এইচ টি ইমামের দিল্লি সফর : নতুন মাত্রায় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক

প্রকাশিতঃ 10:18 am | July 09, 2018

অ্যাক্টিং এডিটর, কালের আলো:

তিন দিনের সফরে এখন দিল্লি অবস্থান করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচ টি ইমাম)। বহুল প্রত্যাশিত দিল্লি সফরে তিনি অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে (ওআরএফ) ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গতি-প্রকৃতির ওপর বক্তব্য দিয়েছেন।

একই সঙ্গে বন্ধু প্রতিম দুই দেশের অতীত সম্পর্ক এবং সাম্প্রতিক সৌহার্দ্যরে নিরিখে ভবিষ্যতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করেছেন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নির্বাচন কমিটির সহ চেয়ারম্যান (কো চেয়ার) এবং দলটির উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য এইচ টি ইমাম স্পষ্টতই বলেছেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন সমানে-সমানে। অতীতে যেভাবে আওয়ামী লীগ সরকারকে ‘ভারতের তাঁবেদার’ বলে আক্রমণ করা হতো সেই দিন এখন আর নেই।’

নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি’র হঠাৎ করেই ভোল পাল্টানো ও ভারতপ্রীতির বিষয়টি সম্পর্কে খোলাসা করে তিনি বলেছেন, বিএনপি যতই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক শোধরানোর চেষ্টা করুক, তাদের মতো একটি পাকিস্তানপন্থী ও জামায়াত-সমর্থক দলের ওপর দিল্লি কিছুতেই ভরসা রাখবে না। সাবেক এই ঝানু আমলা এমনটি বিশ্বাসও করেন।

বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ ও গতিশীল নেতৃত্বে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অতীতের যে কোন সময়ের চাইতেও উন্নতি হয়েছে। ভবিষ্যতেও এই সম্পর্ককে আরো টেকসই ও মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে দুই পক্ষের নির্ভরতা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রও বিস্তৃত করা যায়, এই বিষয়েও কথা বলেন এইচ টি ইমাম।

তিনি বলেন, ‘ভারত হল আমাদের ঘনিষ্টতম মিত্র। বাংলাদেশে যেমন নির্বাচন, তেমনি ভারতেও সামনে নির্বাচন আসছে। এই পটভূমিতে ধরেই নেওয়া যায় বাংলাদেশে নির্বাচনী প্রচারে ভারত খুবই উল্লেখযোগ্যভাবে উল্লিখিত হবে। সবাই বলবে এই সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে অমুক হল, তমুক হল। আগে তো তাঁবেদার সরকার এরকম আরও কত কী বলা হয়েছে, কিন্তু এখন আমরা ইক্যুয়াল পার্টনারস, সমান-এই জিনিসটা তো আমরা ভোটের প্রচারে অবশ্যই বলব।’

দিল্লি সফরে এইচ টি ইমাম ক্ষমতাসীন দল বিজেপির নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে রীতিমতো ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। নানা থিঙ্কট্যাঙ্কে মতবিনিময়ও করেছেন। দুই সরকারের মধ্যে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার এটিও একটি বড় উদাহরণ।

শনিবার (৭ জুলাই) দুপুরে দিল্লির স্ট্র্যাটেজিক থিঙ্কট্যাঙ্ক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে একটি মতবিনিময় সভায় বিএনপিকে ভারতের ভরসা করার কেন কারণ নেই এ বিষয়েও একটি চমৎকার ও বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আসলে বিএনপি আজ জামায়াতে ইসলামীর একটা এক্সটেনশনে পরিণত হয়েছে। তাদের নিজেদের শক্তি বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই, জামায়াত আর শিবিরের ভরসাতেই তারা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ও গণ্ডগোল বাঁধাতে চাইছে। এমন একটা পাকিস্তানপন্থী শক্তিকে ভারত কেন হঠাৎ করে বিশ্বাস করতে যাবে?’

তারেক রহমানের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘বিদেশে ফেরার একজন কনভিক্টেভ ক্রিমিনালকে (দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী)যে দল ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়, তাদের ওপর একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক দেশ কীভাবে ভরসা রাখবে?’

