ভাইরাসের বাম্পার ফলনের হ্যাচারিতে ডুবসাঁতার
প্রকাশিতঃ 10:25 am | March 18, 2020

মোস্তফা কামাল :
ইতালিতে নিয়ম-নীতি, সভ্যতা মানলেন। দেশে ফিরে বেপরোয়া। শালা-শালি নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে বেরিয়ে পড়ছেন। সেজেগুজে ঢাকার বাইরে ঘুরতে এমন কি পিকনিকেও চলে যাচ্ছেন। ৫ মার্চ দেশে ফিরে বেরিয়ে পড়লেন সাজেক ঘুরতে। ঢুকলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে বন্ধুদের কাছে। খবর পেয়ে সেখান থেকে ইতালিফেরত ওই যুবক দস্তগীর হোসাইন মাহফুজসহ ছয়জনকে উদ্ধার করে ফৌজদারহাটের ট্রপিক্যাল ও ইনফেকশাস ডিজিজ ইন্সটিটিউটে কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বন্ধুরাও কেউ মূর্খ-অশিক্ষিত নন। চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যালয়ের দু’জনের সঙ্গে দু’জন মেডিকেল শিক্ষার্থীও রয়েছেন। এটাই বুঝি আমাদের বৈশিষ্ট্য?
একটি ছোট্ট ভাইরাস গোটা পৃথিবী তছনছ। লোকালয়ের পাশাপাশি দেবালয়েও ছন্দ বদলে দিয়েছে। গির্জার ঘন্টা থেমে আছে, মসজিদে আজান থমকে গেছে। মন্দিরে নেই আরাধনা। এই ঠেলায়ও না-খাস্তাপনা কমলেও কমতে পারতো। চিকিৎসকদের দিক থেকে, সরকারের তরফে বলা হচ্ছে জনসমাগম এড়িয়ে চলতে। ছোট দেশ আর বড় জনসংখ্যার কারণে আমাদের বাস্তবতা একটু কঠিন। জনপরিবহনের ভিড়ে অন্যের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলা মুশকিল। বাসের হাতল, সিঁড়ির রেলিং, লিফটের বোতাম, রেস্টুরেন্টের চেয়ার-টেবিল-গ্লাস-প্লেট-তোয়ালে, অফিস-আদালতের চেয়ারের হাতল, ব্যাংক-নোট, দোকানীর দেওয়া প্যাকেট না ছুঁয়ে থাকা সম্ভব নয়। মাত্রা তো কমানো যায়।
সেইক্ষেত্রে সরকারের করণীয় অনেক কিছু থাকে না। কিছু কাজ তো আছে, যা সরকারকেই বলতে হবে কেন? প্রধানমন্ত্রীকে কেন দিতে হবে হাত ধোয়ার পরামর্শ? মানুষকে অজু-গোসল করে সাফ সচুর রাখার দায়িত্বও প্রধানমন্ত্রীর? যত্রতত্র থুতু ফেলা, পানের পিক ফেলা এবং নাক ঝাড়া বন্ধ করতে সরকারের আদেশ- অনুরোধ লাগছে। ভাইরাসের এই হ্যাচারিতে নাগরিকরা চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতলসহ আবর্জনা ফেলে ভাগাড় তৈরি করলে সরকার বা রাষ্ট্র কি করতে পারে? আমরা কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া দাওয়া করলেও, সাবান দিয়ে কব্জি ডুবিয়ে ধুতে চাই না।
এখানে রাস্তায় বের হলেই মানুষের মুখে কফ-থুথু, পানের পিক ইত্যাদি জমে, নাকে সিনকি আসে।
কোনো কোনো অফিস-আদালতও এক-একটি ডাস্টবিন। হাসপাতাল আরও বড় ডাস্টবিন। ফুটপাতে কুকুরের মতো পেসাব-পায়খানার অবাধ স্বাধীনতা রয়েছে। মানুষ হ্যান্ডশেক ছাড়াও এক্সট্রা মহব্বত দেখাতে গায়ে হাত দিয়ে কথা বলে। দুপুরবেলা সিটি কর্পোরেশনের টুপিখোলা ময়লার গাড়ি রাস্তায় জয়রাইড দেয়। এখানে ব্যাংক-নোট মানে এক একটি ময়লার ভাগাড়। একবার স্পর্শ করলে করোনার চোদ্দগুষ্টি একসাথে মিছিল করে শরীরে ঢোকার নিশ্চয়তা রয়েছে। এসবের জন্য কাউকে দায়ী করা হয় না। দায়ী করা যায়ও না। কোথাও জবাব দিতে হয় না! ভাইরাসের এ রকম বাম্পার হ্যাচারিতে নাক ডুবে থাকার পরও এখনতক বেঁচে থাকা পরম সৌভাগ্য অনেকের জন্য। আর ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে আল্লাহর খাস রহমত।
