বঙ্গবন্ধুর খুনির চাচাতো বোনের স্বামী সেই সামি!
প্রকাশিতঃ 11:37 pm | February 08, 2021

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
আলজাজিরার বিনোদনমূলক প্রতিবেদনের প্রধান চরিত্র জুলকার নাইন সায়ের খান ওরফে সামির সরকার বিরোধী প্রোপাগান্ডার নেপথ্য রহস্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
সামির শ্বশুর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) তাসলিম ছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনি ফ্রিডম পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লে: কর্নেল (অব:) শাহরিয়ার রশীদ খানের আপন চাচা। অর্থাৎ, এই খুনি শাহরিয়ার রশীদের চাচাতো বোনকে বিয়ে করেছেন সামি।
এজন্যই ফ্রিডম পার্টির কিলারদের জন্য সামির এতো মায়াকান্না এবং সরকার ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এতো প্রোপাগান্ডা। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা সেই ঘাতক শাহরিয়ার রশীদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথেই কী না এখন প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা এই জোচ্চুরের। এরই ধারাবাহিকতায় আলজাজিরাকে সাক্ষাৎকার দিয়ে নিজেকে ‘হিরো’ হিসেবে উপস্থাপনের অপচেষ্টা করেছেন সামিউল আহমেদ খান ওরফে জুলকার নাইন সায়ের খান ওরফে সামি।
নানা ছলচাতুরিতে ভরপুর জীবনে একাধিক বিয়েও করেছেন সামি। সেনা কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে প্রথম স্ত্রীকে না জানিয়েই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) তাসলিমের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন সামি। অ্যান্টেনা ভাঙা ভিএইচএফ (ওয়াকিটকি) নিয়ে মার্কিন দূতাবাসের নিরাপত্তা কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেওয়ার নামে কয়েকজনের কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে সামির বিরুদ্ধে।
ভূয়া নামে পাসপোর্ট-ড্রাইভিং লাইসেন্স
জন্মসূত্রে পাওয়া নিজের নাম বারবার বদল করে অবৈধভাবে হাঙ্গেরিতে বসবাসের পাশাপাশি দিব্যি ব্যবসা বাণিজ্য করে চলেছেন জুলকার নাইন সায়ের খান ওরফে সামি।
সামির প্রকৃত নাম সামিউল আহমেদ খান। অল্প বয়সে মাকে হারানোর পর চুরি ও প্রতারণামূলক অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে বদলে ফেলেন মায়ের রাখা নাম ‘তানভীর মোহাম্মদ সাদাত খান’।
এমনকি ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরিতে অবৈধভাবে বসবাসের জন্য নিজের মিথ্যা পরিচয়ও তৈরি করেছেন। জুলকারনাইন সায়ের খান- এই ভূয়া নামের অধীনে পাসপোর্ট যেমন সংগ্রহ করেছেন তেমনি ইন্টারন্যাশনাল মোটর ড্রাইভিং লাইসেন্সও করেছেন এই ফেক পরিচয়েই। শুধু কী তাই?
এ বহুমুখী প্রতারক নিজের জন্মদাতা পিতার নাম ও পদবীও পরিবর্তন করেছিলেন। দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র থেকে আমরা জানতে পেরেছি, হাল সময়ের আলোচিত-সমালোচিত এই সামির বাবার আসল নাম মো.আবদুল বাসেত খান।