এইচ টি ইমাম বলেন, ‘আর ভারতের রাজনীতিবিদ বা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আলোচনা করতে বিএনপির যে তিন নেতা দিল্লিতে এসেছিলেন, তাদের দিকেই তাকান না কেন! আমি কারও নাম করবো না, কিন্তু তাদের একজন তো আমাদের দেশে পাকিস্তান ও চীনের এজেন্ট হিসেবেও দীর্ঘদিন ধরেই পরিচিত।’

‘এইসব লোকের কথায় বিশ্বাস করে ভারত বিএনপিকে সমর্থন করার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেবে কিংবা পাকিস্তানের পাতা ফাঁদে পা দেবে— এমনটা মনে করার কোনও কারণ দেখছি না’, বলেছন এইচ টি ইমাম।

অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ওই সভায় প্রধানমন্ত্রীর এই রাজনৈতিক উপদেষ্টা আরও নানা দ্বিপক্ষীয় ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে খোলামেলা মন্তব্য করেন।

বহুল চর্চিত তিস্তা চুক্তি নিয়েও সরকারের অন্যতম এই নীতি নির্ধারক কথা বলেছেন অকপটে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তিস্তা চুক্তিকে তিনি বড় রকমের কোন ফ্যাক্টর বলেই মনে করছেন না। এইসব বিষয়ে সংবাদকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘‘তিস্তা এখন আর তেমন কোনও ব্যাপার নয়। এবারের নির্বাচনে বিরোধীরা নিশ্চয় বলার চেষ্টা করবে শেখ হাসিনার সরকার তো তিস্তা চুক্তিও করাতে পারলেন না, ভারত কিছুই দিলো না ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা কিন্তু পরিষ্কার বলতে চাই, তিস্তা এখন আর তেমন কোনও বড় সমস্যা নয়।’

তিস্তা চুক্তি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও উদাহরণও তুলে ধরেন। এইচ টি ইমাম বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী একটা কথা খুব বলেন, আমরা হলাম নদীর ভাঁটির দেশ। পানি এখানে ঠিকই আসবে, আসতে বাধ্য। একটা নদীকে কেউ মুছে দিতে পারবে না, আর তাই আজ হোক কাল, পানির ভাগাভাগি নিয়েও চুক্তিও ঠিকই হবে।’

তিনি বলেন, ‘আসলে দুটো প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সদিচ্ছা আর সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী (অ্যাটিচিউড) থাকলে যেকোনও বড় সমস্যাই মিটিয়ে ফেলা যায়। সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে আমাদের নাগরিকদের মৃত্যু কিংবা ফেন্সিডিল পাচারের রমরমা নিয়ে একসময় হইচই কম হয়নি। কিন্তু এখন সীমান্তে মৃত্যুও প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। ভারতের দিকে ফেন্সিডিল বানানোর করাখানাগুলোও বন্ধ হওয়াতে পাচারও থেমে গেছে। তাই আমাদের কোনও সন্দেহ নেই ঠিক সেভাবে তিস্তারও একদিন সুরাহা হবে!’

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘চীন ফ্যাক্টর’ নিয়ে ভারতের দুশ্চিন্তার কিছু নেই এই বিষয়টিও খোলাসা করেছেন এইচ টি ইমাম। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নির্বাচন কমিটির এই কো-চেয়ার বলেছেন, ‘চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা পুরোপুরি বাণিজ্যিক। আমাদের দেশের রাজনৈতিক ব্যাপারে তাদের কোনও আগ্রহ নেই। তারা শুধু ঢাকায় একটা রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল সরকার দেখতে চায়। যা তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থের অনুকূল হবে।’

চীন এবং পাকিদের মধ্যকার গভীর সম্পর্কের উদাহরণও অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সভাতে দিতে ভুল করেননি তিনি। সরকারের বর্ষীয়াণ এই নীতি নির্ধারক বলেছেন, ‘চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে যে ধরনের গভীর সম্পর্ক আছে, আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক তার কোনও তুলনাতেই আসবে না।

বরং পাকিস্তান আমাদের চিরশত্রু একটা দেশ, পাকিস্তান ভেঙেই আমাদের জন্ম। এটা মাথায় রাখলে বলতে হয় চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কখনও সেই স্তরে পৌঁছাবে না। বাংলাদেশে এখন আর এমন কোনও রাজনৈতিক দলই নেই, যারা ‘চীনের মুখ চেয়ে রাজনীতি করে’!

কালের আলো/এসএস/এএ

Print Friendly, PDF & Email