ভ্রমণ স্মৃতিতে অম্লান

প্রকাশিতঃ 10:16 am | July 14, 2025

মোঃ নূরুল ইসলাম খান:

আমাদের প্রিয় জন্মভূমি ফুলবাড়ীয়া উপজেলাকে নিয়ে আমি/আপনি কতটুকু গভীরভাবে হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান দিয়ে ভাবতে পেরেছি; আমার বলতে আপত্তি নেই, কিছু না কিছু ঘাটতি থাকতেই পারে। হয়তোবা আমরা কখনও সেভাবে ভাবতে নাও পারি। ২০০৭ সালে উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলে ঐ কমিটিতে একজন সাংবাদিক এর (ক্যাটাগরিতে) নাম থাকবে, ফুলবাড়ীয়া উপজেলা থেকে ৩ জন সাংবাদিকের নাম প্রস্তাব করা হয়। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা, এনএসআই/ডিজিএফআই এর মাধ্যমে আমার নাম চূড়ান্ত হয়। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) উপজেলা কমিটি অনুমোদন দেয়। সে থেকেই (প্রথম) কমিটিতে কাজ করার সুযোগ পাই। ২০১৩ সাল থেকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। গুরুত্বপূর্ণ ঐ পদে থেকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে সফলতা ও ব্যর্থতা বিচার্য বিষয়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ময়মনসিংহ অফিস কর্তৃক বিভিন্ন প্রোগ্রাম বাস্তবায়নে প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করেছি। আমার একটি অভিজ্ঞতা হয়েছে কোন কর্মে অধিনন্থ থেকে এ কমিটিতে দায়িত্ব পালন করা অনেক কঠিন, চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকিপূর্ণ। তা মোকাবেলা করেই কাজ করতে হয়। উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সঙ্গে প্রতিরোধ কার্যক্রমে দুদক জেলা অফিসের একজন সহকারী পরিচালক দায়িত্বে থাকেন। ডিডি মহোদয়ের সঙ্গে নানান কারণে যোগাযোগ কম হয়। গত ১৬ মে/২০২৫ ইং তারিখ (শুক্রবার) সকাল আনুমানিক সোয়া নয়টার দিকে ময়মনসিংহ দুদক অফিসের স্টাফ সেলিম ভাই হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়ে বলেন সাড়ে ১১ টার দিকে ময়মনসিংহ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক (ডিডি মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ভূইয়া) স্যার জরুরী এক কাজে ফুলবাড়ীয়ায় আসবেন, আপনাকে থাকতে হবে। একথা শোনার পর আমার খুবই আনন্দ লাগছিল। কারন এর আগে কখনও ডিডি স্যারের সঙ্গে এভাবে সময় দেওয়ার সুযোগ হয়নি।

আমার পূর্ব নির্ধারিত ব্যক্তিগত কাজ বাদ দিয়ে ডিডি স্যারের নাম শুনে নির্ধারিত সময়ের ৪/৫ মিনিট আগে উপজেলা পরিষদের সামনে উপস্থিত হলাম। স্যারের গাড়ী আসার পর উঠে বসলাম এবং গন্তব্য জেনে শিবগঞ্জ সড়ক দিয়ে রওনা হলাম। শুরু হলো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্গ……। আখালিয়া নদী খননের দৃশ্য; ২০০৫ সালে ৩১শে অক্টোবর থেকে আমার সম্পাদনায় ‘সাপ্তাহিক ফুলখড়ি’ পত্রিকাটি নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়ে ২০ বছর চলছে। ফুলখড়ি পত্রিকার নামের সাথে ফুলবাড়ীয়ার ইতিহাস জড়িত, ফুলবাড়ীয়ার পূর্বের নাম ছিলো ‘গোবিন্দগঞ্জ’ কথিত আছে ফুলখড়ি এক প্রকার ঔষুধী গাছ আবার কেউ কেউ বলেন ফুলখড়ি এক প্রকার লাকড়ি জাতীয় গাছ। এ গাছটি এক সময় ফুলবাড়ীয়া সদরে প্রচুর পরিমাণে জন্মাতো, তৎকালীন এক পোস্ট মাস্টার ফুলখড়ি থেকে ফুলবাড়ীয়ার নামকরণ করেন। সরকারি বিজ্ঞাপন ছাড়া, স্থানীয় ছোট ছোট বিজ্ঞাপনের টাকায় খরচ নির্বাহ হয়। বর্তমানে আমার সহোদর ছোট ভাই মোঃ আশরাফউজ্জামান খান ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন।

আমার সাংবাদিকতায় প্রায় ৩৮ বছর এবং শিক্ষকতায় ২৫ বছর চলছে, বিশেষ করে ফুলখড়ির পত্রিকার মাধ্যমে আমি অনেক সম্মান পেয়েছি। প্রতি সোমবার আসলে পাঠকরা ফুলখড়ি হাতে পাওয়ার প্রত্যাশা করে, ইহা কিছুটা হলেও অর্জন। ফুলবাড়ীয়ার কিছু সম্মানিত সাংবাদিক নিউজ দিয়ে সহযোগিতা করেন, আমি স্থানীয় ফুলবাড়ীয়ার বিজ্ঞাপনদাতা ও সাংবাদিকদের প্রতি কৃতজ্ঞ।

