প্রধানমন্ত্রী ফোন দিয়ে আইসস্ক্রিম ডিলারের অভিযোগ
প্রকাশিতঃ 10:22 pm | May 28, 2019

কালের আলো ডেস্ক:
আইসক্রিমের বিচার গড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত। কাজী ফুডস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং প্রতিষ্ঠানটির আইসক্রিমের সাবেক ডিলার মো. রফিকুল ইসলামের মধ্যে এই বিবাদ চলছে বছর তিনেক ধরে। রফিকের দাবি, প্রতিষ্ঠানটি তার ২১ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে। কাজী ফুডসের দাবি, রফিক আদতে একজন প্রতারক। তার কাছে তাদের ১৬ লাখ টাকা পাওনা।
এ বিবাদের সালিশ হয়েছে ময়মনসিংহের বিলুপ্ত পৌরসভায়। পাওনা টাকার দাবিতে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নালিশ করেন রফিক। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর ফোন নম্বরে কল করে তার কাছে ‘পুরো ঘটনা’ তুলে ধরেন এই আইসক্রিম বিক্রেতা। রফিকুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথোপকথনের রেকর্ডও দিয়েছেন।
কথোপকথনটির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সাজ্জাদুল হাসান। গত বছর তিনি প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ ছিলেন
কথোপকথনে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শোনা যায়, তিনি রফিকের বিবাদ সমাধানে সাজ্জাদুল হাসানকে বলে দেবেন। সাজ্জাদুল হাসান বলেছেন, তিনি ময়মনসিংহের ডিআইজি ও জেলা প্রশাসককে বলে দিয়েছিলেন রফিকের বিষয়টি সমাধানে। কিন্তু রফিক তার দাবির সপক্ষে কাগজপত্র দেননি। এরপর কী হয়েছে, তা তার জানা নেই।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোন কথোপকথনে রফিককে বলতে শোনা যায়, কাজী ফুডস তার পাওনা ২১ লাখ টাকা দিচ্ছে না। তার ওপর সন্ত্রাসী হামলা করেছে। ময়মনসিংহের রাজনীতিবিদ এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ নালিশ করেও তিনি বিচার পাননি। ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র ইকরামুল হক টিটু, ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেছেন, রফিক নালিশ নিয়ে এসেছিলেন। এরপর কী হয়েছে, তা জানেন না।
কথোপকথনে প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে সহানুভূতি ও সহায়তার আশ্বাস শোনা যায়। তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘টাকা পাইলে অবশ্যই টাকা দিতে হবে।’ শেখ হাসিনা আশ্বস্ত করে বলেন, ‘আমি বলে দিবোনে। দেখি কী করা যায়।’ রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রী খুবই ব্যস্ত। তারপরও তাকে সময় দিয়েছেন। তিন মিনিট ৩২ সেকেন্ড কথা বলেছেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বলে দিয়েছেন বিচার করে দিতে। তারপরও তিনি বিচার পাননি।
রফিক বলেন, ‘এত ছোট্ট ঘটনা প্রধানমন্ত্রীরে তো বারবার বলা যায় না। তার তো দ্যাশ চালাইতে অয়। উনি অফিসারদের কইয়া (বলে) দিছেন। তারপরও কাজ হয় না। প্রধানমন্ত্রীর কী দোষ! দোষ আমার কপালের।’
তবে কাজী ফুডসের কর্মকর্তাদের দাবি, রফিক অসহায়ত্বের গল্প বলে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সহানুভূতি আদায় করে টাকার জন্য তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন। টাকার জন্য প্রধানমন্ত্রী, পুলিশের মহাপরিদর্শক এবং রাজনৈতিক নেতাদের কাছে গেলেও রফিক কেন মামলা করছেন না। অবশ্য এর জবাবে রফিকের দাবি, তিনি গরিব। মামলা করে এত বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পারবেন না। তাই মামলায় যাচ্ছেন না।
রফিকের সঙ্গে বিবাদ সম্পর্কে বক্তব্য জানতে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক কাজী রেজাউল হাসান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর আহমেদ চৌধুরীর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। প্রতিবারই জানানো হয়, তারা ব্যস্ত। সময় করে তারাই যোগাযোগ করবেন । কিন্তু তারা দেড় মাসেও যোগাযোগ করেননি।
রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, একসময় তিনি বাক্সে ফেরি করে আইসক্রিম বিক্রি করতেন। এরপর ‘আল্লাহর দান’ নামে আইসক্রিম উৎপাদন শুরু করেন। তারপর সেভয় আইসক্রিমের ডিলারশিপ পান। সেভয় বন্ধ হয়ে গেলে ২০১৪ সালে কাজী ফুডসের বেলেসিমু ও জাএনজি আইসক্রিমের ডিলারশিপ নেন। দুই বছরে প্রায় তিন কোটি টাকার আইসক্রিম বিক্রি করেন তিনি।
