মাদক সেবন-বিক্রিতে ধনীর দুলালেরা!

প্রকাশিতঃ 9:53 am | June 26, 2021

নিজস্ব সংবাদদাতা, কালের আলো :

রাজধানীতে অবস্থা সম্পন্ন বিভিন্ন পরিবারের তরুণেরা জড়িয়ে পড়ছেন মাদকসেবনে। অনেকেই আবার জড়িয়ে পড়ছেন মাদক ব্যবসার জালেও। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

জানা গেছে, সম্প্রতি মাদক কারবারে যারা জড়িয়ে পড়ছে, তাদের মধ্যে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানের সংখ্যাই বেশি। নতুন করে আলোচনায় আসা ব্যয়বহুল মাদক আইস, এলএসডি (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড) এবং নেশাখোরদের কাছে ‘ব্রাউনি’ নামে পরিচিত গাঁজার কেকের কারবারি হিসেবে নাম উঠে আসছে ধনীর দুলালদের।

শুধু তা-ই নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে তাদের আটক করা হলে ছাড়ানোর জন্য একের পর এক ফোন-তদবির আসতে শুরু হয় প্রভাবশালীদের।

নাম প্রকাশে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছেন, মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে কাউকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।

জানা গেছে, মাদক নির্মূলে তৎপর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্প্রতি গুলশান-বনানীকেন্দ্রিক এলএসডি-আইস কারবারে সম্পৃক্ত বেশ কয়েকটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশ থেকে এসব মাদক কিনতে ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধ বিট কয়েন।

এদিকে মরণনেশা ইয়াবার বিস্তার রোধে হিমশিম খাওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে নতুন ও ব্যয়বহুল এসব মাদকের বিস্তার রোধ করা।

গুলশান-বনানীতে মাদক ব্যবসায় একাধিক চক্র
গুলশান-বনানীতে গড়ে উঠেছে আইস-এলএসডি বিকিকিনির একাধিক চক্র। এসব চক্র বিদেশ থেকে দামি মাদক এনে ছোট গ্রুপগুলোর কাছে বিক্রি করছে। এর পর এসব গ্রুপ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পৌঁছে দিচ্ছে মাদকসেবীর হাতে। এ ক্ষেত্রে হোম ডেলিভারির সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে অভিজাত এলাকায় গড়ে ওঠা বেশ কয়েকটি মাদককারবারি চক্রকে শনাক্ত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এছাড়া রাজধানীর মিরপুর ও উত্তরাকেন্দ্রিক কিছু চক্রেরও সন্ধান পাওয়া গেছে।

পুলিশ জানায়, আইস মূলত অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে এ দেশে আসছে। আইসের চালান প্রবেশ করছে থাইল্যান্ড-মিয়ানমার-টেকনাফ হয়ে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পাঠানো মাদকের চালান অনায়াসে পৌঁছে যাচ্ছে চক্রের সদস্যদের হাতে। ২০১০ সাল থেকে প্রথমবারের মতো আইসের চালান দেশে পাচারের তথ্য পাওয়া যায়। আর এলএসডি মূলত ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে সরাসরি আন্তর্জাতিক কুরিয়ারের মাধ্যমে দেশে চলে আসছে। বাংলাদেশে এলএসডি পাচারে ইউরোপের নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলোয় বড় বড় চক্র রয়েছে বলে মনে করছেন তারা।

জামিরুল চৌধুরী ওরফে জুবেইন, বয়স ত্রিশের কোটায়। তার বাবা ছিলেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। অবসরগ্রহণের পর তিনি আবাসন ব্যবসা শুরু করেন।

যুক্তরাজ্য থেকে পড়াশোনা করে দেশে ফেরা জুবেইন ক্রিস্টাল মেথ বা আইস সেবনে আসক্ত। এক পর্যায়ে জড়িয়ে পড়েন এর কারবারেও। চার বছর ধরে আইস কারবারি এ ব্যক্তি র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছেন।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছেন সেরিনা (ছন্ম নাম) নামের এক তরুণী। তিনি বলেন, প্রথমে গাঁজা ও মদের প্রতি আসক্তি থাকলেও একটা পর্যায়ে বন্ধুদের মাধ্যমে আইসের সন্ধান পান।

সেরিনার ভাষ্য, বর্তমানে ধানমন্ডিকেন্দ্রিক একটি সিন্ডিকেটের কাছ থেকে আইস কিনি। বিত্তশালী পরিবারের এই তরুণী তার বেতনের একটি বড় অংশ খরচ করে ফেলছেন মাদকের পেছনে। এ নিয়ে পারিবারিক অশান্তি তো রয়েছেই।

