‘ত্যাগের মাধ্যমেই জনগণের দাবি আদায় করতে হবে’

প্রকাশিতঃ 2:24 am | March 17, 2018

কালের আলো:

বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক এক দিন ১৯৬৬ সালের ৭ জুন। এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। আর সেইদিন আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছিল পাকিরা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘কারাগারের রোজনামচা’য় এ বিষয়ে স্বীয় আবেগঘন প্রতিক্রিয়া লিপিবদ্ধ করেন। দৈনিক কালের আলো’র পাঠকদের জন্য তা হুবুহু তুলে ধরা হলো।

৮ই জুন ১৯৬৬ : বুধবার
ভোরে উঠে শুনলাম সমস্ত রাত ভর গ্রেপ্তার করে জেল ভরে দিয়েছে পুলিশ বাহিনী। সকালেও জেল অফিসে বহু লোক পড়ে রয়েছে। প্রায় তিনশত লোককে সকাল ৮টা পর্যন্ত জেলে আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ বৎসর বয়স থেকে ৫০ বছর বয়সের লোকও আছে। কিছু কিছু ছেলে মা মা করে কাঁদছে। এরা দুধের বাচ্চা, খেতেও পারে না নিজে। কেস টেবিলের সামনে এনে রাখা হয়েছে। সমস্ত দিন এদের কিছুই খাবার দেয় নাই। অনেকগুলি যুবক আহত অবস্থায় এসেছে। কারও পায়ে জখম, কারও কপাল কেটে গিয়াছে, কারও হাত ভাঙা। এদের চিকিৎসা করা বা ওষুধ দেওয়ার কোনো দরকার মনে করে নাই কর্তৃপক্ষ। গ্রেপ্তার করে রাখা হয়েছিল অন্য জায়গায়, সেখান থেকে সন্ধ্যার পর জেলে এনে জমা দেওয়া শুরু করে। দিনভরই লোক আনছিল অনেক। কিছু সংখ্যক স্কুলের ছাত্রও আছে। জেল কর্তৃপক্ষের মধ্যে কেহ কেহ খুবই ভাল ব্যবহার করেছে। আবার কেহ কেহ খুবই খারাপ ব্যবহারও করেছে। বাধ্য হয়ে জেল কর্তৃপক্ষকে জানালাম, অত্যাচার বন্ধ করুন। তা না হলে ভীষণ গোলমাল হতে পারে। মোবাইল কোর্ট করে সরকার গ্রেপ্তারের পরে এদের সাজা দিয়ে দিয়েছে। কাহাকেও তিন মাস, কাহাকেও দুই মাস, এক মাসও কিছুসংখ্যক ছেলেদের দিয়েছে। সাধারণ কয়েদি, যাদের মধ্যে অনেকেই মানুষ খুন করে অথবা ডাকাতি করে জেলে এসেছে তারাও দুঃখ প্রকাশ করে বলে, এই দুধের বাচ্চাদের গ্রেপ্তার করে এনেছে! এরা রাত ভর কেঁদেছে। ভাল করে খেতেও পারে নাই। এই সরকারের কাছ থেকে মানুষ কেমন করে বিচার আশা করে?

জেল কর্তৃপক্ষ কোথায় এত লোকের জায়গা দিবে বুঝে পাই না! ছোট ছোট ছেলেদের আলাদা করে রাখতে হয়। এরা জেলে আসার পরে খবর এলো ভীষণ গোলাগুলি হয়েছে, অনেক লোক মারা গেছে তেজগাঁ ও নারায়ণগঞ্জে। সমস্ত ঢাকা শহরে টিয়ার গ্যাস ছেড়েছে, লাঠিচার্জও করেছে। চুপ করে বসে নীরবে সমবেদনা জানান ছাড়া আমার কি করার আছে! আমার চরিত্রের মধ্যে ভাবাবেগ একটু বেশি। যদিও নিজকে সামলানোর মতো ক্ষমতাও আমার আছে। বন্দি অবস্থায় এই সমস্ত খবর পাওয়ার পরে মনের অবস্থা কি হয় ভুক্তভোগী ছাড়া বুঝতে পারবে না।