রফিকের দাবি, তার উন্নতিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে ডিলারশিপ বাতিল করে দেন কাজী ফুডসের কর্মকর্তারা। তবে কাজী ফুডসের কর্মকর্তা বলেছেন, এ দাবি ডাহা মিথ্যা। কারণ, কোনো প্রতিষ্ঠান বেশি বিক্রি করতে পারলে এমন ডিলারকে বাদ দেওয়া হয় না। রফিককে বাদ দেওয়া হয়, কারণ তিনি কোম্পানির তরফ থেকে দোকানিদের দেওয়া প্রণোদনার টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
রফিক জানান, বন্ধ হয়ে যাওয়া সেভয় আইসক্রিমের আটটি ফ্রিজ পেয়েছিলেন তিনি। তার অভিযোগ, সেগুলো চুরি করে কাজী ফুডস। মামলা করে তিনটি ফ্রিজ ফেরত পেয়েছেন। ডিলারশিপ নেওয়ার সময় জামানত বাবদ যে টাকা দিয়েছিলেন, তাও ফেরত পাননি। আরও ১৩টি ফ্রিজ আটকা রয়েছে কাজী ফুডসের কাছে।
রফিকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মাসিক ১২ হাজার টাকা ভাড়ায় কাজী ফুডস তাকে একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পিকআপ (ঢাকা মেট্রো-১৭-২৩৯৩) দিয়েছিল। এর জন্য তিনি ভাড়া বাবদ আগাম আট লাখ টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু পাঁচ মাস ব্যবহারের পর পিকআপটি নিয়ে নেয় কাজী ফুডস। বাকি সাত লাখ ৪০ হাজার টাকা ফেরত পাননি। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কাছে তার পাওনা ২১ লাখ টাকা।
তবে কাজী ফুডসের দাবি, আট লাখ নয়, গাড়ির জন্য ছয় লাখ টাকা দিয়েছিলেন রফিক, যা ২০১৬ সালে ১ এপ্রিল সই হওয়া চুক্তিনামায় উল্লেখ রয়েছে। তবে রফিকের দাবি, তিনি কাজী ফুডসের পূবালী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে গাড়ির জন্য ২০১৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রথমে ছয় লাখ টাকা দেন। এরপর তার কাছে আরও দুই লাখ টাকা দাবি করা হয়। চুক্তি সইয়ের তিন সপ্তাহ আগে ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ ওই দুই লাখ টাকা দেন তিনি।
গত ১১ এপ্রিল কাজী ফুডসের আইসক্রিম বিভাগে কর্মকর্তাদের সঙ্গে রফিক ও তাদের বিবাদ নিয়ে কথা হয়। প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) রফিকুজ্জামান আইন শাখার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। উপমহাব্যবস্থাপক (আইন) চিত্তরঞ্জন দাস বিস্তারিত জানাতে এক সপ্তাহ সময় নেন। এক সপ্তাহ পর যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, রফিকের কাছেই তারা টাকা পাবেন। কত টাকা পাবেন, তা হিসাব করে পরে জানাবেন। গত ৩০ এপ্রিল তিনি দাবি করেন, রফিকের কাছে তাদের পাওনা ১৮ লাখ ৮৬ হাজার ১৪৪ টাকা। পরের দিন তিনি দাবি করেন, ১৬ লাখ ৩১ হাজার টাকা পাওনা।
গাড়ির জন্য বাড়তি দুই লাখ টাকা দেওয়ার যে অভিযোগ রফিক করছেন, তা সঠিক নয় বলেও দাবি করেছেন চিত্তরঞ্জন। এ কর্মকর্তা দাবি করেন, রফিক তাদের ৯ লাখ টাকার দুটি চেক দিয়েছিলেন। এগুলো বাউন্স হওয়ায় তার বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতির মামলা করেছেন। তবে রফিকের দাবি, ডিলারশিপ নেওয়ার সময় তার কাছ থেকে এ দুটি খালি চেক নেওয়া হয়েছিল। সব ডিলারের কাছ থেকেই এ রকম নেওয়া হয়। পরে তা ব্যবহার করে মামলা দেওয়া হয়। চিত্তরঞ্জন বলেছেন, এ অভিযোগ সঠিক নয়। শুধু রফিক নন, ৫৪ ডিলারের বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতির মামলা চলছে।
ফ্রিজ চুরির অভিযোগের বিষয়ে চিত্তরঞ্জন বলেন, কাজী ফুডসের ময়মনসিংহের আঞ্চলিক বিক্রয় প্রতিনিধি ইমরান হোসেনের সঙ্গে বন্ধুত্বের সুবাদে তার জিম্মায় ফ্রিজ রেখেছিলেন রফিক। পরে চুরির অপবাদ দিয়ে ইমরানকে জেল খাটান রফিক। ইমরানের দাবি, সুসম্পর্কের কারণে রফিকের ফ্রিজ নিজ জিম্মায় রেখেছিলেন। তবে রফিকের দাবি, ফ্রিজ চুরিই হয়েছিল। আদালতে ফ্রিজ চুরির বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে।
রফিকের সঙ্গে কাজী ফুডসের বিরোধ কেন? এ প্রশ্নে চিত্তরঞ্জন বলেন, রফিক খুব ভালো ডিলার ছিলেন। দুই বছরে কয়েক কোটি টাকার আইসক্রিম বিক্রি করেন। কিন্তু একপর্যায়ে তিনি কাজী ফুডসের গাড়ি ও জনবল ব্যবহার করে নিজের উৎপাদিত ‘আল্লাহর দান’ আইসক্রিম বিক্রি শুরু করেন। দোকানদারদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার শুরু করেন। এ কারণে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতে শুরু করে। তাই তাকে বাদ দেওয়া হয়।
রফিকের বিরুদ্ধে করা ১৬ জন বিক্রেতার অভিযোগের চিঠি দেখান চিত্তরঞ্জন। তবে প্রতিটি চিঠির ভাষা ও হাতের লেখা একই ব্যক্তির। একজন অভিযোগকারী আবদুর রহিমের সঙ্গে যোগাযোগ করে । তিনি জানান, কাজী ফুডসের একজন কর্মকর্তা তার কাছ থেকে আবেদনপত্রে সই নিয়েছেন। তাতে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল কি-না, জানেন না। এ অভিযোগের জবাবে চিত্তরঞ্জন বলেছেন, তিনি এ বিষয়ে জানেন না।
কালের আলো/আরএ/এইচএ