প্রধানমন্ত্রীকেও শিশু রাবেয়ার প্রশ্ন, ‘তুমি কেমন আছো?’ (ভিডিও)

প্রকাশিতঃ 7:36 pm | March 14, 2021

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

রফিকুল ইসলাম-তসলিমা বেগম দম্পত্তির ঘর আলো করে জন্ম নিয়েছিল দুই কন্যা সন্তান- রাবেয়া আর রোকেয়া। কিন্তু জোড়া লাগানো মাথা নিয়ে জন্মায় ওরা। অসহায় বাবা-মা এই দু:খে শুধু কাঁদে আর কাঁদে। গণমাধ্যমে উঠে আসে তাদের দু:খগাঁথার খবর। বিষয়টি নজরে আসে বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার।

সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে ছোট্ট একটি ক্ষুদে বার্তা পাঠান বড় বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে- ‘দেখো তাদের জন্য কিছু করা যায় কিনা।’ ব্যস, মানবিক প্রধানমন্ত্রী বাড়িয়ে দিলেন সহায়তার হাত। পাবনার চাটমোহর থেকে ঢাকায় আনা হয় ওদের। ২০১৭ সালে শুরু হলো ওদের ‘জমজ মস্তিষ্ক’ আলাদা করার কাজ।

প্রথমেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শুরু হলো ওদের চিকিৎসা। ২০২০ সালের পহেলা আগস্ট সম্পন্ন হলো ছোট-বড়ো ৪৮ টি অপারেশন। সবশেষ রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) একই বছরের ২ আগস্ট টানা ৩৩ ঘন্টার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আলাদা করা হলো শিশু রাবেয়া ও রোকেয়াকে।

২০১৯ সালের ১ আগস্ট থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৩৩ ঘণ্টা বিপদমুক্ত অপারেশন সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে সক্ষম হন চিকিৎসকরা। গত ২৭ অক্টোবর হাঙ্গেরি থেকে আগত ৪ জন চিকিৎসকের উপস্থিতিতে দেশের সামরিক ও অসামরিক চিকিৎসকদের সমন্বয়ে শিশু রাবেয়ার অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা ঢাকার সিএমএইচে চিকিৎসাধীন ছিল।

এবার এই সোনামণির ঘরে ফেরার পালা। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর মাসটিকে বেছে নেওয়া হলো এই অনাবিল আনন্দ উদযাপনের জন্য। অবশেষে রোববার (১৪ মার্চ) দুপুরে রাবেয়া ও রোকেয়ার শুভ গৃহ প্রত্যাবর্তন অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে সরাসরি অংশগ্রহণ করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাবেয়া এবং রোকেয়া সিএমএইচ থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অংশ নিলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে রোববার(১৪ মার্চ) ঢাকা সিএমএইচে ‘মুজিব শতবর্ষে রাবেয়া-রোকেয়া’র শুভ গৃহে প্রত্যাবর্তন অনুষ্ঠানে রাবেয়া ও তার পরিবারের সাথে কথা বলেন।

অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আলাদা হওয়া শিশু রাবেয়া-রোকেয়া দু’জনকেই সুস্থ মনে হয়েছে। নতুন জীবনের মাহেন্দ্রক্ষণে স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পেরে যারপরেনাই ওদেরও বেশ উচ্ছ্বসিতই মনে হচ্ছিল। রোকেয়া বসেছিলো বিশেষ চেয়ারে।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাবলীলভাবে কথা বলতে দেখা গেছে শিশু রাবেয়াকে। প্রধানমন্ত্রী যখন শিশু রাবেয়াকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কেমন আছো?’ উত্তরে ‘‘ভালো আছি’ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে শিশু রাবেয়ার একই প্রশ্ন, ‘তুমি কেমন আছো?’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই হেসে উঠলেন। প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর কাছে রাবেয়া ও রোকেয়ার জন্য দোয়াও চেয়েছেন।

রাবেয়া-রোকেয়ার ঘরে ফেরা দেশের জন্য মাইলফলক
একেতো পিতা মুজিবের জন্মশতবার্ষিকী। আবার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাসও। আর এই বিরল মুহুর্তেই সুস্থ-সবলভাবে ঘরে ফিরছেন জটিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আলাদা হওয়া শিশু রাবেয়া-রোকেয়া। এই দুই শিশুর ঘরে ফেরার পুরোপুরি কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই দিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড.আজিজ আহমেদ।

অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল ড.আজিজ আহমেদ বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে বিরল এই চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে রাবেয়া-রোকেয়া ঘরে ফিরতে পেরেছে। এতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। জাতির পিতার জন্মদিন উদযাপনের আগ মুহূর্তে রাবেয়া-রোকেয়ার ঘরে ফেরা দেশের জন্য একটি মাইলফলক।’

