‘জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক এটা মেনে নেয়ার বিষয়ই না’

প্রকাশিতঃ 5:04 pm | March 27, 2018

কালের আলো ডেস্ক:

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এটা মেনে নেয়ার কোনো বিষয়ই না বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম।

সোমবার রাতে বেসরকারি টেলিভিশন ডিবিসি নিউজের টক শো ‘রাজকাহনে’ অংশ নিয়ে একথা বলেন এইচটি ইমাম।

নবনিতা চৌধুরীর উপস্থাপনায় ‘২৬ মার্চ স্বাধীন হলাম কীভাবে’ শীর্ষক টক শো’র অপর অতিথি ছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. হারুন-অর-রশীদ।

অনুষ্ঠানে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এই সত্য কথাকে আওয়ামী লীগ মেনে নিচ্ছে না-দর্শকদের এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে চান উপস্থাপক। জবাবে এইচটি ইমাম বলেন, ‘জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এটা মেনে নেয়ার কোনো বিষয়ই না। কারণ আমি তো তখন ছিলাম। জিয়াউর রহমান ২৪ মার্চ পর্যন্ত সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করেছেন। এবং তখন বাঙালি ডক শ্রমিকদের ওপর গুলি করেছে জিয়াউর রহমানের সৈনিকরা। পরদিন ২৫ মার্চ তিনি যখন আবার যাচ্ছিলেন তখন ক্যাপ্টেন খালেক পথরোধ করে বলেন, আপনি যেতে পারবেন না। পরে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর যে লিখিত ঘোষণা সেটা ওয়ারলেস মারফত সব জায়গায় চলে আসছিল। আমরাও পেয়েছি।’

প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা বলেন, ‘প্রথম তো স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন এম এ হান্নান, এরপর ড. শফি। তারপর এম আর সিদ্দিকি, পরে আবুল কাশেম সন্দীপ। সন্দীপ ছিল বেতারের কর্মকর্তা। আর ২৬ মার্চেরও পরে জিয়াউর রহমান যখন গেলেন তখন একে খান বললেন তোমরা তো সিভিলিয়ান রাজনীতিবিদরা ঘোষণা করছো। কিন্তু এখানে সেনাবাহিনীর কেউ যদি ঘোষণা করুক। তখন প্রথমে জিয়াউর রহমান নিজের নামে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সবাই বললো এটা আপনি করতে পারেন না। আপনি জিয়াউর রহমানকে কে চিনে? পরে ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা করেন।’

হারুন অর-রশীদ এই প্রশ্নের বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের তো স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে ২৭ মার্চ তো স্বাধীনতা দিবস হওয়া উচিত ছিল তাই না?’

২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস হয়ে উঠলো কীভাবে? আমরা কতটা প্রস্তুত ছিলাম- এমন প্রশ্ন করেন নবনিতা চৌধুরী।

এইচটি ইমাম এমন প্রশ্নের বিষয়ে বলেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণার আগের অনেক ঘটনা আছে। বঙ্গবন্ধু হলেন জাতির পিতা এবং স্থপতি। বাংলাদেশ নামের একটি ভূখণ্ড যে এভাবে হবে এই চেতনা আসতে অনেক সময় লেগেছে। প্রথম যখন জিন্নাহ যখন ঢাকায় ঘোষণা করলো উর্দু হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তখন ছাত্র জনতা না না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করলো। তখনও বঙ্গবন্ধু পূর্বভাগে ছিলেন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সময় আমাদের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আন্দোলন, একুশে ফেব্রুয়ারি যা বাঙালিকে বিশালভাবে নাড়া দিয়ে গেল। এর দুই বছর পরই যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলো। সেখানে বঙ্গবন্ধু বড় একটি ভূমিকা রাখলেন। একদিকে মওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু।’

‘এরপর তিনি প্রাদেশিক মন্ত্রী হলেন। পরে দল গঠন করার জন্য, দলের কাজে আত্মনিয়োগ করার জন্য মন্ত্রী পদ ছেড়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলেন। তারপর ৫৬ সাল, ৫৮ সালে মার্শাল ল, পরে ছাত্র আন্দোলন, এরপর ৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা। সবকিছু ভালোভাবে দেখলে দেখবেন ছয়দফার মধ্যেই স্বাধীনতার বীজটি লুকানো ছিল। ছয়দফার পর এসে গেল আগরতলা মামলা। এরপর গণঅভ্যুত্থান। এরপর তাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেয়া হলো বঙ্গবন্ধু উপাধি। এরপর ৭০সালে নির্বাচন। নির্বাচনের ফলাফল তো আমরা জানি। এরপর ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ। ’- বলেন এইচ টি ইমাম।

প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, ‘পূর্বপ্রস্তুতি তো অনেক আগে থেকেই ছিল। যদি মার্চ মাস ধরেন, ১ মার্চ যখন ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেন অধিবেশন বসছে না তখন তো দেশ উত্তাল। পরে ৩ মার্চের পর অসহযোগ আন্দোলন। এরপর ৭ মার্চের ভাষণ। সেখানে তো সবই আছে। ওই ভাষণের প্রতিটি বাক্যের মধ্যে একেকটি বাণী ছিল।’