আমাদের একটি প্রি-ক্যাডেট স্কুল (জায়দা মডেল প্রি-ক্যাডেট স্কুল) আছে, ২০০৭ সালে ৫ ডিসেম্বর বুধবার তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব সাবিরুল ইসলাম স্যার স্কুলটি উদ্বোধন করেছিলেন। আমি প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা ও পরিচালনা কমিটির সভাপতি। এ স্কুলটি আমার শ্বাশুড়ির নামে নামকরন করা হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া প্রবাসী ছিল আমার সমন্দি মোঃ শেখ সাদী ভাই তাঁর জমি ও তাঁর টাকায় বাড়ী ঐ স্কুলটি ১৮ বছর যাবৎ চলছে। আমার স্ত্রী প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বে আছেন। এ স্কুলের মেধাবী শিক্ষার্থীরা বর্তমানে মেডিকেল, ঢাবিঃ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালে লেখাপড়া করছে- যাদের নিয়ে গর্ব করা যায়। আপনি তাহলে একজন শিক্ষাবিদ-আমি বললাম না স্যার। তিনি উল্লেখিত পত্রিকা ও স্কুলের কথা শুনে দারুণ খুশি হয়ে প্রশংসা করে বলেন, মানুষের জন্য ভালো কিছু করার মাধ্যম হলো এগুলো- আমি আপনার পত্রিকাটি নিয়মিত পড়ি। পর্যায়ক্রমে মাঠ-ঘাট প্রাকৃতির মনোরম দৃশ্য দেখে স্যার জানতে চাইলেন ফুলবাড়ীয়ায় অর্থকরী ফসল কি কি? আমি বললাম ফুলবাড়ীয়াতে প্রচুর পরিমাণে ধান চাষ হয়। এখানে মৎস্য খামার, পোল্ট্রি ফার্ম, আখ, আনারস, হলুদ, কাঁঠাল ও সবজি ব্যাপকভাবে চাষাবাদ হয়। একথা শোনার পর ডিডি স্যার বললেন এতো কিছু আছে ফুলবাড়ীয়াতে আপনি এর আগে কখনও বলেননি কেন? আমি বললাম আপনি সব জানেন, স্যার বললেন আমি জানব কিভাবে আপনারা যদি না বলেন। এটা ছিল ডিডি স্যারের ফুলবাড়ীয়াতে প্রথম সফর। এরপর স্যারের নির্ধারিত কাজ শেষ করে স্যার বললেন, ফুলবাড়ীয়াতে দেখার মতো কি আছে? আমি বললাম বড়বিলা, দীপ্ত অর্কিড, রাবার বাগান ইত্যাদি। স্যার তাৎক্ষণিভাবে দীপ্ত অর্কিড দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমি বললাম অর্কিড তো ফুলবাড়ীয়া সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে কাহালগাঁও অবস্থিত। স্যার বললেন, আমরা রাস্তায় যে কোন এক মসজিদে জুমার নামাজ সেরে নেব, এনায়েতপুর বাজার জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করলাম। নামাজের পর এনায়েতপুর বাজার থেকে স্যার ছোট ছোট আনারস ক্রয় করলেন।

যথারীতি কাহালগাঁও এর উদ্দেশ্যে রওনা হই এবং সেখানে এক হোটেলে দুপুরের খাবার সেরে নেই। অতঃপর বহু কাঙ্খিত দীপ্ত অর্কিড বাগানের সামনে গিয়ে অনুমতি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করার পর নানান রং-বেরঙের ফুলগাছগুলো সম্পর্কে অজানা তথ্য জানতে ডিডি স্যারের প্রবল আগ্রহ লক্ষণীয় এর ফাঁকে ফাঁকে স্মৃতিটাকে ধরে রাখতে ফটোসেশন চলছে। ১৭ বিঘা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত দীপ্ত অর্কিড বাগান অধিকাংশ পরিদর্শন করলেন, এ যেন এক অপরূপ পরিদর্শন। এক পর্যায়ে স্যারকে বললাম সোয়াইতপুরে আমার এক আত্মীয় আছে তিনি টানা ৩ বার উপজেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন, ফুলখড়ি পত্রিকায় আলাদাভাবে কিছুদিন আগে নিউজ দিয়েছি, তাঁর বাসায় যাব-একথা শোনার পর স্যার আপত্তি করলেন না, তখন আমার ভীষণ আনন্দ লাগছিল তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। তাঁর (প্রধান শিক্ষক মোঃ শাহীনুর রহমান মাসুদ তালুকদার) বাসায় যাওয়ার পর তিনি বিভিন্ন রকম ফলমূল, নুডুলস ও চা দিয়ে আপ্যায়ন করলেন, যা ছিল মনে রাখার মতো। স্যারকে বললাম উনার পিতা ছিলেন এই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান (মরহুম আলহাজ আব্দুর রাজ্জাক তালুকদার) সাহেব। তিনি অনেক সামাজিক লোক ছিলেন। তাদের জমিতে সোয়াইতপুর উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত। পড়ন্ত বিকেলে সন্তোষপুর রাবার বাগানের উদ্দেশ্যে রওনা হই। পাটিরা বাজারে দেশী শসা ও কলা ক্রয় করে সেখান থেকে কেশরগঞ্জ বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হই। কেশরগঞ্জ পৌছায় আগেই শুরু হলো বৃষ্টি-সামনে যত যাচ্ছি, প্রচন্ড বাতাস আর বৃষ্টি সড়কে গাছপালা হেলে যাওয়ার দৃশ্য দেখে মনে হলো এখান দিয়ে ঝড় হয়েছে। আছরের সময় রাবার বাগানে পৌছলাম। সেখানে গেটে দেখি অনেক লোকজন জড়ো হয়েছে, আবার কেউ কেউ ছোটাছুটি করছে। রাবার বাগানের ভিতরে প্রবেশ করে (মসজিদে) আছরের নামাজ আদায় করে নিলাম।