এ বিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, অভিজাত এলাকায় এসব মাদকের নেটওয়ার্ক এবং চালান কীভাবে আসছে এসব বিষয়ে নজরদারি চলছে।

মাদকের অর্থ পরিশোধ বিট কয়েনে
এলএসডি-আইসের মতো মাদক আসছে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে। এ ক্ষেত্রে সেসব দেশের মাদক সরবরাহকারীদের অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিট কয়েনের মাধ্যমে। বিশ্বের কিছু দেশে বিট কয়েনের প্রচলন থাকলেও বাংলাদেশে অবৈধ এই ভার্চুয়াল মুদ্রার বৈধতা নেই। মূলত ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক এসব মাদক নেটওয়ার্কে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশি তরুণরা। বাংলাদেশে বর্তমানে এক বিট কয়েনের মূল্যমান ২৭ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে এলএসডির সন্ধান পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পুলিশ সূত্র বলছে, এলএসডির ভয়াল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে ছুরি দিয়ে নিজের গলা নিজেই কেটে ফেলেন হাফিজুর রহমান। এতে তার মৃত্যু হয়। এরপরই এলএসডি মাদক নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় দেশে।

নড়েচড়ে বসে প্রশাসন; শুরু হয় অভিযান। হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনায় তার তিন বন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারাও সবাই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান।

র‌্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রেপ্তারদের বেশির ভাগ-ই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এই চক্রটি ডার্কওয়েবের মাধ্যমে যোগাযোগ করে ইউরোপের দেশগুলো থেকে এলএসডির চালান আমদানি করে; অর্থ পরিশোধ করে বিট কয়েনের মাধ্যমে।

এই মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মিশু বিশ্বাস বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া তিন তরুণই ধনী পরিবারের সন্তান। তারা মাদক কেনার ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল মুদ্রার ব্যবহার করেছিল।

গুলশান-বনানীত মাদক কারখানা
রাজধানীর গুলশান, ধানমন্ডি, বানানী ও উত্তরার মতো অভিজাত এলাকায় দামি মাদকের কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানার নেতৃত্বে থাকা অনেক তরুণ বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন।

২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জিগাতলার ছয়তলা ভবনের ভূগর্ভস্থ তলা থেকে আইস, ক্রিস্টাল মেথ ও এমডিএমএ তৈরির গবেষণাগারের সন্ধান পায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এ সময় হাসিব মো. মুয়াম্মার রশিদ নামে এক তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় হাজারীবাগ থানায় মামলা হয়।

সর্বশেষ গত সেপ্তাহে উত্তরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে আইস, ইয়াবা, অস্ত্রসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এ সময় উত্তরার একটি বাড়িতে বায়িং হাউসের ব্যবসার আড়ালে মাদকের কারখানা গড়ে তোলার সন্ধান মেলে। গ্রেপ্তার হওয়া মাদকচক্রের মূল সমন্বয়কারী তৌফিক হোসাইনের নেতৃত্বে চলত এ কারখানা।

‘ম্যাথ ল্যাব’ স্থাপন করে নতুন মাদক তৈরির চেষ্টা করছিলেন তারা। আইস ও ইয়াবার সঙ্গে ঘুমের ওষুধ ও অন্যান্য নেশাজাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ‘ঝাক্কি’ নামে এক মাদকের উদ্ভব ঘটান তারা। এ মাদকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুবই ভয়ঙ্কর।

সেবন থেকে বিক্রেতা
এলএসডি নিয়ে নতুন করে আলোচনার সৃষ্টি হলেও এ মাদকের সেবন বাংলাদেশে নতুন নয়। ২০১৯ সালে এলএসডিসহ দুই তরুণকে গ্রেপ্তার করেছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

তখন এক প্রবাসী বাংলাদেশির মাধ্যমে দেশে এলএসডি বেচাকেনার বিষয়টি জানতে পারে অধিদপ্তরের গোয়েন্দা বিভাগ। আর মাদক সেবন থেকে আস্তে আস্তে বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তরুণেরা।

এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরেরর গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. মোসাদ্দেক হোসেন রেজা বলেন, আমরা দেখেছি, এলএসডি ও আইস বিক্রি এবং সেবনে যুক্ত তরুণরা উচ্চবিত্ত শ্রেণির। কারণ এসব মাদকের দাম অনেক বেশি।

কালের আলো/ডিআরবি/এমএম