ঢাকা ওয়াসার নতুন চমক, আদর্শ ২৫ গ্রাহককে সম্মাননার ব্যতিক্রমী উদাহরণ

প্রকাশিতঃ 8:02 pm | December 19, 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়েই খোলনলচে পাল্টে প্রতিনিয়তই বদলে যাচ্ছে ঢাকা ওয়াসা। রাজধানীতে পানি সরবরাহ ও পয়:নিষ্কাশনের দায়িত্বে থাকা এ প্রতিষ্ঠানটির সেবার বেলায় উচ্চবিত্ত বা নিম্নবিত্ত বলে কোন কথা নেই! সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় যেমন বাড়ানো হয়েছে সেবার মান তেমনি নিশ্চিত করা হয়েছে কাঙ্খিত সেবাও। সময়ের ঘূর্ণায়মান স্রোতে ডিজিটাল ঢাকা ওয়াসাও যেন অনিবার্য এক বাস্তবতা!

গত ১০ বছরে রাজধানীর প্রায় শতভাগ মানুষ বৈধভাবে পানি পাচ্ছে। একই সঙ্গে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে রাজধানীর সব বস্তিকে বৈধ পানির আওতায় আনার মহাপরিকল্পনাও চলমান রয়েছে সংস্থাটির। এসবের বাইরে গ্রাহকদের উৎসাহিত করতেও নানামুখী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

বস্তিতে থাকেন, কিন্তু নিম্ন আয়ের অথচ নিয়মিত পানির বিল পরিশোধ করেন এমন ২৫ জন আদর্শ গ্রাহককে দেওয়া হয়েছে বিশেষ সম্মাননা। গ্রাহক সেবাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে এমন এক চমকই উপহার দিয়েছেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান। এ সম্মাননা পেয়ে উৎফুল্ল নিম্ন আয়ের আদর্শ গ্রাহকরাও।

অবশ্য তাঁরা তাদের জন্য কম টাকায় পানি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন। উচ্চবিত্তদের কাছে যেখানে ওয়াসার বকেয়া প্রায় ৭০ লাখ টাকার পানির বিল সেখানে নিম্ন আয়ের গ্রাহকদের এমন উদাহরণে তাদের দাবিকে ইতিবাচক হিসেবেই গ্রহণ করেছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ ও ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান।

তাঁরাও তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এলাকাভিত্তিক পানির দাম নির্ধারণের পরিকল্পনার পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষদের কম টাকায় পানি সরবরাহেরও বিষয়টি ভাবনা-চিন্তার কথা জানিয়েছেন। কোন অবস্থাতেই তাদের জন্য পানির দাম বাড়বে না বলেও প্রতিশ্রুতির কথা জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়টির জ্যেষ্ঠ সচিব ও ঢাকা ওয়াসার এমডি।

শনিবার (১৯ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ঢাকা ওয়াসার প্রধান কার্যালয়ের বুড়িগঙ্গা হলে নিম্ন আয়ের এলাকার ‘আদর্শ গ্রাহক’দের সম্মাননা জানাতে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে। ঢাকা ওয়াসা, ‘দুস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্র (ডিএসকে)’ এবং ওয়াটারএইড বাংলাদেশ যৌথভাবে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে। নিম্ন আয়ের বিশেষ করে বস্তিতে থাকা ৭ হাজার ৪৮৩ জন বৈধ গ্রাহকের ওয়াসার পানির সুবিধা পাচ্ছেন।

অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এ অনুষ্ঠানটিতে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান।

নিম্ন আয়ের গ্রাহকদের অনুকরণীয় দৃষ্টান্তে উৎসাহিত হবেন উচ্চবিত্তরা
নিয়মিত পানির বিল পরিশোধ করায় নিম্ন আয়ের এসব আদর্শ গ্রাহকদের ধন্যবাদ দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। এ অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত থেকে উচ্চবিত্তরাও উৎসাহিত হতে পারেন বলেও মনে করেন তিনি।

তথ্যনির্ভর ও যুক্তিবহ উপস্থাপনে হেলালুদ্দীন আহমদ এলাকাভিত্তিক পানির দামের উদাহরণ টেনে আনেন। বলেন, ‘ঢাকায় এক হাজার লিটার পানি ১৪ টাকায়, চট্টগ্রামে ১২ টাকায় সরবরাহ করা হয়। ভারতের দিল্লিতে (মূল শহরে) এক হাজার লিটার পানির দাম নেওয়া হয় ৪৩ রুপি। অবশ্য শহরতলিতে পানির দাম কম। কারণ, শহরতলিতে নিম্ন আয়ের মানুষ বাস করে। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের শতভাগ মানুষ নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের আওতায় আসবে বলেও দৃঢ়কন্ঠে উচ্চারণ করেন হেলালুদ্দীন আহমদ।