মেটের পীড়াপীড়িতে নাস্তা খেতে বসেছিলাম। খেতে পারি নাই। দুপুরে ভাত খেতে বসেছি একই অবস্থা। সঠিক খবর না পাওয়ার জন্যই মন আরও খারাপ। খবরের কাগজের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কাগজ আসতে খুব দেরি হতেছে, ২টার সময় কাগজ এলো। আমি পূর্বে যা অনুমান করেছি তাই হলো। কোনো খবরই সরকার সংবাদপত্রে ছাপতে দেয় নাই।

ধর্মঘটের কোনো সংবাদই নাই। শুধু সরকারি প্রেসনোট। ইত্তেফাক, আজাদ, অবজারভার সকলেরই একই অবস্থা। একেই বলে ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা’! ইত্তেফাক মাত্র চার পৃষ্ঠা। কোনো জেলার কোনো সংবাদ নাই। প্রতিবাদ দিবস ও হরতাল যে পুরোপুরি পালিত হয়েছে বিভিন্ন জেলায় সে সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ রইল না।

খবরের কাগজগুলি দেখে আমি শিহরিয়া উঠলাম। পত্রিকার নিজস্ব খবর ছাপতে দেয় নাই। তবে সরকারি প্রেসনোটেই স্বীকার করেছে পুলিশের গুলিতে দশজন মারা গিয়াছে। এটা তো ভয়াবহ খবর। সরকার যখন স্বীকার করেছে দশজন মারা গেছে, তখন কতগুণ বেশি হতে পারে ভাবতেও আমার ভয় হলো! কতজন জখম হয়েছে সরকারি প্রেসনোটে তাহা নাই। সমস্ত দোষই যেন জনগণের। যেখানে উস্কানি দিতেছে সরকারের প্রতিনিধিরা, আওয়ামী লীগ সেখানে পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছে, ‘শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ দিবস পালন করতে চাই।’ এবং সে অনুযায়ী তারা কর্মীদের নির্দেশও দিয়েছে। এখন জনগণকে দোষ দিয়ে লাভ নাই।

যেখানে পুলিশ ছিল না সেখানে কোনো গণ্ডগোল হয় নাই। চকবাজার ও অন্যান্য জায়গায় শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মঘট হয়েছে। সে খবর পেয়েছি। বেলা ১১টার সময় ১৪৪ ধারা জারি করে আর সাথে সাথে গুলি শুরু হয়। পূর্বে জারি করলেই তো কর্মীরা আর জনসাধারণ জানতে পারতো। যখন আওয়ামী লীগ তার প্রোগ্রাম খবরের কাগজে বের করে দিল তাতে পরিষ্কার লেখা ছিল, ১০টায় শোভাযাত্রা, বিকালে সভা শেষে আবার শোভাযাত্রা। তখন তো ১৪৪ ধারা জারি করে নাই। পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় সরকারের দালালেরা ও কিছুসংখ্যক অতি উৎসাহী কর্মচারী কোনো এক উপর তলার নেতার কাছ থেকে পরামর্শ করে এই সর্বনাশ করেছে।

সরকার যদি মিথ্যা কথা বলে প্রেসনোট দেয়, তবে সে সরকারের উপর মানুষের বিশ্বাস থাকতে পারে না। জীবন ভরে একই কথা শুনিয়াছি ‘আত্মরক্ষার জন্যই পুলিশ গুলি বর্ষণ করতে বাধ্য হয়’। এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে? যারা মারা গেল তাদের ছেলেমেয়ে, মা-বাবা তাদের কি হবে? কত আশা করে তারা বসে আছে, কবে বাড়ি আসবে তাদের বাবা। কবে আসবে তাদের ছেলে। রোজগারের টাকা আসবে মাসের প্রথম দিকে। এরা জেলে বন্দি, সহসা আর ফিরে যাবে না, টাকাও আর পৌঁছবে না সংসারে। এ কথা ভেবে ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছি আমি। কিছুতেই মনকে সান্ত্বনা দিতে পারছি না। কেন মানুষ নিজের স্বার্থের জন্য পরের জীবন নিয়ে থাকে?

তবে এদের ত্যাগ বৃথা যাবে না। এই দেশের মানুষ তার ন্যায্য অধিকার আদায় করবার জন্য যখন জীবন দিতে শিখেছে তখন জয় হবেই, কেবলমাত্র সময় সাপেক্ষ। শ্রমিকরা কারখানা থেকে বেরিয়ে এসেছে। কৃষকরা কাজ বন্ধ করেছে। ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ করে দিয়েছে। ছাত্ররা স্কুল-কলেজ ছেড়েছে। এতবড় প্রতিবাদ আর কোনোদিন কি পাকিস্তানে হয়েছে?

