শিশুদের মৃত্যুকূপ আবর্জনাময় নবোদয় খাল
প্রকাশিতঃ 9:46 pm | March 10, 2018
নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :
‘আমার ফোলায় খেলতে গেছে আর আইছে না। আমার বুকের ধন, কেউ দেকছুইন। ময়লায় খাইয়ে ফেলছে। ব্যাকদিন খেলতে যায়, বাড়ি আয়, কাল আইছে না। ’
শনিবার (১০ মার্চ) সকালে নবোদয় হাউজিং এর ৮ নম্বর রোডের ১০ নম্বর বাড়িটিতে স্বজন আর প্রতিবেশীদের ভিড়ের মাঝখানে বসে এভাবেই আর্তনাদ করছিলেন জিসানের মা সুমি বেগম (৩৫)।
সুমির বুকফাটা আতনার্দে ভারি হয়ে ওঠে আশপাশের পরিবেশ। কিশোরগঞ্জের আবুল হাসেম ও সুমি বেগমের তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে সবার ছোট সন্তান জিসান।
প্রতিবেশীরা জানায়, ফুটফুটে জিসান, তিন ভাইবোনের মধ্যে ছোট। এ বছরই প্রথম কেজিতে ভর্তি হয়েছে ব্র্যাকের আনন্দ স্কুলে। প্রতিদিনের মতো বিকেলে খেলতে যায় সে। হাউজিংয়ের গেটের পাশে খালপাড়ে ক্রিকেট খেলছিল এলাকার আরও তিন শিশুর সঙ্গে। ক্রিকেটের বল আনতে গিয়ে নবোদয় খালে পড়ে যায় শিশু জিসান।
আবর্জনার স্তুপে ভরা আদাবরের নবোদয় খলটিতে পচা কালো পানিতে জিসানকে উদ্ধার করতে ঝাঁপ দেওয়া স্কুল ভ্যান চালক মো. সবুজ বলেন, ‘আমি যখন তাকে (জিসান) দেখি তখন সে পচা পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবে আছে। আমি ঝাঁপ দিলাম আর দেখি ছেলেটা ময়লা পানিতে পুরোপুরি ডুবে গেল। আমি ঠিক দুই হাত দূরে ছিলাম, হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করলাম ছেলেটাকে; কিন্তু ময়লার জন্য হাত পৌঁছালো না।
তিনি আরও বলেন, ‘ছেলেটি যেখানে পড়েছিল সেখানে অনেক খুঁজলাম। ওই স্থানের ময়লা সরালাম। কিন্তু তাকে পেলাম না। আবর্জনায় আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গা কেটে গেছে।’
এলাকাবাসী জানান, এর আগেও খেলতে গিয়ে ওই আবর্জনার খালে পড়েছে শিশুরা। এদের মধ্যে ছয়বছর আগে এক শিশু এ আবর্জনার স্তূপের গভীরে পচা পানিতে পড়ে মারা গিয়েছিল। এছাড়া বাকি যে শিশুরা এ খালে পড়েছিল, তাদের কেউ না কেউ সেখানে ঝাঁপ দিয়ে বাঁচিয়েছে।
শিশু জিসানকে বাঁচাতে আবর্জনার স্তুপে স্থানীয় ফয়েজ আহমেদ বলেন, ২-৩ সপ্তাহ আগেও এক শিশু এই আবর্জনার স্তুপে পড়ে ডুবে যেতে নিয়েছিল। কিন্তু সময় মতো আমি ঝাঁপ দেওয়ায় শিশুটিকে উদ্ধার করতে পারি।
খালটির ময়লা ফেলতে ফেলতে এমন স্তুপ হয়েছে, এতে যে কোনো শিশু হেঁটে যেতে পারত। খেলার সময় বল ওই খালে পড়লে সাধারণত শিশুরা সেটি আনতে যেত। কিন্তু আবর্জনার স্তূপের মাঝে কিছু কিছু জায়গায় খাদ থাকায় সেখানেই শিশুরা পড়ে যায়।
নবোদয়ের বাসিন্দা মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, আমি এ এলাকায় গত ১৫-১৬ বছর ধরে আছি। যখন থেকে আছি, তখন থেকেই খালের এমন অবস্থা দেখছি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে উদাসীন। দুই-তিন মাস পর পর খালের ময়লা সরিয়ে একপাশে রাখা হয়। কিন্তু এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় না। বৃষ্টির পড়লে সব ময়লা দিয়ে খাল আবার ভরাট হয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, বছর খানেক আগে এক শিশু বল আনতে গিয়ে এ আবর্জনার পানিতে ডুবে যেতে নেয়। পরে আমি ঝাঁপ দিয়ে তাকে বাঁচিয়। তবে ছয় বছর আগে এক শিশু এই পানিতে ডুবে যায়। জিসানের মত করেই ওই শিশুটি মারা যায়।
এই খালটির গভীরতা এক রকম নয়। কোথাও ৫ ফুট, কোথাও ১০ ফুট, কোথাও ২০ ফুট। বেশি গভীর খাদে পড়ে গেলে শিশুদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না বলেও জানান আনোয়ার।
নবোদয় হাউজিংয়ের বাসিন্দারা জানান, তাদের এলাকার আশেপাশে শিশুদের জন্য কোন খেলার মাঠ নেই। শিশুরা বাধ্য হয়েই বাসার সামনের রাস্তায় খেলাধূলা করে। কয়বছর আগেও এখানকার শিশুরা পরিত্যক্ত জায়গাতেই খেলাধূলা করত। কিন্তু হঠাৎ কত কয়েক বছরে অসংখ্য ফ্লাট নির্মাণ হওয়ায় খালি জায়গা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে। নবোদয় হাউজিংয়ের এক পাশেই এ খালটির অবস্থান।
শুক্রবার বিকেলে নবোদয় খালে পড়ে যায় পাঁচ বছর বয়সী শিশু জিসান। এরপর স্থানীয়রা তাকে উদ্ধারে খালে নামলেও ময়লা-আবর্জনায় ঢাকা পড়ে শিশুটি। নিখোঁজের পাঁচ ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিস জিসানের খোঁজ পায়। পরে তাকে শিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
কালের আলো/ওএইচ