সামাজিক দূরত্ব বজায়ে কঠোর সেনাবাহিনী, বদলে গেছে দৃশ্যপট (ভিডিও)

প্রকাশিতঃ 9:26 pm | April 02, 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

সীমিত আকারে হলেও করোনাভাইরাসের ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন’ শুরু হয়েছে। আইইডিসিআরের এমন ভাষ্যে দুশ্চিন্তার ভাঁজ সবার কপালে। প্রথম থেকেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে প্রতিটি মানুষকে ঘরের ভেতরে থাকার আহ্বান উপেক্ষা করে কারণে-অকারণে ঘর থেকে বের হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়।

আরও পড়ুন: করোনার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত যুদ্ধে সেনাবাহিনী, সেনাপ্রধানের বক্তব্যে আশার সঞ্চার

এতে করে রাস্তায় হঠাৎ করেই বেড়ে যায় মানুষের চলাচল। অলিতে গলিতে প্রয়োজনের বাইরেও খোলে দোকানপাট। ক্ষণে ক্ষণেই মাঝারি মানের গাড়ি জট চলতে থাকে রাজধানীর ব্যস্ততম সড়কগুলোতে।

সামাজিক দূরত্বের নির্দেশনা ভাঙার বাতিক তৈরি হয় দেশের বিভিন্ন জেলা শহরগুলোতেও। সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

আরও পড়ুন: প্রকৃতিতে ফিরেছে প্রাণ, আতঙ্ক নয় প্রতিরোধের ডাক সেনা সদস্যদের (ভিডিও)

আরও পড়ুন: প্রখর খরতাপেও পথে পথে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে সেনাবাহিনী (ভিডিও)

বুধবার (০১ এপ্রিল) করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবেলা ও দেশের সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘এই করোনাভাইরাসকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

আমরা সৈনিক, আমরা সব সময় যুদ্ধ করতে প্রস্তুত এবং সেই প্রস্তুতি নিয়ে আমরা আছি। সবাইকে সহযোগিতা করবো।’  

আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতৃত্বে এক মোহনায় দেশ, মানুষকে ‘সুরক্ষার যুদ্ধে’ সেনাবাহিনী

একই সভাতেই মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড.খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সরকারি নিয়ম মানতে সাধারণ মানুষকে বাধ্য করার বিষয়ে ইঙ্গিত দেন। সাফ জানিয়ে দেন, চলমান এই বিশেষ ছুটিতে জনসাধারণের ঘরে থাকা নিশ্চিত করতে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন: বৃত্তের মাধ্যমে দূরত্ব চিহ্নিত; সেনাবাহিনীর কর্মযজ্ঞে দেশজুড়ে স্বস্তির সুবাতাস (ভিডিও)

এরপর ওই রাতেই আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষণা দেয়, সামাজিক দূরত্ব বজায় আর হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতে সেনাবাহিনীর কঠোর হওয়ার বিষয়ে।

আরও পড়ুন: দুই বিষয়ে বৃহস্পতিবার থেকে কঠোর হচ্ছে সেনাবাহিনী

মূলত এই ঘোষণার পরপরই দৃশ্যপট বদলে যেতে শুরু করে। গত দু’ বা তিনদিনে কোন প্রয়োজন ছাড়াই অহেতুক বাড়ি ছেড়ে সড়কে দাবড়ে বেড়িয়েছেন কিংবা পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে আড্ডা জমিয়েছেন এমন শ্রেণির মানুষজন যেন এই বার্তাতে সতর্ক হয়ে যায়।

আর এর ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায় বৃহস্পতিবার (০২ এপ্রিল) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানী তো বটেই দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় নগরী ও জেলা শহরেও। ঘর ছেড়ে বের হওয়ার পুরনো প্রবণতায় মগ্ন নাগরিকদের শৈথিল্য বা উদাসীনতারও রাশ টেনে ধরা হয়েছে।

সরকারি নির্দেশনা মানার আহ্বানের ধারাবাহিকতায় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা ও সচেতনতার জন্য দিনব্যাপী রাজধানীসহ দেশজুড়ে টহল দিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

যৌক্তিক কারণ ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়া মানুষজন কীভাবে নিজের পাশাপাশি পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের জীবনের ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছেন সেই বিষয়টিও বুঝিয়ে তাদের বাড়ি পাঠানো এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর তৎপরতায় দিনভর রাজধানীর বদলে যাওয়া দৃশ্যপট অবলোকন করেছে কালের আলো টিম।

তাদের ভাষ্য মতে, বৃহস্পতিবার (০২ এপ্রিল) সকাল সোয়া ১১ টার দিকে রাজধানীর পান্থপথ মোড়ে সাধারণ মানুষের জটলা দেখা যায়।

এরই মধ্যে সবার কানে আসে সাইরেনের আওয়াজ। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে সেনাবাহিনী হ্যান্ড মাইকে সবাইকে সচেতন করছেন এবং ঘরে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। ব্যাস, মুহুর্তেই ভেঙে গেলো জটলা।