রাবেয়া ও রোকেয়া আজীবন বিনামূল্যে সিএমএইচ থেকে চিকিৎসা নিতে পারবেন-এমন ঘোষণা দিয়ে জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, ‘এই শিশু দুটির চিকিৎসায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যুক্ত হওয়ায় আমরা গর্বিত। গত ২২ জুলাই সিএমএইচে তারা এ ভর্তি হয়। এরপর তাদের অপারেশন হয়। অপারেশনে হাঙ্গেরির চিকিৎসক, সিএমএইচ, বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা অংশ নেন।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ রোববার(১৪ মার্চ) ঢাকা সিএমএইচে ‘মুজিব শতবর্ষে রাবেয়া-রোকেয়া’র শুভ গৃহে প্রত্যাবর্তন অনুষ্ঠানে সিএমএইচের পক্ষ থেকে দুই শিশুর জন্য ‘আজীবন চিকিৎসা সেবা কার্ড’ প্রদান করেন।

প্রধানমন্ত্রীর অবদানের কথা ভুলবো না
রাবেয়া ও রোকেয়ার মা তাছলিমা বেগম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘আমরা যখন এসেছিলাম, আমরা ভেবেছিলাম খালি হাতে যাবো। কিন্তু আমরা খালি হাতে যাচ্ছি না। আমরা এবং আমাদের পরিবার কখনও আপনার এই অবদানের কথা ভুলবো না।’ তিনি রাবেয়া ও রোকেয়ার চিকিৎসকদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।

জোড়া মাথার বাচ্চা আলাদাকরণ কার্যক্রমে সফলতা অর্জনের উদাহরণ অত্যন্ত কম। জোড়া মাথার যমজ শিশুর জন্য সামাজিকভাবে হেয় হতে হয়েছে বাবা-মাকে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রথম এবং বিশ্বের ১৭তম ঘটনা এটি, যা বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য একটি মাইলফলক।

শেখ রেহানার এসএমএস, প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বলেন, ‘আজকের দিনটি সত্যিই আনন্দের দিন। রাবেয়া ও রোকেয়ার কথা প্রথমে আমাকে আমার ছোট বোন শেখ রেহেনা জানিয়েছিল। সে পত্রিকায় দেখে আমাকে ছোট্ট একটা ম্যাসেজ দিয়েছিল। ম্যাসেজে লিখেছিল, ‘দেখো তাদের জন্য কিছু করা যায় কিনা।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ রোববার(১৪ মার্চ) ঢাকা সিএমএইচে ‘মুজিব শতবর্ষে রাবেয়া-রোকেয়া’র শুভ গৃহে প্রত্যাবর্তন অনুষ্ঠানে দুই শিশুর মা-বাবার হাতে শুভেচ্ছা উপহার তুলে দেন।

আমি তখন ডা. সামন্ত লালের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এরপর শিশু দুটিকে ঢাকায় আনা হয়। এই শুরু। এরপর শিশু দুটিকে অস্ত্রোপচার করে আলাদা করা হয়েছে। তারা আজ বাড়ি যাবে। বাংলাদেশের ঘটনাবহুল এই মার্চ মাসে তারা বাড়ি যাচ্ছে। এটা আনন্দের।

তিনি বলেন, ‘এই চিকিৎসা শুরু হওয়ার পর এ নিয়ে প্রত্যেকের ভেতরেই আগ্রহ ছিল। হাঙ্গেরির একদল চিকিৎসা বেগম ফজিলাতুন্নেসা হাসপাতাল দেখতে এসেছিল। সেখানে তারা প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। তাদেরও বিষয়টি জানালো হলো। এরপর আমি হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রীকে ম্যাসেজ দেই, সাক্ষাতেও তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলি। তিনিও সহযোগিতার কথা বললেন।’

আনন্দে উদ্বেল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘এরপর কোথায় আলাদা করা হবে সেটা নিয়ে একটু সিদ্ধান্তহীনতা ছিল। পরে সিএমএইচে হলো। সিএমইচকে সেভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে। অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে সবাই কাজ করেছেন। অপারেশনে সব বিশেষজ্ঞকে একত্র করা হয়েছে। তারা সফল হয়েছেন। শিশু দুটির ৪৮টি অপারেশন হয়েছে। এটি কম কথা নয়। সিএমএইচে শিশু দুটির দীর্ঘদিন চিকিৎসা দেওয়া এবং পরিচর্যা করায় সকল চিকিৎসক ও কর্মীদের প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ জানান।

মুজিবশতবর্ষে এরকম সফল অস্ত্রোপচারকে বড় অর্জন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রাবেয়া রোকেয়ার জন্য সবাই দোয়া করবেন। তারা যেন সুস্থ থাকে এবং বাবা মায়ের বুকে আনন্দ নিয়ে আসতে পারেন সেজন্য দেশবাসী দোয়া করবেন।’

কালের আলো/এসএকে/এমএ