ফকরুল ইমামকে হটিয়ে আসন চায় আ’লীগ, বাবুতে মাতোয়ারা বিএনপি

প্রকাশিতঃ 6:10 pm | February 04, 2018

পলিটিক্যাল এডিটর, কালের আলো :

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসন ভাগাভাগিতে ময়মনসিংহ-৮ (ঈশ্বরগঞ্জ) আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ফকরুল ইমাম। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবার আর আসনটি ছাড়তে নারাজ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। জাতীয় পার্টিকে হটিয়ে এ আসনে দলীয় প্রার্থী চান তাঁরা। তবে শেষ পর্যন্ত কী হবে এ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা।

অন্যদিকে, সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দল বিএনপিতে একাধিক প্রার্থী মাঠে থাকলেও শক্ত অবস্থানে রয়েছেন স্থানীয় উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি সফটওয়্যার প্রকৌশলী লুৎফুল্লাহেল মাজেদ বাবু। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির দখলে থাকা আসনটি বাবু’র কাঁধে ভর করেই পুনরুদ্ধার করতে চায় দলটির নেতা-কর্মীরা।

এ আসনটির ভোট রাজনীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে ময়মনসিংহ-৮ আসনে পরাজিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। তিন বছর পর আওয়ামী লীগের প্রার্থী আসনটিতে জয়ী হন। মূলত স্বাধীনতার পর থেকেই এ আসনে জাতীয় পার্টির জয়জয়াকার অবস্থা।

লাঙ্গল প্রতীকে চারবার এখান থেকে নির্বাচিত হয়েছেন এরশাদের জাতীয় পার্টি’র প্রার্থী। তিনবার করে জিতেছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র প্রার্থীরা।

দেখা গেছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দখলে থাকা এ আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া হয়। পরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় এখান থেকে নির্বাচিত হন দলটির প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য ফকরুল ইমাম। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনেও ইমাম এমপি হয়েছিলেন। আবার ১৯৯১ সালে আসনটিতে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন খুররম খান চৌধুরী।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১৯৯৬ সালে নৌকা প্রতীক পেয়ে এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আব্দুস সাত্তার। জাতীয় সংসদের বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদকে ওইবার তিনি ধরাশায়ী করেন। এমপি নির্বাচিত হয়ে দলের ভেতরে-বাইরে একক আধিপত্য ছিল সাত্তারের।

দলীয় কোন্দলে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি’র প্রার্থী শাহ নুরুল কবির শাহীনের কাছে তিনি পরাজিত হন। অবশ্য নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাত্তার সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেন। রেকর্ড ভোটে পরাস্ত করেন বিএনপি’র শাহীনকে।

দলীয় নেতা-কর্মীরা জানান, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি হওয়াটাই মূলত আব্দুস সাত্তারের জন্য ‘কাল’ হয়ে দাঁড়ায়। আগেরবার প্রত্যাশিত উন্নয়ন উপহার দিলেও সেইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে তিনি নিজেকে আমুল বদলে ফেলেন।

সবকিছুতেই শ্বশুরবাড়ির স্বজনদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ায় দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়। ওই সময় গোটা উপজেলায় দলের ভেতরে-বাইরেও ‘ছড়ি’ ঘোরাতে থাকেন এমপি’র শ্যালক, উপজেলা ছাত্রলীগের সেই সময়কার সভাপতি মাহাবুব। এতে করে চরম বিতর্কিত হয়ে পড়েন আব্দুস সাত্তার।

এ অবস্থায় তাকে চ্যালেঞ্জ করে ভোটের মাঠে নামেন সহোদর ভাতিজা মাহমুদ হাসান সুমন। চাচা’র নড়েবড়ে অবস্থানের সুযোগ নিয়ে দলের ত্যাগী ও বঞ্চিত নেতা-কর্মীদের নিয়ে টিমওয়ার্ক গড়ে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ভাতিজা সুমন। পরবর্তীতে জাতীয় নির্বাচনে চাচা সাত্তারের ‘পতন’ ঘটে।

দু’জনের প্রকাশ্য বিরোধে ভাগ্য ঘুরে যায় জাতীয় পার্টির নেতা ফকরুল ইমামের। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আ’লীগ জাতীয় পার্টিকে আসনটি ছেড়ে দেয়। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে হাইকমান্ড আব্দুস সাত্তারকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক করে।

অবশ্য এবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজেদের এ আসনটি ফেরত চায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। আসনটিতে চাচা-ভাতিজা ছাড়াও আ’লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে রয়েছেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৌমেন্দ্র কিশোর চৌধুরী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহিম (বিপিএম) ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের পরিচালক অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক।

স্থানীয়দের অভিযোগ, এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ফকরুল ইমামের সঙ্গে স্থানীয় জনসাধারণের বড় রকমের দূরত্ব রয়েছে। ফকরুল ইমাম কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ায় বেশিরভাগ সময় ঢাকাতেই থাকেন। ফলে সহসাই তার সাক্ষাত পায় না স্থানীয় বাসিন্দারা। এমনকি নজরকাড়া কোন উন্নয়ন কর্মসূচিও উপহার দিতে পারেননি তিনি। ফলে অনুন্নয়নের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে এখানকার ভোটাররা।

