নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে ইসিকে একগুচ্ছ পরামর্শ সাবেকদের
প্রকাশিতঃ 6:27 pm | October 07, 2025

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে একগুচ্ছ পরামর্শ দিয়েছেন সংস্থাটির সাবেক কর্মকর্তারা। তারা বলেন, নিরপেক্ষতা ও প্রশাসনিক প্রস্তুতিই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মূল চাবিকাঠি।
ভোটের আগে লোকবল নিয়োগে স্বচ্ছতা, মাঠ প্রশাসনে দলীয় প্রভাবমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি এবং নির্বাচনের দিন দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে এখন থেকেই পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক কর্মকর্তারা।
মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) সকালে আগারগাঁওস্থ নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংলাপে এমন পরামর্শ দেন ইসির সাবেক কর্মকর্তারা। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন।
এসময় অন্য চার নির্বাচন কমিশনারসহ ইসির উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। নির্বাচন বিশেষজ্ঞের মধ্যে এতে ছিলেন- ইসির সাবেক কর্মকর্তা মো. জকরিয়া, পর্যবেক্ষক সংস্থা ফেমার প্রেসিডেন্ট মনিরা খান, ইসির সাবেক কর্মকর্তা খন্দকার মিজানুর রহমান, মো. নুরুজ্জামান তালুকদার, মিহির সারওয়ার মোর্শেদ, শাহ আলম, মীর মোহাম্মদ শাহজাহান, মিছবাহ উদ্দিন আহমদ, মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী, মাহফুজা আক্তার।
ইসির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. জকরিয়া জানান, ইসির একার পক্ষে এ কর্মযজ্ঞ সম্ভব নয়। ইসির কর্মকর্তা রয়েছে আড়াই হাজার, কিন্তু নির্বাচনে দরকার প্রায় ১০ লাখ লোকবল। সব ধরনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ভোটের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে। তাদের নিয়োগের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা দেখতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান রয়েছে একেবারে দলীয়। ইসলামী ব্যাংক বা এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে লোকবল নিয়োগ করা হয়নি। এবারও এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। গত তিনটি নির্বাচনে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের এভয়েড করতে হবে, যাতে নির্বাচন অহেতুক প্রশ্নবিদ্ধ না হয়।’
সাবেক এ কর্মকর্তা ২০০৭ সাল পযন্ত ইসিতে কর্মরত ছিলেন। বর্তমান ইসির আমলে কারিগরি কমিটিতেও যুক্ত রয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘বৈধ ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে, সীমান্ত পথে আসা অস্ত্র, নকল টাকা বন্ধ, সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনা, কালো টাকা নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে ইসিকে তৎপর হতে হবে। সরকার ও ইসির দৃশ্যমান নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। মাঠ প্রশাসন, বেসামরিক প্রশাসন দলীয় মুক্ত করতে হবে, সরকারকে এ ধরনের উদ্যোগ নিতে বলতে হবে ইসিকে।’
সাবেক এ কর্মকর্তা জানান, ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সচিব থেকে ওসি পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। যাতে মানুষের মধ্যে নিরপেক্ষতা ধারণা জন্মে। এবারও কিছু সংখ্যক কর্মকর্তাকে যেন বদলি করা হয়।’
মব ভায়োলেন্স, এআই অপব্যবহারের মতো নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইসির তৎপরতা, ভোটদানে কম সংখ্যক ভোটার দিয়ে ভোটকেন্দ্র করা, জনসচেতনতার জন্য প্রচারণা, নির্বাচন কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা কিছুদিনের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আনা, ভোট পাহারা কমিটি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পাহারায় স্থানীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে পাহারা কমিটি করা যায় কি না, চিন্তাভাবনা করতে হবে। ইসির নিজস্ব কর্মকর্তা এখন অনেক, তাদেরকে যদি অল্প সময়ের জন্য ম্যাজিস্ট্রিয়াল পাওয়ার দিয়ে নিয়োজিত করা যায়, ফলপ্রসু হতে পারে।’
ইসির সাবেক যুগ্মসচিব খন্দকার মিজানুর রহমান জানান, ‘৩৩ বছরের চাকরিকালে ১১টি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ইসির জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল, ভিন্ন পরিস্থিতিতে আসায় এবার সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান ইসি আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা করছেন। পোস্টাল ব্যালট প্রবাসীদের জন্য কাযকরী করার জন্য প্রথমবার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন, সফল হবেন আশা করি। এটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে।’