পর মুহূর্তে ইমাম সাহেব বললেন এখানে দুটি বজ্রপাত হয়েছে; দুটি বড় বড় গাছ চৌচির হয়ে গেছে এবং বিদ্যুতের তার ও মিটার সম্ভবত পুড়ে গেছে। নামাজ আদায় করে বনের বানর দেখতে রওনা হলাম, হঠাৎ বৃষ্টি হওয়ার কারনে লালমাটি ফুসে উঠেছে-পা রাখতে হয় দেখে দেখে, আমাদের সঙ্গী অপর তিনজন তারা দ্রুতবেগে চলে গেছেন, আমরা পেছনে পড়েছিলাম। ডিডি স্যারকে বললাম সন্ধ্যা ঘনিয়ে অন্ধকারে (গাড়ীর কাছে) যাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। স্যার বললেন আমি একবার বানর দেখেছি আমার তেমন আগ্রহ নেই। আমি বলালম আমিও দুইবার এখানে বানর দেখতে এসেছি। অতঃপর আবার পিছনের দিকে অর্থাৎ গাড়ীর দিকে ছুটলাম। সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে বৃষ্টির পর প্রকৃতি যেন অপরূপে সেজেছে, দৃশ্যটি মনে রাখার মতো। ডিডি স্যার আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে মোবাইল সেটে সেলফি নিলেন, আমি স্যারের মোবাইল দিয়ে স্যারের একক বেশকিছু ছবি উঠালাম। একপর্যায়ে স্যার বললেন এভাবে ভিডিও করেন স্যার রাবার বাগানের সেই সৌন্দর্যের কথা হেঁটে হেঁটে উপস্থাপন করে যাচ্ছেন আমি তা ভিডিও রেকর্ড করলাম। আমার জীবনে ঐদিন ছিল মোবাইলে প্রথম ভিডিও এবং অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা অর্জন। ডিডি স্যার ঐ ভিডিও এডিট করে আমাকে দেখালেন, আমি মনে মনে ভাবলাম এটা আমার আরেক নতুন অভিজ্ঞতা! ডিডি স্যার একজন হাস্যেজ্জল ও চৌকস কর্মকর্তা, এবং সাহিত্যমনা মানুষ এতে কোন সন্দেহ নেই-স্যারের উপস্থাপনায় তা পরিলক্ষিত হয়েছে।

রাবার বাগানে মাগরিবের নামাজ আদায় করে ফুলবাড়ীয়ার উদ্দেশ্যে শিবগঞ্জ পাটুলী পানের কন্ট্রোল এলাকা পাকা সড়ক দিয়ে রওনা হই। সড়কের ধারে পানের বরজ স্যারকে দেখালাম, এভাবে রাত ৮টার দিকে ফুলবাড়ীয়ায় পৌছে কুটুমবাড়ীতে একটু বিরতি দিয়ে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার প্রাক্কালে স্যার বললেন ফুলবাড়ীয়া অনেক কিছুতে সমৃদ্ধ যা মনে রাখার মতো! স্যারকে বিদায় দিয়ে আমি বাসায় রওনা হলাম। সেইদিন প্রায় সারাদিনের ভ্রমণ ছিল আমার জীবনের এক ব্যতিক্রম ভ্রমণ-যা স্মৃতিতে অম্লান হয়ে থাকবে। আমাদের যান্ত্রিক জীবনে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখা বা উপভোগ করার জন্য একটু সময় বের করা অনেক কঠিন। যা কিছু হয় সবকিছু মহান আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে হয়। আমরা যা চিন্তা করি না- তাও হয়ে যায়, এটাই স্বাভাবিক ও বাস্তবতা। এটাই বিধাতার কুদরত-এটা মানতেই হবে।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক, সাপ্তাহিক ফুলখড়ি, উপজেলা প্রতিনিধি দৈনিক যায়যায়দিন, সাধারণ সম্পাদক, উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, ফুলবাড়ীয়া, ময়মনসিংহ।