বিএনপি ছাড়া এক মঞ্চে সব দলের নেতারা
প্রকাশিতঃ 6:48 pm | July 19, 2025

আব্দুল হামিদ, কালের আলো:
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ছাড়া অন্যসব সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতারা এক মঞ্চে উপস্থিত হন। শহীদ পরিবারসহ আমন্ত্রিত পেশাজীবীরাও ছিলেন সমাবেশে। দলটির পক্ষ থেকে এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তারাও সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। তবে বিএনপির কোনো প্রতিনিধি দল কর্মসূচিতে যোগ দেয়নি। যদিও জামায়াত আমির সমাবেশ মঞ্চে অসুস্থ হওয়ার পর তাকে দেখতে হাসপাতালে যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড.মঈন খান।
নতুন সংবিধান চান সারজিস আলম
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, আমাদের নতুন সংবিধান লাগবে। গণপরিষদ নির্বাচন লাগবে। নারীদের অধিকার ও সংখ্যালঘু ভাই-বোনদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শনিবার (১৯ জুলাই) বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশে যোগ দিয়ে তিনি একথা বলেন।
সারজিস বলেন, অভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে আমরা আরেক বছরে এসে উপস্থিত হয়েছি। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে মুজিববাদীদের ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়নি। গোপালগঞ্জে মুজিববাদীদের আস্তানা গড়ে উঠেছে। মুজিববাদের সদস্যরা এখনো বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সক্রিয়। এই মুজিববাদ একটি আদর্শ। শুধু আইনিভাবেই মুজিববাদের মোকাবিলা করা যাবে না। আমাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবেই মুজিববাদের কোমর ভেঙে দিতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু স্বৈরাচারের প্রশ্নে অভ্যুত্থানের সব শক্তি একসঙ্গে থাকতে হবে। এই বাংলাদেশে আবার নতুন করে মুজিববাদী ভারতপন্থি শক্তিগুলো এখন সক্রিয় হচ্ছে। আমাদের মতবিরোধ থাকতে পারে তবে এই বাংলাদেশে বাংলাদেশপন্থি ব্যতীত অন্য কোনো পন্থির জায়গা হবে না। এই বাংলাদেশে আর কোনো ভারতীয় আধিপত্যবাদের জায়গা হতে দেওয়া যাবে না। অন্য যে কোনো দেশের নামে বাংলাদেশ হতে দেওয়া যাবে না।
তিনি আরও বলেন, হাজারের অধিক ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছে। একটা আকাক্সক্ষা ছিল, জুলাই-আগস্টের ৫ তারিখ আমাদের যে স্বপ্ন ছিল আরেক ৫ আগস্ট আসতে চলেছে আমাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা সুশীল সরকারের ভূমিকায় চাই না। এই বাংলাদেশে খুনি হাসিনার বিচারের রায় হতেই হবে।
কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের অবদানকে ছিনতাইয়ের চেষ্টার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি
কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের জুলাই আন্দোলনের অবদানকে ছিনতাই করার যেকোনো চেষ্টার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যুদ্ধাহত কওমি শিক্ষার্থী রেদওয়ান নাবিল। জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশে বক্তৃতাকালে তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, যদি তাদের অবদানকে জাতির সামনে তুলে ধরা না হয় এবং লুণ্ঠনের চেষ্টা করা হয়, তাহলে আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটাতে পিছপা হবেন না তারা।
তিনি বলেন, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কওমি মাদরাসার ছাত্ররাও জুলাই আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে অংশ নিয়েছিল। হাসিনা সরকারের দমন-পীড়নে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেমন আক্রান্ত হয়েছে, তেমনি কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরাও কোনো অংশে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। নিজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি নিজে ১৮ জুলাই উত্তরা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলাম, টিয়ার সেলে আমার চেহারা পুড়ে গিয়েছিল, তবুও আমরা পিছপা হইনি।
হিন্দুদের সঙ্গে দুই দলের প্রতারণার অভিযোগ গোবিন্দ প্রামাণিকের
বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব ড. গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় প্রধান রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধেই হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি বঞ্চনা ও প্রতারণার অভিযোগ এনেছেন। তিনি জামায়াতে ইসলামীকে একটি আদর্শিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে উল্লেখ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি জানান। জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশে তিনি তার বক্তব্যে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব অস্বীকার করার অভিযোগ তুলে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের কাছে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে ছিলাম। ১৯৫৪ সালে যেদিন আওয়ামী লীগ গঠন হয়েছে সেদিনই তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব অস্বীকার করে। প্রতিনিধিত্বকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য নিয়েই আওয়ামী লীগ গঠন হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি তারা প্রতারণা করেছে। একইভাবে তিনি বিএনপির বিরুদ্ধেও হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি অবহেলা ও ক্ষতির অভিযোগ করে বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ফেনীর একটি উপজেলায় ২০০ জন হিন্দু নারীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে একজন আদিবাসী কিশোরীকে চারজন বিএনপি কর্মীর দ্বারা ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এদের কোনো বিচার হয়নি।