একশ’রও বেশি দেশে এখন করোনা ভাইরাস তার রাজত্ব কায়েম করছে। সারা দুনিয়া লক ডাউনে আত্মরক্ষা করছে। আমেরিকা ইউরোপের সাথে সব ফ্লাইট বন্ধ করছে। ইউরোপ আমেরিকায়, এমন কি মধমধ্যপ্রাচ্যে পর্যন্ত দেশে দেশে স্কুল-কলেজ বন্ধ করছে। সব ধরনের ফেস্টিভ্যাল বন্ধ করা হচ্ছে, ভারত পর্যন্ত সব দেশ থেকে পর্যটক আসা নিষিদ্ধ করছে। মুসলিম দেশগুলোতে পর্যন্ত জুমার সমাবেশ পর্যন্ত বন্ধ করা হচ্ছে। কিন্তু, আমরা? সরকারের ব্যর্থতা খুঁজছি। সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিচ্ছি। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে উন্নত এবং ধনী দেশগুলোও এই মহামারী সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। সেখানে আমরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটি পেছানো দেশ হয়েও নিজের ঝুঁকি নিজে ম্যানেজ করতেও রাজি নই। করোনাসহ নানা ভাইরাস আমন্ত্রণে আমরাই যথেষ্ট। আলামত এবং পারিপার্শ্বিকতায় জানাই ছিল বাংলাদেশ রেহাই পাবে না। ভাইরাস আসবেই। কার সাথে কথা বলছি, ঘুরছি- একটুও ভ্রুক্ষেপ নেই। সেল্ফ কোয়ারেন্টাইন বুমেরাং হচ্ছে পদে পদে। স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবিধিও মানতে নারাজ আমরা। করোনা মোকাবিলার নামে মাস্ক পরে ঘুরছি। আবার এক বিড়ি ফুঁকছি চারজনে।
\
রাষ্ট্র তার মতো ব্যবস্থা নেবে, এটা আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু নাগরিক হিসেবে আমাদের নিজেদের সচেতনতার গুরুত্ব অনেক বেশি। মাস্ক আর স্যানিটাইজার নিয়ে যে কাণ্ড ঘটছে তা আমাদের অভ্যাস বদলানোর বার্তা দেয় না। তারওপর করোনার প্রভাবের চেয়ে বেশি ভয়াবহভাবে সামাজিক মাধ্যমে এর সম্পর্কে গুজব ছড়ছে। করোনা সম্পর্কে এমন কিছু তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে, যার সঙ্গে বাস্তবের কোনও মিল নেই। এতে অকারণে বাড়ছে আতঙ্ক। এমনকি মূলধারার কিছু কিছু গণমাধ্যমও এই দোষে দুষ্ট। তারা এমন শিরোনাম করছে যেন দেশ স্তব্ধ বা অচল হয়ে গেছে। এই ফাঁকে চীনের প্রধানমন্ত্রী আজান দিয়েছেন। মেয়েকে নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নামাজ পড়া শুরু করেছেন- এমন গল্প প্রচারও কম নয়। আজব বৈশিষ্টধারীরা একদিকে সব দায় ও দোষ সরকারের ঘাড়ে চাপায়। আরেকদিকে সব করার দায়িত্ব নিজে নেয়। করোনা নিয়ে বহু ডাক্তারিও করে। লাঙ্গলে দক্ষজনও রকেট চালাতে চায়। রকেট চালানোর গল্প বানায়। বিশ্বের কোনো দেশে এতো ডাক্তার, ধর্মপ্রচারক, বিজ্ঞানী একসাথে এতো কাজ করে?
আরো মর্মান্তিক সত্য হলো- এখনো আমরা ডেঙ্গু আর চিকনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। গত মৌসুমেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা নিয়ে চলেছে কানামাছি গেম। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন তো ওই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলার পরিবর্তে ‘টম এন্ড জেরি শো’ দেখিয়েছে। সামনে কোন খেলা দেখাবে সেটার জন্য অপেক্ষা ছাড়া আপাতত আর কোনো গতি নেই। এদিকে বৃষ্টির মৌসুম শুরু হলেও ডেঙ্গু প্রতিরোধে দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। ডেঙ্গু মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লে দায়িত্বশীলরা কে কি বলবেন তা কমবেশি জানা আছে। করোনার মত ডেঙ্গু আর চিকনগুনিয়া প্রতিরোধেও আমাদেরই সচেতন হতে হবে, প্রস্তুত থাকতে হবে রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য। আর হেরে গেলে মৃত্যুকে বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়ার জন্য। এটাই অক্ষমতার বৈজ্ঞানিক সূত্র ও সামাজিক নীতি। নইলে সরকার, মুফতি ইব্রাহিমের কোডিং আর ভারতের আবিষ্কার গোবিষ্ঠা আর গোমূত্র থেরাপিই শেষ চিকিৎসা হতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ।