টিপু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে সন্ত্রাসী জিসান-মানিক

প্রকাশিতঃ 12:25 pm | March 26, 2022

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ঘটনাস্থল পরিদর্শন, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, হামলাকারীর গুলিবর্ষণের ধরন, ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ, ফুটপ্রিন্ট, আলামত এবং পারিপার্শিক তথ্যসংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে তদন্তকারী কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে এমন ধারণায় পৌঁছেছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরনো দুটি হত্যাকাণ্ড, ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়ে বিরোধ, তিনটি বাজারকেন্দ্রিক চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে বাধা, এলাকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব, এজিবি কলোনিতে দলীয় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিরোধে তাঁকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানিয়েছে, ২০১৬ সালে মতিঝিল এলাকায় যুবলীগ নেতা রিজভী হাসান বাবু ওরফে বোচা বাবু খুন হন। তার বাবা টিপুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সম্প্রতি একজন মন্ত্রীকে বোচা বাবু হত্যা মামলার আসামি ওমর ফারুক সুপারিশ করান ওই মামলা থেকে তার নাম বাদ দেওয়ার জন্য। এর পক্ষে ছিলেন টিপু। এসব কারণে হত্যাকাণ্ডটি ঘটতে পারে বলে ধারণা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকা সন্দেহে ২-৩ জনকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। অপরদিকে ঘটনার পর থেকেই দুর্বৃত্তদের গ্রেফতারের চেষ্টা করছে র‌্যাব। খুনিকে শনাক্ত ও গ্রেফতারের দ্বারপ্রান্তে র‌্যাব।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, টিপু ও প্রীতি হত্যার ঘটনায় কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। খুনিদের দ্রুত গ্রেফতার করা হবে।

অপরদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল এক শোক বিবৃতিতে হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।

স্থানীয় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, কিলাররা ছিল প্রশিক্ষিত। আগে থেকেই টিপুকে রেকি করছিল। পরে প্রকাশ্যে মুহুর্মুহু গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় পথচারী কলেজছাত্রী সামিয়া আফরিন প্রীতি (২৪) গুলিতে নিহত হন। গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ টিপু ও প্রীতির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করে। চিকিৎসকরা টিপুর শরীরে ৭টি ও প্রীতির শরীরে একটি গুলির চিহ্ন পান। দুপুরে টিপুর লাশ হস্তান্তর করা হয় স্বজনদের কাছে। জুমার নামাজের পর শাহজাহানপুর এজিবি কলোনির ঈদগাহ মাঠে প্রথম জানাজা সম্পন্ন করা হয়। স্বজনরা জানিয়েছেন, ফেনীতে রাতেই টিপুর দাফন সম্পন্ন করা হবে। জানাজায় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ও ঢাকা-৯ আসনের সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীসহ শত শত নেতাকর্মী।

অপরদিকে প্রীতির জানাজা সম্পন্ন হয় মালিবাগের শান্তিবাগ জামে মসজিদে। রাতেই শাহজাহানপুর কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন করা হয়। এ ঘটনায় নিহত টিপুর স্ত্রী ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১, ১১, ১২ নম্বরের সংরক্ষিত মহিলা আসনের কাউন্সিলর (খিলগাঁও-শাহজাহানপুর) ফারহানা ইসলাম ডলি বাদী হয়ে গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে শাহজাহানপুর থানায় মামলা করেছেন। মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, চার-পাঁচ দিন আগে অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারী আমার স্বামীকে মোবাইল ফোনে হত্যার হুমকি দেয়।

পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এমএ আহাদ গতকাল এজিবি কলোনির সামনে গণমাধ্যমকে বলেন, যে মোবাইল ফোন নম্বর থেকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল, সেটি বন্ধ আছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র জানায়, মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে খুন করা হয় দুবাইয়ে আত্মগোপন করা ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম জিসান আহমেদ মন্টি ওরফে জিসান ও শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিকের নির্দেশে। ফ্রিডম মানিক বর্তমানে ভারতে আত্মগোপন করে রয়েছে বলে তথ্য রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে।

স্থানীয় সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, মূলত মতিঝিল এলাকার টেন্ডারবাজি, মার্কেট নিয়ন্ত্রণ ও বাড়ি নির্মাণের চাঁদাবাজির পুরোটাই এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন টিপু। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি ও টেন্ডারবাজির অভিযোগে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে যুবলীগ দক্ষিণের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, যুবলীগ নেতা খালেদ ও ঠিকাদার জিকে শামীম গ্রেফতার হওয়ার পর সেসবের একক নিয়ন্ত্রণ চলে আসে টিপুর হাতে। এর পাশাপাশি মতিঝিল ও পল্টন এলাকার দুই ওয়ার্ড কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ এবং আবুল হোসেনের সঙ্গে টিপু জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের টেন্ডারবাজি নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, রেলওয়ে, কমলাপুর আইসিডি ডিপো, বিদ্যুৎ ভবন ও গণপূর্তের টেন্ডারবাজির একটি কমিশন বিদেশে আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও ফ্রিডম মানিককে দিতে হতো। ৩ বছর ধরে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কাছে এসব টেন্ডারবাজির কোনো কমিশন দেওয়া হয়নি। এর জের ধরে টিপুর প্রতিপক্ষ শক্তিশালী হয়। ওই শক্তিশালী গ্রুপটিকে দিয়ে জিসান ও ফ্রিডম মানিকের টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন টিপু।

গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বেশ কিছু মোটিভ পাওয়া গেছে, সে অনুযায়ী কাজ চলছে।

গতকাল এজিবি কলোনির অগ্রণী ব্যাংকের আবাসিক এলাকায় কথা হয় টিপুর চালক মুন্নার সঙ্গে। তিনি বলেন, ঘটনার সময় একজন অপর প্রান্ত থেকে হেলমেট ও মুখে মাস্ক পরা অবস্থায় গাড়ির সামনে দিয়ে যায়। প্রথম গুলিটি জানালার কাচ ভেঙে আমার হাতে বিদ্ধ হয়ে বেরিয়ে যায়। এরপরই শুরু হয় মুহুর্মুহু গুলি। স্যার (টিপু) স্বাস্থ্যবান হওয়ায় একের পর এক গুলিতে রক্তাক্ত হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন।

কালের আলো/এসবি/এমএম