শীর্ষ সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি আর চুক্তিভিত্তিক কিলিং মিশনে বখাটে-মাদকাসক্তরা

প্রকাশিতঃ 8:52 am | November 01, 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

মোটর বাইকে চড়ে যাচ্ছেন দু’আরোহী। হঠাৎ এক গলির ভেতর থামলো বাইকটি। পেছনে থাকা একজন নিজের অস্ত্র বের করে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুঁড়লেন। প্রথম দেখায় মনে হবে, এটি কোন মুভির দৃশ্য। কিন্তু সময় গড়াতেই ধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসবেন সহজেই।

মূলত এভাবেই প্রকাশ্যে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে দাবড়ে বেড়ান সন্ত্রাসী হেলাল। জনমনে ভয় বা আতঙ্ক তৈরি করতেই সিদ্ধহস্ত এ সন্ত্রাসী গত ৬ আগস্ট রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় এমন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটান। এ দৃশ্য ধরা পড়ে পাশের সিসি ক্যামেরায়। এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদা নিতেই সেদিন ভয়ঙ্কর এমন রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন হেলাল।

ঠিক পরের মাসেই একইভাবে মোটর সাইকেলে চড়ে একটি বাড়ির দিকে গুলি করেন এই হেলাল। ওই বাড়ির মালিক দাবিকৃত চাঁদা না দেওয়ায় তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয় গুলি ছুঁড়ে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অভিযানে সম্প্রতি দু’টি বিদেশি পিস্তলসহ বাড্ডা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় হয় সন্ত্রাসী হেলালকে।

তাকে জিজ্ঞাসাবাদে রাজধানীর বাড্ডা, ভাটারা, হাতিরঝিল ও তেজগাঁওসহ বেশ কিছু এলাকার সন্ত্রাসীদের কথিত আন্ডারওয়ার্ল্ড সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য মেলে।

পুলিশ জানিয়েছে, রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় এমনভাবেই বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও নির্মাণাধীন বাড়ি থেকে নীরব চাঁদাবাজির অভিযোগ পেয়েছেন তাঁরা। আর এসব সন্ত্রাসীদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে দেশের বাইরে থেকে। শুধু চাঁদাবাজিই নয় চুক্তিভিত্তিক হত্যাকান্ডের মিশনেও অংশ নিচ্ছে এ চক্রটি।

জানা যায়, গ্রেপ্তারকৃত হেলালের মতো সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ বিদেশে পালিয়ে থাকা বেশ ক’জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর হাতে। বিদেশে থেকে এসব এলাকার ঝুট, ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসা, ময়লার ব্যবসা, ফুটপাতসহ বিভিন্ন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি কাঁচাবাজার, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, নির্মাণাধীন বাড়ি ও গরুর হাট থেকে চলে দেদারসে চাঁদাবাজি।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ‘দেশের বাইরে থাকা কিছু সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশে অবস্থানকারী কিছু উঠতী বয়সী মাদকাসক্তদের ব্যবহার করে সন্ত্রাস চাঁদাবাজি করে থাকে। কখনও কখনও লোকাল এই মাদকাসক্তদেরকে দিয়ে গুলির ঘটনা ঘটানো হয়।’

সূত্র জানায়, বিদেশে পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীদের মধ্যে মালয়েশিয়ায় রয়েছে রবিন, ডালিম ও মাহবুব। রবিন ডালিমের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য দেশে কাজ করে শাকিল, রুবেল, হেলাল, রাসেল ও সোহেল। এদের মধ্যে রাসেল ও সোহেল এখন কারাগারে আছে। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে মেহেদী। মানিক, আরিফ, পুলক আর সুজন কাজ করে মেহেদির হয়ে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, শুধু চাঁদাবাজি নয় চুক্তিভিত্তিক কিলিং মিশনেও অংশ নেয় চক্রটি। এরই ধারাবাহিকতায় আধিপত্য বিস্তার এবং চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে গত ১০ বছরে বাড্ডা, বাটারা ও গুলশান এলাকায় দুই ডজনের বেশি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে।

সূত্র জানায়, এসব মাদকাসক্ত ও বখাটেদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে একটি অংশকে নিয়ন্ত্রণ করেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি’র সভাপতি ও সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর এম এ কাইয়ুম। ইটালিয়ান নাগরিক তাভেলা সিজার হত্যাকান্ডে নাম আসার পর পরপরই তিনি মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যান।

মালয়েশিয়ায় তাঁর সেকেন্ড হোম হওয়ার কারণে এখন কাইয়ুম সেখানেই অবস্থান করছেন। তাঁর ‘বেতনভুক্ত’ সন্ত্রাসীরা তাকে চাঁদাবাজির টাকা অনায়েসেই পাঠিয়ে দিচ্ছেন বিদেশে। এ চক্রটির সঙ্গে রাজধানীর মহাখালি, বাড্ডা, বনানী, গুলশান ও তেজগাঁও এর নব্য সন্ত্রাসী ভারতে অবস্থানরত আশিকের যোগসূত্র রয়েছে। এরা আশিকের ‘কামলা’ হিসেবেও কাজ করে।

সূত্র মতে, চাঁদাবাজি ও ক্যাবল ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চলতি বছরের জুনে বাড্ডা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ আলীকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। আর এই হত্যাকাণ্ডের মূলে রয়েছে বিদেশে অবস্থানরত তিন সন্ত্রাসী রমজান, মেহেদী ও আশিক।

তাদের মধ্যে মেহেদীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে বিদেশে অবস্থানরত পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের। নিজেদের ‘বেতনভুক্ত’ কিলারদের দিয়ে এ হত্যাকান্ড ঘটায় তাঁরা। আশিক ভারতে এবং মেহেদী যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে।

তাদের নির্দেশ অনুযায়ী ফরহাদকে প্রকাশ্য দিবালোকে মসজিদের বাইরে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করে হত্যা করে জিসান-মেহেদী-আশিক গ্রুপের বেতনভুক্ত কিলাররা। পুলিশ জানতে পেরেছে, বিদেশে বসে এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীরা রিয়েল এস্টেটসহ বিভিন্ন বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছেও চাঁদাবাজি করছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান এসব বিষয়ে আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রে লুকিয়ে আছে একদল সন্ত্রাসী। একদল সন্ত্রাসী আছেন দুবাইয়ে, একদল থাকেন মালয়েশিয়াতে এবং বেশ কিছু লোক ইন্ডিয়াতে আছেন বলে আমাদের কাছে তথ্য বা ধারণা করে থাকি আমরা।’

তিনি আরও জানান, একদল মধ্যস্বত্ত্বভোগী লোক যারা বাংলাদেশে আছেন এরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসেবে কাজ করে থাকেন অথবা বিভিন্ন পেশায় কাজ করে থাকেন। এরা হলো কাকে ‘টার্গেট’ করতে হবে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।

আর এদের অধীনে কাজ করে আরেকদল কামলা বা ক্যাডার। এ কামলারা একেবারেই বখে যাওয়া বা মাদকাসক্ত। তাদের ‘বেতনভুক্ত’ হিসেবে রাখে বিদেশে পালিয়ে থাকে সন্ত্রাসীরা।’

কালের আলো/জিকেএম/এমকে

Print Friendly, PDF & Email