ছয় দফা যে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রাণের দাবিথ পশ্চিমা উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক শ্রেণী যে আর পূর্ব বাংলার নির্যাতিত গরিব জনসাধারণকে শোষণ বেশি দিন করতে পারবে না, সে কথা আমি এবার জেলে এসেই বুঝতে পেরেছি। বিশেষ করে ৭ই জুনের যে প্রতিবাদে বাংলার গ্রামেগঞ্জে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফেটে পড়েছে, কোনো শাসকের চক্ষু রাঙানি তাদের দমাতে পারবে না। পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য শাসকশ্রেণীর ছয় দফা মেনে নিয়ে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করা উচিত।

যে রক্ত আজ আমার দেশের ভাইদের বুক থেকে বেরিয়ে ঢাকার পিচঢালা কালো রাস্তা লাল করল, সে রক্ত বৃথা যেতে পারে না। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যেভাবে এ দেশের ছাত্র-জনসাধারণ জীবন দিয়েছিল তারই বিনিময়ে বাংলা আজ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। রক্ত বৃথা যায় না। যারা হাসতে হাসতে জীবন দিল, আহত হলো, গ্রেপ্তার হলো, নির্যাতন সহ্য করল তাদের প্রতি এবং তাদের সন্তান-সন্তুতিদের প্রতি নীরব প্রাণের সহানুভূতি ছাড়া জেলবন্দি আমি আর কি করতে পারি! আল্লাহর কাছে এই কারাগারে বসে তাদের আত্মার শান্তির জন্য হাত তুলে মোনাজাত করলাম। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এদের মৃত্যু বৃথা যেতে দেব না, সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। যা কপালে আছে তাই হবে। জনগণ ত্যাগের দাম দেয়। ত্যাগের মাধ্যমেই জনগণের দাবি আদায় করতে হবে।

সমস্ত দিন পাগলের মতোই ঘরে বাইরে করতে লাগলাম। যদি কেহ বন্দি পশুপক্ষী দেখে থাকেন তারা অনুভব করতে পারবেন। শত শত লোককে গ্রেপ্তার করে আনছে। তাদের দুরবস্থা চিন্তা করতে ভয় হয়। রাস্তায় যাকে পেয়েছে তাকেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে এসেছে। খালি গাথ কাপড় নাই, একদিন একরাত পর্যন্ত থানায় বা অন্য কোথাও আটকাইয়া রেখেছিল। খাবারও দেয় নাই। গোসল নাই। সাজা দিয়ে নিয়ে এসেছে। এদের কিছু লোককে কয়েদির কাপড় পরাইয়া দিয়েছে। আমি যেখানে ছিলাম তার পার্শ্বেই পুরানা বিশ সেলে রাতে ৮২ জন ছেলেকে নিয়ে এসেছে, বয়স ১৫ বছরের বেশি হবে না কারও। অনেকের মাথায় আঘাত, অনেকের পায়ে আঘাত, অনেকে হাঁটতে পারে না। হাকিম বাহাদুর বোধ হয় কারও কথা শোনেন নাই, জেল দিয়ে চলেছেন। রাতে জানালা দিয়ে দেখলাম এই ছেলেগুলিকে নিয়ে এসেছে। দরজা বন্ধ। জানালা দিয়ে চিৎকার দিয়ে বললাম, ‘জমাদার সাহেব এদের খাবার বন্দোবস্ত করে দিবেন। বোধ হয় দুই দিন না খাওয়া।’ মানুষ যখন অমানুষ হয় তখন হিংস্র জন্তুর চেয়েও হিংস্র হয়ে থাকে। রাত্রে আমি ঘুমাতে পারলাম না। দুই একজন জমাদার ও সিপাই এদের উপর অত্যাচার করছে। আর সবাই এদের আরাম দেবার চেষ্টা করেছে। কয়েদিরা ছোট ছোট ছেলেদের খুব আদর করে থাকে। নিজে না খেয়েও অনেককে খাওয়াইয়া থাকে। অনেকে নিজের গামছা দিয়েছে। যারা এদের উপর অত্যাচার করেছে তাদের কথা আমার মনে রইলো। নাম আমি লেখব না। রাত কেটে গেল। একটু ঘুম আসে, আবার ঘুম ভেঙে যায়।

কালের আলো/এসএস/ওএইচ

Print Friendly, PDF & Email