গণতন্ত্রের জয় হোক সর্বত্র

প্রকাশিতঃ 10:33 am | November 10, 2020

প্রভাষ আমিনঃঃ

‘লুটপাট ও ভাঙচুরের ভয়ে? মার্কিন নির্বাচনের সময় যা আগে কখনও ঘটেনি। আজ ২ নভেম্বর বিকেলে ম্যানহাটান গিয়েছিলাম। নিউইয়র্ক শহরের অভিজাত এলাকা ফিফথ এভিনিউ এবং আশেপাশে গিয়ে একটু টাসকি খেলাম। লোকজন তেমন নেই। বেশিরভাগ হোটেল, রেঁস্তোরা, দোকানপাট বন্ধ। তবে ফিফথ এভিনিউ’র ৫৭ স্ট্রিট থেকে হেঁটে হেঁটে ৪২ স্ট্রিট পর্যন্ত আসার সময় দুপাশে এক নজিরবিহীন দৃশ্য দেখলাম। বড় বড় ব্র্যান্ড রিটেইলাররা তাঁদের শোরুম ও স্টোর বিশাল বিশাল প্লাইউড দিয়ে ঢেকে ফেলছেন! কেন? সহিংসতা, ভাংচুর ও লুটপাট থেকে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাঁচানোর জন্য! আগামীকাল নির্বাচন। নির্বাচনের দিন কিংবা পরবর্তীতে ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান দলীয় গোঁড়া সমর্থকদের মধ্যে সম্ভাব্য সহিংসতা এবং তার ফলশ্রুতিতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটের আশংকা থেকেই এই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ। আমেরিকার মত ‘সভ্য’ দেশে এমন করুণ বাস্তবতা ভাবা যায়? আসলে গত ৪ বছর ধরেই এই দেশটি এমন বাস্তবতার মধ্যেই রয়েছে। কাল মার্কিন জনগণের সামনে সুযোগ আসছে এই ‘বাস্তবতা’কে ছুঁড়ে ফেলা কিংবা আরো ৪ বছরের জন্য আলিঙ্গন করার।‘

এটি মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম বাচ্চুর ফেসবুক স্ট্যাটাস। এখন আমেরিকান হলেও বাচ্চু ভাই চট্টগ্রামের মানুষ। একসময় দাপুটে রিপোর্টার ছিলেন। তার রিপোর্টের কারণেই ১৯৮৭ সালে এরশাদ নিষিদ্ধ করেছিল তখনকার প্রিয় সাপ্তাহিক বিচিন্তা। স্ট্যাটাসের সাথে ২২টি ছবিও সংযুক্ত করেছিলেন তিনি। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম শুধু নিউইয়র্ক নয়, আমেরিকার সব বড় বড় শহরেরই একই চিত্র। সবাই দারুণ শঙ্কায় ছিলেন। নির্বাচনের পর সহিংসতা, ভাঙচুর, লুটপাটের শঙ্কা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বড্ড বেমানান। এসব তো বাংলাদেশী স্টাইল। শুধু এই শঙ্কা বলে নয়, এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে অনেক কিছুই হয়েছে বাংলাদেশের নির্বাচনী স্টাইলে।

এবার মার্কিন নির্বাচনে অনেকগুলো নতুন ঘটনা ঘটেছে। ইতিহাসের সবচেয়ে বয়সী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনিই ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রেসিডেন্ট। এমনকি তিনি যাকে হারিয়েছেন, সেই ডোনাল্ড ট্রাম্পও আগের যে কোনো নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিস একই সঙ্গে প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ভাইস প্রেসিডেন্টও। মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি মানুষ এবার ভোট দিয়েছেন। তবে সবচেয়ে অভিনব হলো পরাজিত প্রার্থীর হম্বিতম্বি। আমার স্মৃতিতে যে কটি মার্কিন নির্বাচন দেখেছি, তাতে কারো জয়ের সম্ভাবনা তৈরি হলেই বিজিত প্রার্থী তাকে অভিনন্দন জানান, একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার করেন।

নির্বাচনের সাথে সাথেই ভুলে যান প্রচারকালীন বৈরিতা। কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম। ডোনাল্ড ট্রাম্প আগে থেকেই বলছিলেন, তিনিই জয়ী হবেন। নির্বাচনের রাতেই তিনি নিজেকে জয়ী ঘোষণা করেন। ট্রাম্প কারচুপির অভিযোগ এনে একের পর মামলা করছেন। যদিও কোথাও থেকে কোনো সহায়তা পাননি, বরং একের পর এক পাগলামি তাকে নিঃসঙ্গ করে দিচ্ছে। কিন্তু আমার খালি বিস্ময়, কারচুপির অভিযোগ এনে ফলাফল প্রত্যাখ্যান, আদালতে যাওয়া, পরাজয় মানতে না চাওয়া- এই বাংলাদেশী স্টাইল ট্রাম্প শিখলেন কোত্থেকে?

নির্বাচনের আগের জরিপে জো বাইডেনের বিশাল জয়ের পূর্বাভাস দেয়া হচ্ছিল। কিন্তু সেটা হয়নি। পপুলার ভোট বিবেচনায় নিলে লড়াইটা হাড্ডাহাড্ডি হয়েছে। চারবছর ট্রাম্পের পাগলামি দেখার পরও প্রায় ৭ কোটি মানুষ ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। এটাই এই নির্বাচনে আমার কাছে বিস্ময় এবং এটাই ট্রাম্পের সাফল্য। ট্রাম্পের চারবছরের শাসনকাল শুধু আমেরিকার জন্যই নয়, গোটা বিশ্বের জন্য এক দুঃস্বপ্নকাল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ট্রাম্প যা যা করেছেন, কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট তা করতে পারেন, তা কল্পনা করাই কঠিন। তিনি দিনের পর দিন মিথ্যা বলে গেছেন। এমনকি প্রেসিডেন্টের ভাষণ মিথ্যা বলে গণমাধ্যম সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। ট্রাম্প টুইট করে দেশ চালানোর চেষ্টা করেছেন। তবে টুইটারও বারবার তারি স্ট্যাটাসে সতর্কবার্তা যুক্ত করে দিয়েছে। ট্রাম্প খুব সাফল্যের সঙ্গে মার্কিন সমাজকে বিভক্ত করতে পেরেছেন। তিনি ছিলেন চরম বর্ণবাদী, অভিবাসনবিরোধী, কট্টরপন্থি। দিনের পর দিন তিনি ঘৃণা আর বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন। ধর্ম আর বর্ণকে রাজনীতিতে টেনে এনে তিনি বদলে দিয়েছেন আমেরিকাকেই।

প্রথম নির্বাচনের আগে তার স্লোগান ছিল, মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন। তার মানে এতদিন আমেরিকা গ্রেট ছিল না। তবে ট্রাম্প আসল আমেরিকাকে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে আমেরিকানদের ভেতরের সব কুৎসিৎ আর অন্ধকার বের করে এনেছেন। আমেরিকা এখন এক কট্টরপন্থি, বর্ণবাদী, উগ্র সমাজ। সারাবিশ্বে আমেরিকার যে ভাবমূর্তি ছিল- উদার, মানবিক, গণতান্ত্রিক; মাত্র চারবছরে ট্রাম্প তা ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছেন। ট্রাম্প আসলে পদ্মবনে মত্তহস্তি। ট্রাম্প এক বিরাট শিশু, যে এই বিশ্ব লয়ে খেলাধুলা করেছে চারবছর। আমার ধারণা ছিল এবারের নির্বাচনে আমেরিকানরা ট্রাম্পকে একেবারে ছুড়ে ফেলবেন। কিন্তু আমেরিকানরা প্রমাণ করলেন, ওপরে ওপরে ভালোমানুষিই থাকুক, তাদের অনেকেই ভেতরে ভেতরে একেকজন ট্রাম্প।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব কল্যাণের দিকে পথ চলতে শুরু করেছিল। একা নয়, সবাই মিলেই এগিয়ে যেতে নানান জোট হচ্ছিল। কিন্তু ট্রাম্প এসে আবার বিচ্ছিন্ন ও স্বার্থপর বিশ্ব গড়ে তোলার দিকে যাত্রা শুরু করেন। ট্রাম্পের এই ডানপন্থি নীতি ছড়িয়ে গেছে বিশ্বের দেশে দেশে। ট্রাম্পের কাছে জাতিসংঘ, ন্যাটো্, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থ্যা কিছুই না; তিনি জলবায়ু পরিবর্তন বোঝেন না। তিনি তাই করেন, যখন চাহে এ মন যা। তবে এটা ঠিক ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, তার নেতিবাচক কাজের জন্য, পাগলামির জন্য। এবারের মার্কিন নির্বাচন আসলে ছিল ট্রাম্প বনাম ট্রাম্প। এই যে দেখুন এতক্ষণের লেখায় আমি কয়বার ট্রাম্পের নাম লিখেছি আর কয়বার বাইডেন? নির্বাচনে আসলে বাইডেন জেতেননি, ট্রাম্প হেরেছেন। তবে ট্রাম্প হারলেও ট্রাম্পিজম হারেনি। ট্রাম্পের দেখানে অন্ধকার আমেরিকাকে বুকে ধারণ করে ৭ কোটি মানুষ, তাদের বদলানো সহজ হবে না।