এইচটি ইমাম বলেন, ‘এই যে দীর্ঘকাল গেল, বঙ্গবন্ধু ২৪ বছরের মধ্যে ১৪ বছর জেলে কাটিয়েছেন। পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারেননি। সন্তানদের সময় দিতে পারেননি। বঙ্গমাতা এই সময়ের মধ্যে তিনিই সবকিছু দেখে রেখেছেন।’

২৬ মার্চ কীভাবে সবাই একত্রে প্রতিরোধে নেমে পড়লাম? এমন প্রশ্নের জবাবে এইচটি ইমাম বলেন, ‘আগে থেকেই জাতিকে তৈরি করছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১ মার্চের পর থেকেই সর্বত্র যাদের সুযোগ ছিল তারা বিশেষ করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা মেলিটারি ট্রেনিং নেয়া শুরু করে। আমাদের মধ্যেও যাদের সুযোগ ছিল তারা তৈরি হয়।’

২৬ মার্চ ঘোষণা দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু কতটা প্রস্তুত ছিলেন। ২৫ মার্চের জন্য বাঙালি নেতাদরে কি একটা অপেক্ষা ছিল কি না যে আগে ওরা আঘাত করুক পরে আমরা প্রতিহত করবো- এই প্রশ্নের জবাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. হারুন অর রশীদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বিচ্ছিন্নবাদী আন্দোলনের নেতা হতে চাননি। বঙ্গবন্ধু ৭১ সালের মার্চ মাসে অনেক সাক্ষাৎকার দেখবেন সেখানে এসব বিষয় আছে। বঙ্গবন্ধু কৌশল গ্রহণ করেছিলেন অল থ্রু। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমরা কেন বিচ্ছিন্নবাদী হব? আর পশ্চিম পাকিস্তানিরা হলো মাইনরিটি। তারা না থাকতে চাইলে বিছিন্ন হয়ে যাক। ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল নিউজ উইকে ‘পোয়েট অফ পলিটিক্স’ শিরোনামে নামের একটি প্রতিবেদন করেছিল। জিংকিংস নামের একজন সাংবাদিকের করা প্রতিবেদনে বলা ছিল- ৭ মার্চের ভাষণের একমাস আগে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ৪৭ সালে পাকিস্তান যে গঠন হয়েছে সেটা শেষ। এটা টিকিয়ে রাখার কোনো সম্ভাবনা নেই। এটা এখন কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবে সেটাই বিষয়।

জাতীয় বিশ্ববিদালয়ের ভিসি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাঙালি জাতির যে জাতীয় উত্থান হয়েছিল সেটা মূলত একটা স্বাধীন সত্তায় পরিণত হয়েছিল। যদিও আইনগতভাবে বহিবিশ্বের স্বীকৃতি সেটা অন্য বিষয়। স্বাধীন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এই স্লোগান উঠে গেছে, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ হয়ে গেছে, পতাকা উত্তোলন হয়ে গেছে। তখন বঙ্গবন্ধুর হাতে গোটা প্রশাসন। কিন্তু যেটা দাঁড়ালো তিনি যে ৭ মার্চ যে ভাষণ দিলেন যেখানে স্বাধীনতার কিছু বাকিও রাখলেন না। আবার বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাও বলা যাবে না। কিন্তু ওই ভাষণের মধ্যে যেসব কথা বলেছেন তাতে যেমন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলো, এতে কি বোঝা যায় প্রস্তুতি ছিল না?

হারুন অর রশীদ বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কিছু ঘটলে সাধারণ মানুষও সেই সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা থাকে। বঙ্গবন্ধু তখন অবিসংবাদিত নেতা। দেশি বিদেশি কোথায় কী হচ্ছে তা সব তার নখদর্পণে ছিল। ১৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান, ভুট্টো যে আলোচনার নামে কালপেক্ষণ করছিল ফাঁকে ওরা অস্ত্র, সৈন্য আনছিল এটা বঙ্গবন্ধু জানতেন। কিন্তু তিনি প্রথমে যুদ্ধ ঘোষণা করতে চাননি। তার কৌশল ছিল প্রথমে পশ্চিম পাকিস্তানিরা আঘাত করুক তারপর যা করার। যদি তার প্রস্তুতি না থাকে তাহলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে যখন স্বাধীনতার ঘোষণা করার পর গ্রেপ্তার হলেন তখন কীভাবে সারাদেশে একযোগে প্রতিরোধ হলো?’

বঙ্গবন্ধুর কাছে তাজউদ্দিন আহমেদ টেপ রেকর্ডার নিয়ে যাওয়ার পরও বঙ্গবন্ধু কেন ঘোষণা রেকর্ড করে দেননি- দর্শকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু স্বকণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। না করার কারণ তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর যদি এটা প্রমাণ তুলে ধরত আপনার কণ্ঠে এই রেকর্ড। আপনি বিচ্ছিন্নতাবাদী। আপনার সাজা ফাঁসি। কাচে বঙ্গবন্ধু বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হতে চাননি। তিনি ওইভাবে ডকুমেন্টেড থাকুক সেটা চাননি। কিন্তু এমনভাবে সারাদেশে ম্যাসেজ দিয়ে দিয়েছেন যে মুক্তিযোদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।’

 

কালের আলো/ওএইচ

Print Friendly, PDF & Email