বাস্তবতা বিবেচনায় এক জেলায় একাধিক রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ ও তফসিলের সময় বাড়ানোর সুপারিশ করেন তিনি।
মিজানুর বলেন, ‘৪৫ দিনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে অতীতে। পোস্টাল ব্যালটের সুবিধার্থে তফসিলের সময় বাড়ানো হলে ভালো হবে। যাতে ব্যালট পেপার ছাপানো ও পৌঁছানোর সুবিধার্থে বেশি সময় নিয়ে তফসিল দেওয়া যেতে পারে।’
নির্বাচনি তদন্ত কমিটির তৎপরতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আচরণবিধি যথাযথ প্রতিপালনে বাধ্য করা, নির্বাচন কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রিয়াল পাওয়ার দেওয়া, বিধি ভঙ্গ করলে ইসির শক্ত অবস্থান নেওয়া, দক্ষ কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।’
সাবেক ইসি কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জমান তালুকদার জানান, ‘ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দিতে হবে। সেক্ষেত্রে ইসির সরাসরি নিয়ন্ত্রণসহ সব কাজ সুচারুভাবে করতে পারবেন।’
তিনি জানান, ‘নির্বাচন কমিশন, রিটার্নিং অফিসার ও প্রিজাইডিং অফিসার ভোটের প্রধান দায়িত্বে; আর বেসামরিক প্রশাসন সহায়তা করে। ইসির দক্ষ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিলে ভালোভাবে নির্বাচন আয়োজন সম্ভব।’
ইসির সাবেক উপসচিব মিহির সারওয়ার মোর্শেদ জানান, ২০০৭ সালে পোস্টাল ব্যালটের জন্য কারাগারের ৮৭ হাজার ভোটারের তথ্য সংগ্রহের পরও এগোয়নি। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের সহায়তা না করলে বেশ জটিলতায় পড়তে হবে। ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন করতে হয়েছে। ২০০৬-এর ২২ জানুয়ারির বাতিল নির্বাচনে এমন পরিস্থিতি হয়েছিল, তারা কাজ করবে না।’
পোস্টাল ব্যালটের ভোট নিয়ে হার-জিতের পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘পোস্টাল ব্যালটের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আগামী নির্বাচনে এ নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।’
ইসি কর্মকর্তাদের তৎপরতার কথা তুলে ধরে সাবেক এ কর্মকর্তা জানান, ‘১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে তফসিল চারবার পরিবর্তন হয়েছে। ২০১৪ সালে একবারও পরিবর্তন করা হয়নি। আগামীতেও দলের কথা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।’
তিনি জানান, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে ২০০৮ সালে ইসলামী ব্যাংক, সোশাল ইসলামী ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক কর্মকর্তাদের বাদ দেওয়া হয়েছিল। এবারও কর্মকর্তা নিয়োগে সতর্ক থাকতে হবে। অঙ্গীভূত আনসারদের বিষয়ে ‘দলীয়’ অভিযোগ থাকায় সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।
সাবেক আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. শাহ আলম বলেন, ‘আগামী নির্বাচন ইসির জন্য বেশ চ্যালেঞ্জের। আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। ইসিকে প্রথমে দলকে কন্ট্রোলে নিয়ে আসতে হবে। তফসিল ঘোষণার এক মাস আগে থেকে আচরণবিধি প্রয়োগ করতে হবে।‘
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচন করেছি। মাঠ প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন নিয়ম ভঙ্গ করেনি। কারণ, আমাদের কোনো প্রভু থাকে না। এবারও আমাদের প্রভু থাকবে না, ইসির ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন হবে।’
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মিছবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ইসি ভালো কাজ করছে। জনগণ এখনো ইসির উপর আস্থা আনতে পারছে না। গত তিনটা নির্বাচনের কারণে এমন হয়েছে। এ জন্য বর্তমান কমিশনকে আস্থা ফেরাতে কাজ করতে হবে।’
ঢাকার সাবেক আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা বলেন, ‘নির্বাচনি আইন-বিধি প্রতিপালন এবং নির্বাচনি পরিবেশ সুষ্ঠু রাখতে এখন থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে। আইন করে ও নির্দেশনা জারি করেই ক্ষান্ত হলে হবে না। ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদেরও যথেষ্ট সুযোগ দিতে হবে।
সবার বক্তব্য শেষে সমাপনী বক্তব্য দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। তিনি তার বক্তব্যে হুঁশিয়ারি দেন, ‘আগামী নির্বাচনে ইসির কোনো কর্মকর্তা দলীয় আচরণ করলে, তার বা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কালের আলো/এসআর/এএএন