ঢাকায় জাতিসংঘের অফিস নিয়ে সমালোচনা আখতারের
বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় স্থাপনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমালোচনা করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশের জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অফিস হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার বাইরে রেখে অন্তর্বর্তী সরকার এ সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশে যোগ দিয়ে তিনি বলেন, মৌলিক সংস্কারের ভিত্তিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ নতুন একদিনের প্রত্যাশা করে, যে নতুন দিনে সব পক্ষ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কাজ করবে। আখতার আরও বলেন, ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে আমরা অংশ নিয়েছিলাম। বাংলাদেশের শুধু নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। ১৮ এবং ২৪ সালের নির্বাচনে গণতন্ত্র থেকে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়নি। নির্বাচনের আগে গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য মৌলিক সংস্থার বাস্তবায়ন করতে হবে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি ভিপি নুরুল হক নুরের
অনতিবিলম্বে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। একই সঙ্গে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অংশীদারদের কারও কারও সমালোচনা করেন তিনি। জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশে তিনি বলেন, ‘হাদিসে আছে বিপদ কেটে গেলে মানুষ উৎফুল্ল হয়, আনন্দিত হয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি অভ্যুত্থানের অংশীদাররা উৎফুল্ল হয়ে জালিম হয়ে উঠছেন। তাই বলতে চাই, আল্লাহ পাক কিন্তু ছাড় দেবেন না।’
সরকারের সমালোচনা করে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি বলেন, গত ১১ মাস ধরে স্থানীয় সরকারে কোনো প্রতিনিধি নেই। মানুষের চরম ভোগান্তি। তাই অনতিবিলম্বে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিন। জামায়াত নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা যেহেতু ইসলামের রাজনীতি করেন, ইসলামের মূল্যবোধ নিয়ে কথা বলেন। আপনারা জানেন আল্লাহ মানুষকে ধন-সম্পদ দিয়ে এবং নিয়ে পরীক্ষা করেন। গত ১৬ বছরে মহান আল্লাহ আমাদের অনেক কিছু নিয়েছিলেন, এজন্য মহান আল্লাহ আমাদের জুলাই উপহার দিয়েছেন।
সরকারের উদ্দেশ্যে নুরুল হক নুর বলেন, পরিবর্তন পেয়েছি, পরিবর্তনকে টেকসই করার জন্য শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল পরিবর্তন না করে আপনারা নির্বাচনের দিকে হাঁটবেন না। নির্বাচনের আগে সব রাজনৈতিক দল যেন প্রচার প্রচারণা চালাতে পারে- সেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সরকার যদি জুলাই সনদ দিতে ব্যর্থ হয় আমরা অভ্যুত্থানের অংশীজনরা এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জুলাই সনদ ঘোষণা করবো।
নির্বাচনে চাঁদাবাজবিরোধীরাই জিতবে মন্তব্য ডা.তাহেরের
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁদাবাজবিরোধীরাই জিতবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী চায়, আগামী নির্বাচনে জনগণের জয় হোক। জনগণ যাদের ভোট দেবে, তারাই জিতবে। সোহরাওয়ার্দীর বিশাল এ সমাবেশ, মেসেজ কি পাওয়া যাচ্ছে না, কারা জিতবে? আগামীতে বাংলাদেশপন্থিরাই জিতবে, চাঁদাবাজবিরোধীরাই জিতবে, সুশাসনের পক্ষের শক্তি বিজয় হবে। শনিবার (১৯ জুলাই) বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত জাতীয় সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে তাহের বলেন, ‘বাইরে সভা করেন, সমাবেশ করেন। বলে বেড়ান সংস্কার মানি। অথচ ঐক্যমত কমিশনের মিটিংয়ে বসলে কিচ্ছু মানি না, ভাব দেখায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর দেশের জনগণ সংস্কার চেয়েছেন। তারা এখনও সংস্কার চান, সংস্কারের পরেই নির্বাচনের পক্ষে দেশের জনগণ। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল মনে করে, সংস্কার সবার জন্যই কল্যাণকর। কিন্তু যারা সংস্কার চান না, তাদের নিশ্চিয়ই বদমতলব আছে।’
জুলাই সনদ ও সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের বৈঠকগুলোতে মূলত জামায়াতকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। সমাবেশে তিনি সংস্কার কমিশনের ভেতরে-বাইরে কী হয়, তাও বক্তব্যে উল্লেখ করেন। জাতীয় নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি চালু করা প্রসঙ্গে সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, পিআর পদ্ধতিতে টাকা দিয়ে ভোট কেনার সুযোগ নেই। সেজন্য মতলব পূরণ হবে না। পিআর পদ্ধতিতে স্বচ্ছ নির্বাচনের বিরোধিতা করা মানে তারা জাতির প্রত্যাশা নিয়ে সচেতন নয়।
কালের আলো/এমএইচ/এমকে