একই রকম চিত্র চোখে পড়ে রাজধানীর কলাবাগান, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, আজিমপুর, শ্যামলী, কাওরান বাজার, নাজিরাবাজার, বনানী, বাড্ডাসহ আরও কয়েকটি এলাকায়। এসব এলাকার প্রতিটি প্রধান সড়ক পেরিয়ে, পাড়া-মহল্লার গলিতেও সেনা সদস্যদের বাড়তি তৎপরতা দৃষ্টিতে আসে।

রাজধানীর ভাষানটেক, লালবাগ, বাড্ডা ও ভাটারা ও সবুজবাগ এলাকা থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যদের পৃথক টিম তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সচেতনতার জন্য সবার উদ্দেশ্যে মাইকিং করেন।

কালের আলো টিমের আরও পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় প্রয়োজনীয় দোকানের বাইরে যেসব দোকান-পাট খোলা হয়েছে, সেসব দোকানে সেনা সদস্যরা গিয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন।

সেনাবাহিনীকে কঠোর হতে হয় এমন কোনো কর্মকান্ড না করতে সবার প্রতি সবিনয় অনুরোধ জানানো হয়।

আমাদের বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিদের নিউজরুমে পাঠানো খবরে নিজেদের এলাকায় মানুষকে যেকোনো মূল্যে ঘরে রাখার কর্মসূচি নিয়ে সেনাবাহিনীর কর্মউদ্যোগের কথা জানিয়েছেন।

‘করোনা যুদ্ধ করব জয়, ঘরের বাইরে আর নয়’ এমন প্ল্যাকার্ড হাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় এবং হোম কোয়ারেন্টিনের বিষয়টি কঠোরভাবে নিশ্চিত করেছেন।

আবার দেশের বিভিন্ন জেলায় সাধারণ মানুষকে হাত ধোয়ার জন্য সাবান বিতরণের পাশাপাশি হতদরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে মাস্ক বিতরণ করেছেন। রাস্তায় ও যানবাহনে জীবণুনাশক ওষুধ ছিটিয়েছেন।

চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা করে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী সদস্যরা কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে মানুষকে ঘরে ফেরাতে। কাউকেই সড়কে এবং অলিগলিতেও দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি।

নগরীর ষোল শহরের দুই নম্বর গেট, জিইসি, দামপাড়া, এ কে খান, সেটডিয়াম পাড়া, আন্দরকিল্লা, নিউমার্কেট, চকবাজার, দেওয়ান হাট, আগ্রাবাদসহ বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনী শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে।

ফেনী শহরের ট্রাংক রোড, দোয়েল চত্বর, খেঁজুর চত্বর ও বড় বাজারে জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটসহ অভিযান পরিচালনা করেছে সেনাবাহিনী। এ সময় তারা পথচারীদের ঘরে ফেরার জন্য অনুরোধ করেছেন।

ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করে রাখার আহ্বান করেছেন। কক্সবাজারে সকাল থেকে পূর্ণ ফাঁকা দেখা যায় শহর। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হয়নি।

মাগুরায় জেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে শহরে অবিরত চলে পরার্মশমূলক মাইকিং। বিদেশ থেকে ফিরে আসা প্রবাসীদের বাড়িতে লাল পতাকা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তাদেরকে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হতে নিষেধাজ্ঞা থাকায় শহরে জনসাধারণের আনাগোনা অনেকটা কমেছে।

কুমিল্লায় চান্দিনায় সেনাবাহিনীর দু’টি টহল টিমকে উপজেলার আনাচে-কানাচে অভিযান চালাতে দেখা গেছে। এ সময় ওষুধ দোকানে অতিরিক্ত ভিড়, দোকানে অযথা আড্ডা ও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নির্মাণ শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানোর অপরাধে ২৬ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

নির্মাণ কাজ বন্ধ করার পাশাপাশি ৭ জন নির্মাণ শ্রমিকের দৈনিক মজুরি আদায় করে শ্রমিকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে সেনাবাহিনীর টহলের পাশাপাশি হোম কোয়ারেন্টিন না মানা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখায় সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলায় ৩৫ জনকে আটক ও অর্থ দণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এছাড়া আরও ৪৩ জনকে বাড়ির বাইরে অপ্রয়োজনে আর বের না হওয়ার জন্য সতর্ক করা হয়।

নারায়ণগঞ্জে সামাজিক দূরত্ব ও হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একই চিত্র দেখা যায় বরিশালেও। এদিন যারা মাস্ক না পরে সড়কে বের হয়েছেন তাদের মাঝে মাস্ক বিতরণ করা হয়।

জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মারুফ দস্তেগীর জানান, সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে দোকান খোলা রেখে জনসমাগম করার অপরাধে পপুলার সু’হাউজকে তিন হাজার টাকা ও অন্য একটি দোকানকে ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়।

সিলেটে সেনা সদস্যরা নগরের বিভিন্ন স্থানে টহল দেয়। এ সময় মাইকিং করে মানুষকে সচেতন করা ছাড়াও নগরের বিভিন্ন স্থানে গাড়ি দিয়ে রাস্তায় জীবাণুনাশক স্প্রে করতে দেখা যায় তাদের।

কালের আলো/এমএএএমকে

Print Friendly, PDF & Email