অবশ্য সংসদ সদস্য ফকরুল ইমাম ক’দিন আগে স্থানীয় উচাখিলা ইউনিয়নের আবু আখতার খান একাডেমীর বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে বলেছেন, আগামী দিনেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঈশ্বরগঞ্জে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। খুব দ্রুত স্থানীয় রাজীবপুর ইউনিয়নের চর রামমোহন মৌজায় ইপিজেডের কাজ শুরু হবে। সরকারী ব্যবস্থাপনায় এ ইপিজেড এ কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

তিনি বলেছেন, গত কয়েক বছরে তাঁর নেতৃত্বে এখানে কাঙ্খিত উন্নয়ন হয়েছে। ফলে ভোটাররা তার পক্ষেই রয়েছেন।

এদিকে, ক্ষমতাসীনদের মতো এ আসনটিতেও বিএনপি’র অন্তর্কোন্দল মারাত্নক আকার নিয়েছে। দলীয় নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করে উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি লুৎফুল্লাহেল মাজেদ বাবু দীর্ঘ সময় ধরে ভোটারদের মধ্যে কাজ করে গেলেও বাঁধ সেধেছেন দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য শাহ নুরুল কবির শাহীন।

ক্ষমতাসীন দলের কারো কারো সঙ্গে তার ‘দহরম’ অবস্থা, এমন গুঞ্জণ সর্বত্রই। বিষয়টি বিএনপি’র রাজনীতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনার শামিল বলে মনে করেন দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা।

শাহীনের এমন স্ট্যান্ডের বিপরীতে এ আসনে নিজ দল বিএনপিকে সুসংগঠিত করতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন উচ্চ শিক্ষিত ও আধুনিক মননের রাজনীতিক লুৎফুল্লাহেল মাজেদ বাবু। স্বার্থত্যাগী হয়ে দলীয় নেতা-কর্মী ও স্থানীয় জনসাধারণের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার মানসিকতা নিয়ে কাজ করছেন। দিনের পর দিন তার এমন নি:স্বার্থ সেবার মনোভাব ময়মনসিংহ-৮ (ঈশ্বরগঞ্জ) আসনের ভোটারদের মনে তার জায়গা নিশ্চিত করেছে।

তবে দলের একটি অংশের নেতা-কর্মীদের দাবি, এ আসনে অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি’র প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য শাহ নুরুল কবির শাহীনেরও জনপ্রিয়তা রয়েছে। এমপি থাকাকালীন তিনি অনেক উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করেছেন।
অবশ্য এমনটি মানতে নারাজ দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। তারা অভিযোগ করে বলেন, বিগত উপজেলা নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শাহ নুরুল কবির শাহীনের বিরোধিতার কারণে দলীয় প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন।

তাঁর প্রকাশ্য বিরোধিতার পরেও বিগত উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি থেকে সাবেক ছাত্রনেতা আমীরুল ইসলাম ভূঁইয়া মনি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। মনি বর্তমানে উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি লুৎফুল্লাহেল মাজেদ বাবু’র বলয়ে রাজনীতি করছেন। দলীয় সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদসহ দলটির ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা-কর্মীরা মাজেদ বাবু’র সঙ্গেই গাঁটছড়া বেঁধে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।

বিএনপি’র তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, উপজেলায় শাহীনের অবস্থান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ক্ষমতায় থেকে জনকল্যাণের রাজনীতির বদলে ব্যক্তিস্বার্থকেই গুরুত্ব দিয়ে রকেট গতিতে নিজের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে নেয়া, দলীয় নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন না করে মর্জি মাফিক দল ও এলাকা চালানোসহ নানা কারণে এবার তার অবস্থান একেবারেই নড়েবড়ে হয়ে উঠেছে।

এরপরেও পুনরায় কেন্দ্র তাকে মনোনয়ন দিলে আসন হাতছাড়া হবার সম্ভাবনা প্রবল। তাঁর বিপরীতে সংগ্রামী, স্বপ্নবাজ ও দৃঢ় আতœপ্রত্যয়ী লুৎফুল্লাহেল মাজেদ বাবুকে ঘিরে স্থানীয় জনসাধারণ তো বটেই দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। তাকে মনোনয়ন দেয়া হলে আসনটিতে ধানের শীষের বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না বলে মনে করেন অনেকেই।

বিএনপি থেকে এ আসনে অন্যান্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হচ্ছেন ময়মনসিংহ উত্তর জেলা যুবদল সভাপতি ও সাবেক ছাত্রদল নেতা কামরুজ্জামান লিটন, উপজেলা বিএনপি’র জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আওরঙ্গবেজ বেলাল। এছাড়া বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এম.এ বাশার।

 

কালের আলো/এএ

Print Friendly, PDF & Email