ট্রাম্পিজম সমস্যায় ফেলবে রিপাবলিকান পাটিকেও। ট্রাম্প আমেরিকা এবং বিশ্বের যে ক্ষতি করে দিয়ে গেছেন, তা সারাতে বাইডেনকে অনেক কষ্ট করতে হবে। তারপরও মনে হয় না, এক মেয়াদে শেষ করতে পারবেন। মত্ত হস্তি পদ্মবনের যে ক্ষতি করেছে; তাকে আবার বাগান করে তুলতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। অনেকে বলছেন, ট্রাম্প খুব ভালো। তার আমলে কোনো যুদ্ধ হয়নি। এটা ঠিক। তবে এটা ভালোত্বের কারণে নয়, ট্রাম্পের আসলে বিশ্ব নিয়ে ভাবারই সময় ছিল না। তার কাজ ছিল শুধু খুচিয়ে খুচিয়ে আমেরিকানদের অন্তর থেকে বর্ণবিদ্বেষ, অভিভাসনবিদ্বেষ, ধর্মবিদ্বেষকে জাগিয়ে তোলা।

এভাবেই তিনি আমেরিকাকে পিছিয়ে নিতে চেয়েছেন। তবে আশার কথা হলো, জয়ের সাথে সাথে বাইডেন ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। বলেছেন, তিনি সবার প্রেসিডেন্ট হবেন, যারা তাকে ভোট দিয়েছে তাদের, যারা ভোট দেয়নি তাদেরও। বাইডেনকে শুধু ঘর গোছালেই হবে না, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে আমেরিকার অবস্থান ঠিক করতে হবে। জাতিসংঘ, ন্যাটো, বিশ্ব্ স্বাস্থ্য সংস্থা, জলবায়ু তহবিল নানা জায়গায় ট্রাম্প ঝড় বইয়ে দিয়ে গেছেন, তা মেরামত করতে হবে। প্রত্যাশা হলো, বাইডেন যেন দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে কল্যাণ বিশ্ব গড়ার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারেন। দেশে দেশে ডানপন্থিদের যে উত্থান, ট্রাম্পের পরাজয়ে তারাও নৈতিকভাবে দুর্বল হবে। এই সুযোগে হটাতে হবে সেই অপশক্তিকেও।

শুরুতে বাংলাদেশী স্টাইলে আমেরিকান নির্বাচনের কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু আমেরিকায় গণতন্ত্রেরই জয় হয়েছে। মানুষ বেছে নিতে পেরেছে তাদের নেতৃত্ব। বাংলাদেশে এই বেছে নেয়ার অধিকার আমরা হারিয়েছি অনেক আগেই। প্রত্যাশা করি, গণতন্ত্রের জয় হোক সর্বত্র- আমেরিকায়, বাংলাদেশে।