প্রয়াত বাসেত ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। কিন্তু নিজের পাসপোর্টে ও ড্রাইভিং লাইসেন্সে সামি নিজের বাবার নাম উল্লেখ করেছেন- কর্নেল ওয়াসিত খান। অথচ সেনা আইনে কোন সেনা কর্মকর্তা পাসপোর্টে কখনও তাঁর পদমর্যাদার কথা উল্লেখ করতে পারেন না। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও রীতিমতো জোচ্চুরির আশ্রয় নিয়েছেন এই ভন্ড ব্যক্তি।
এ ধরণের নকল কাগজ তৈরি করা পাসপোর্ট অফেন্সেস অ্যাক্ট ১৯৫২ এবং পিনাল কোড ১৮৬০ এর অধীনে একটি ফৌজদারী অপরাধ। বিশেষভাবে নকল পাসপোর্ট দিয়ে কোন দেশে ভ্রমণ করা আরও গুরুতর অপরাধ।
প্রতারক সামির পেছনের গল্প
অল্প বয়সেই মা’কে হারানোর পর সৎ মায়ের সংসারে নিজের শৈশব-কৈশোর ডানা মেলে চুরি আর প্রতারণামূলক অপরাধের চক্করে। পা বাড়ান মাদকের অন্ধকার জগতেও। এসব অপকর্মের জেরে ক্যাডেট কলেজ থেকে বহিষ্কার হন। এরপর ভর্তি হন কুমিল্লার ইস্পাহানি স্কুলে।
ওই সময়ে মাদক সেবন, বিকিকিনি, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাসহ হেন কাজ নেই যা সে করেনি। মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে সহপাঠী-বন্ধুরাও তাকে এড়িয়ে চলতো।
সামির বয়স যখন ১৭ কী ১৮, তখন ইসিবিতে কর্মরত মেজর ওয়াদুদের একটি ট্রাকস্যুট চুরির মধ্য দিয়েই এই কুকর্মে তাঁর হাতপাঁকানো শুরু। ২০০০ সালের জুলাই মাসে একইভাবে টাইগার অফিসার্স মেস থেকে হাতির দাঁত চুরি করে রাজধানীর নিউমার্কেটের অঙ্গনা জুয়েলার্স ও চট্টগ্রামে বিক্রি করেন এবং ধরাও পড়েন।
২০০১ সালের ২৮ ও ২৯ এপ্রিল ঢাকা সেনানিবাসে নিজেকে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে পরিচয় দিয়ে ছুটে যান তাঁর আমেরিকা প্রবাসী বন্ধু উৎপলের কাছে। প্রতারণার জন্য যখন যে পরিচয়ের প্রয়োজন সেই পরিচয়েই আবির্ভূত হতে যেহেতু করিৎকর্মা, তাই বন্ধুর কাছে নিজেকে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে প্রমাণ করতে বেল্ট, বুট, র্যাংক ইউনিফর্ম ইত্যাদি কিনে নিয়ে আসেন এবং সেনাবাহিনীর এই ইউনিফর্ম পড়েই ঢাকা সেনানিবাসসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুুরে বেড়ান।

অবশেষে জাহাঙ্গীর গেট দিয়ে সিএমএইচ এ আসার সময় দুপুর ২ টায় মিলিটারি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। এর ঠিক দু’দিন পর ওই বছরের ০২ মে বাবার অঙ্গীকারনামায় আর্মি এমপি ডেস্ক থেকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এই প্রতারক র্যাব কর্মকর্তা পরিচয়ে আর্থিক প্রতারণার অভিযোগে ২০০৬ সালে র্যাব-১’র একটি বিশেষ দলের হাতে গ্রেফতারও হয়েছিলেন। এতোসব কুকর্মের জেরে সেনা সদর ২০০৬ সালে তাকে দেশের সব সেনানিবাসে ‘পিএনজি’ ঘোষণা করেন।
মৃত্যুর আগে সামির বাবা তার অনিয়ন্ত্রিত ও উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনের জন্য তাকে ত্যজ্যও করেন। সর্বশেষ গুজব ও অপপ্রচারের অভিযোগে ২০২০ সালের মে মাসে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে দায়ের করা মামলার অন্যতম আসামিও তিনি।
এসব তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে আমাদের এমন আলোচনাতেই উঠে এলো ‘অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টার’স ম্যান” নামের এই কথিত প্রামাণ্যচিত্রে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে সামি ও তার দোসরদের বিষোদাগারের নেপথ্য রহস্য।

কালের আলো/এনএল/বিআরকে