঝতে পারেন নতুন সেনা প্রধান জিয়াউর রহমানকে তিনি সঙ্গে পাবেন না।

জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন উচ্চাভিলাষী মানুষ। তার মধ্যে ছিলো একধরনের অহংবোধ। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগে থেকেই পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে জিয়ার যোগাযোগ ছিলো এবং হত্যা-পরবর্তী সময়ে ওই খুনি মেজরদের সহযোগিতায় উপরে ওঠার স্বপ্নও তিনি দেখতে থাকেন। জিয়াকে সামনে রেখে খুনি মেজরদের নিবৃত্ত করা সম্ভব হবে না এই উপলব্ধি থেকে খালেদ মোশাররফ নিজে সেনা প্রধান হওয়ার কথা ভাবেন। তিনি জিয়াকে অন্তরীণ করেন। রাষ্ট্রক্ষমতা সরাসরি নিজের হাতে না নিয়ে খন্দকার মোশতাককে চাপ দিয়ে খুনি মেজরদের বাগে আনার পথ গ্রহণ করেন। তিনি বঙ্গভবনে মোশতাককে যখন ক্ষমতাহীন করতে ব্যস্ত, তখন খুনিরা জেলহত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে ফেলেছে। রাষ্ট্র ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে যাতে আবার চলে না যায়, সাংবিধানিকভাবে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যাদের হাতে ক্ষমতা যাওয়ার কথা তাদের পৃথিবী থেকে বিদায় করার নিষ্ঠুর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন খন্দকার মোশতাক এবং তার খুনে সহযোগীরা। জেলে চার নেতাকে হত্যা করে খুনি মেজররা নিরাপদে দেশ ত্যাগ করেন।

সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি অত্যন্ত ঘোলাটে হয়ে ওঠে। নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ১৫ আগস্টের পর থেকে সেনাবাহিনীর ভেতর সক্রিয় ছিলো জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। কর্নেল তাহের ছিলেন এই সংস্থার প্রধান। ১৫ আগস্টের খুনিদের সঙ্গে কর্নেল তাহেরের যোগাযোগ ছিলো বলে শোনা যায়। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করতে থাকেন কর্নেল তাহের। খালেদ মোশাররফ সেনা প্রধানের দায়িত্ব নেন, কিন্তু তার উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনার কথা দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট করে না বলায় একধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয় না। জাসদ, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা খালেদ মোশাররফকে ‘রুশ-ভারতের এজেন্ট’ হিসেবে প্রচার করে বিভ্রান্তি তৈরি করে। তার ভাই রাশেদ মোশাররফ আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ায় এবং ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে সেই মিছিলে খালেদ মোশাররফের মা অংশ নেয়ায় এটা প্রচার হয় যে ভারতপন্থী আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসছে। প্রতিক্রিয়াশীল, ধর্মান্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সব শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্ররা তখন ছিলো অসংগঠিত, বিচ্ছিন্ন এবং কিছুটা দিশাহারা।

পরিস্থিতির সুযোগ নেয় জাসদ, গণবাহিনী, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। সামরিক বাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আগেই তিনি একপ্রকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ব্রিগেডিয়ার থেকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হওয়া ছাড়া আর কিছু তিনি দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট করতে পারেননি। অথচ ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর রাত পর্যন্ত কর্নেল তাহেরের উদ্যোগে সেনানিবাসসহ বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য সভা হয়েছে। কর্নেল তাহের একটি পাল্টা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি সৈনিকদের অস্ত্র হাতে বেরিয়ে আসার আহŸান জানিয়েছিলেন। বাইরে অপেক্ষা করবে জাসদ সমর্থক শ্রমিক-ছাত্ররা আর সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসবে সশস্ত্র সৈনিকরা। এভাবেই সৈনিক-জনতার অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করেছিলেন কর্নেল তাহের। কিন্তু খালেদ মোশাররফ আসলে কী করতে চেয়েছিলেন, তিনি কী বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচারের আওতায় আনতে চেয়েছিলেন, নাকি সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তা কারও পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি।

দীর্ঘ অপেক্ষার পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কয়েক দফায় সরকার গঠন করায় পর্যায়ক্রমে বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং জেলহত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজনের শাস্তি কার্যকর হয়েছে। কয়েকজন পালিয়ে আছে। জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ কিছুটা সুগম হয়েছে। তবে পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য পরিকল্পনাকারীরা এখনও কোনো পূর্ণাঙ্গ তদন্তের মাধ্যমে শনাক্ত না হওয়ায় রাকনীতিতে এখনও মুখোশধারীদের আনাগোনা বন্ধ হয়নি। তাছাড়া নভেম্বর ট্রাজেডির একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফ হত্যার বিচারও হয়নি।

জেলহত্যা দিবসের করুণ ও দুঃখজনক স্মৃতি আমাদের কাতর করে, বিষণ্ণ করে। আমাদের রাজনীতিতে হত্যা-ষড়যন্ত্রের যে ধারা তৈরি হয়েছিল তার বীজ সমূলে উৎপাটিত হয়েছে বলেও মনে হয় না। কারো কারো উদাসীনতা ও অবহেলা অনেকের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়। তাই আর উদাসীনতা ও অবহেলা নয়। রাজনীতি থেকে সব ধরনের হিংসার উপাদান ঝেটিয়ে বিদায় করতে হবে। একদদিকের জঞ্জাল পরিষ্কার করতে না করতেই অন্যদিকে জঞ্জাল জমছে। যে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং সব শ্রেণি-পেশা ও ধর্ম-বর্ণের মানুষের জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, আজ আমরা বেদনার সঙ্গে লক্ষ করছি তার বিপরীত যাত্রা। ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। কারো কারো মধ্যে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। গুজব ছড়িয়ে নির্দোষ মানুষ পিটিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে। এমন নৃশংসতা কি জেল হত্যার চেয়ে কম মর্মান্তিক। সব ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, অপরাধীদের শাস্তির আওতায় এনে বাংলাদেশকে সব মানুষের বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। না হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে অহংকার করার নৈতিক শক্তি আমরা হারিয়ে ফেলবো।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।