রাজধানীর শতভাগ মানুষ বৈধভাবে পানি পাচ্ছে
২০০৯ সালে প্রথমবারে মতো ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাকসিম এ খান। নিজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও উন্নত বিশ্বের আদলে সামনে আনেন নতুন নতুন ধারণা বা কনসেপ্ট। গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করতেই সুদৃঢ় অঙ্গীকার করেন। ভেঙে দেন ঘাপটি মেরে থাকা সিন্ডিকেট। ফলে তারা ওয়াসার বিপরীতে নানামুখী প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে জল ঘোলা করার অপচেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠে।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো.তাজুল ইসলাম এমপির সুনির্দেশনায় যুগান্তকারী সব পরিবর্তনের পথেই অগ্রসর হন ওয়াসার এমডি। শনিবার (১৯ ডিসেম্বর) এ অনুষ্ঠানটিতে এমডি জানিয়েছেন, ‘আমার দায়িত্ব গ্রহণের সময় রাজধানীর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মানুষ বস্তিতে বাস করতো। যারা সবাই বৈধ পানির সংযোগের বাইরে ছিল। এখন প্রায় সব বস্তিকেই বৈধ পানির আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। এখন ঢাকার প্রায় শতভাগ মানুষ বৈধভাবে পানি পাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘২০১০ সালে ইউনাইটেড নেশন ঘোষণা করলো পানি হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকার। আমরা সেটাকে গ্রহণ করলাম। আমরা সরকারকে অনুরোধ করলাম নিম্ন আয়ের মানুষকে ঢাকা ওয়াসার বৈধ পানির আওতায় নিয়ে আসার।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাকসিম এ খান বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন আমাদের ঢাকা ওয়াসার ঘুরে দাঁড়াও কর্মসূচির কথা শোনলেন এবং সেখানে যখন আমরা বললাম আমরা বস্তি এলাকায় এবং নিম্ন আয়ের এলাকায় বৈধ পানি দেব; যদিও তাদের কোন হোল্ডিং নম্বর নেই। তারপরেও আমরা বৈধ পানি দেব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সানন্দে আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। এরপর থেকেই আমরা মাস স্কেলে বৈধ পানি দেওয়ার চেষ্টা করলাম।’

ঢাকা ওয়াসার এমডি বলেন, ‘আমাদের টার্গেট ছিল ২০১৮ বা ২০১৯ এর মধ্যে আমরা ১০০ ভাগ নিম্ন আয়ের অঞ্চলকে বৈধ পানির আওতায় আনবো। তবে আমরা করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে খানিকটা পিছিয়ে গেছি। আমরা আশা করছি আগামী ২০২১ সালে যখন বাংলাদেশ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে তখন ওই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা ইনশাআল্লাহ ঢাকা শহরের সমস্ত নিম্ন আয়ের বা বস্তিগুলোকে বৈধ পানির আওতায় আনবো।’

ঢাকাবাসীর বৈধ পানি প্রাপ্তি শুধু মৌলিক অধিকারই নয়, জনস্বাস্থ্যের কারণেও গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তাকসিম এ খান বলেন, ‘আমরা ৭ টি কারণে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করেছি। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতে পানি প্রদানও একটি। আমাদের এ সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল তা আজকে আমরা সবাই জানতে পারছি, বুঝতে পারছি, দেখতে পারছি।’

পানি ব্যবস্থাপনায় আমুল পরিবর্তনে সক্ষম
ঢাকা শহরের কোন মানুষই পানির আওতার বাইরে না থাকায় সরকার, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও এবং দাতা সংস্থাদের অবদানেরও কথাও তুলে ধরেন ঢাকা ওয়াসার এমডি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইউনিসেফ, ওয়াটার এইড, ডিএসকেৃ ঢাকা শহরে পানি এবং স্যানিটেশন নিয়ে কাজ করে। এমন কোন সংস্থা বা এনজিও নেই যারা ঢাকা ওয়াসার সাথে কাজ করে না। কাজেই এটা আমাদের একটি সফলতা যে, আমরা পেরেছি আমাদের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত করতে। এবং সবাইকে সাথে নিয়ে আমরা ঢাকা শহরের পানি ব্যবস্থাপনায় আমুল পরিবর্তন আনতে পেরেছি এবং আনার চেষ্টা করছি।’

সংযোগের আওতায় আসবে শতভাগ বস্তি
নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বৈধভাবে পানি সরবরাহ সম্পর্কে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, ‘নয়াদিল্লিতে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ মানুষ “ইনফরমাল সেক্টরে” থাকে। সেখানে পানির ব্যবস্থাপনার বিষয়টি ব্যবস্থাপকদের হাতে নেই। সেটি মাস্তানদের হাতে। একসময় আমাদের কড়াইল বস্তিতেও মাস্তানদের মাধ্যমে পানি দেওয়া হতো, আমরা সেটিকে উচ্ছেদ করেছি।’ আগামী বছরের মধ্যে ঢাকার শতভাগ বস্তি বৈধ সংযোগের আওতায় আসবে বলে তিনি ঘোষণা দেন।

যারা সক্ষম তারা দেন না, যারা সক্ষম নয় তারা মূল্য দেন
তাকসিম এ খান আরও বলেন, ‘পানির যা উৎপাদন খরচ, তার চেয়ে অনেক কম দামে পানি দেওয়া হয়। বাকিটা সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। দুঃখজনক হলো, এই ভর্তুকি উচ্চবিত্তরাও পাচ্ছেন, যদিও তাঁদের তা পাওয়া উচিত না। আমরা এখন চিন্তা করছি, এলাকাভিত্তিক পানির দাম নির্ধারণ করব।’ তিনি আরও বলেন, ‘নিম্ন আয়ের মানুষের ব্যবহারের পানির দাম বাড়বে না, তবে কমানো হয়তো সম্ভব হবে না। কিন্তু অন্যান্য জায়গায় পানির দাম বাড়বে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা যারা অর্থনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত ভালো বা অনেক ভালো অবস্থানে আছি তারা যে পয়সা দেয়, নিম্নবিত্তরাও একই পয়সা দেয়। আমার বলতে আপত্তি নেই এই শহরের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি যাদের টাকার কোন অভাব নেই। কিন্তু তাদের লাখ লাখ টাকা আমাদের কাছে বাকী আছে। অথচ আমার জানামতে নিম্ন আয়ের গ্রাহকদের কাছে ১০০ টাকার বেশি বকেয়া নেই। অর্থাৎ যারা সক্ষম তারাই দেন না, আর যারা সক্ষম নয় তার পানি ব্যবহার করে মূল্য দেন’ যোগ করেন তাকসিম এ খান।

কালের আলো/এমকে/এমএএএমকে