টেলিভিশনের সংকট, চ্যানেল ২৪ এর পদোন্নতি ও অন্যান্য তর্ক
প্রকাশিতঃ 11:28 pm | May 05, 2019

কালের আলো ডেস্ক:
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মীদের নানা অজুহাজে হঠাৎ ছাঁটাই করা হচ্ছে। বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে টেলিভিশনের সংবাদ বিভাগ।
কেন হঠাৎ গণমাধ্যমকর্মীদের ছাঁটাই করা হচ্ছে বা এর নেপথ্যের কারন কি? এসব বিষয় নিয়ে বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল ২৪ এর সাংবাদিক আমিন আল রাশেদ নিজের ফেসবুকে ‘টেলিভিশনের সংকট, চ্যানেল ২৪ এর পদোন্নতি ও অন্যান্য তর্ক’ শিরোনামে দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছে।
ফেসবুক পোস্টে তিনি এসবের নেপথ্য কারন ও সমাধান নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। কালের আলো’র পাঠকদের জন্য পোস্টটি হুবুহু তুলে ধরা হলো- ”একটু অন্য এঙ্গেলে দেখা যাক। সম্প্রতি চ্যানেল নাইনের সংবাদ বিভাগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে অনেক সাংবাদিক বেকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে কতজন দ্রুত অন্য প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে পেরেছেন বা পারবেন, তা বলা মুশকিল।
কারণ অন্য টেলিভিশন, সংবাদপত্র, রেডিও এবং অনলাইন সংবাদপত্রের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। এর মধ্যে কয়েকটি টেলিভিশনে (নাম উল্লেখ করছি না) মাসের পর মাস বেতন বন্ধ; বিশাল করপোরেট হাউজের মালিকানাধীন আরেকটি টেলিভিশন বাজেট কমাতে গিয়ে ঢাকা অফিসের সংবাদ বিভাগের বেশ কয়েকজন এমনকি বড় বড় জেলা থেকেও তাদের প্রতিনিধি কাটছাঁট করেছে।
বিটিভি-উত্তর টেলিভিশন খাতে প্রথম জনপ্রিয় টেলিভিশন এবং আজকে টেলিভিশন খাতে নেতৃত্বে থাকা একটি বড় অংশের উত্থান যে প্রতিষ্ঠানে, সেই একুশে টেলিভিশন বহুদিন ধরেই বিবিধি সংকটে নিমজ্জিত। মিডিয়ায় দখল-পাল্টা কাকে বলে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ এই প্রতিষ্ঠান।
এসবের বাইরে বিদেশি (বিশেষ করে ভারতীয়) চ্যানেলে বাংলাদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার, দর্শকের কাছ থেকে ন্যূনতম কোনো পয়সা না পাওয়া, ক্যাবল নেটওয়ার্ক ডিজিটাল না হওয়ায় টিআরপি নামে এক অদ্ভুত বিষয়ের অজুহাতে বিজ্ঞাপনদাতা ও সংস্থাগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে থাকার মতো পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে চলার যে কঠিন সংগ্রাম করে যাচ্ছে দেশের বেসরকারি টেলিভিশনগুলো—সেই বাস্তবতায়ও চ্যানেল ২৪ তার রিপোর্টার, এডিটর, ঢাকার বাইরের সহকর্মীসহ বিভিন্ন বিভাগে একসাথে এবার অনেকের পদোন্নতি দিয়েছে।
যেখানে অন্য অনেক প্রতিষ্ঠান মাসের পর মাস বেতনই দেয় না, যেখানে কোনো কোনো ব্যবসাসফল প্রতিষ্ঠানও বছরের পর বছর তাদের কর্মীদের ইনক্রিমেন্ট দেয় না, সেখানে চ্যানেল ২৪ কী করে একসাথে এত লোকের পদোন্নতি ও ইনক্রিমেন্ট দিলো বা দিতে পারলো?
ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের ভাষায়, ‘এখানে কোনো ম্যাজিক নেই্।’ অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের মালিক ও নীতিনির্ধারকরা যদি মনে করেন যে, তার কর্মীরাই হচ্ছেন তার ব্যবসার প্রাণ এবং তিনি আজকে যে অবস্থানে এসেছেন, তার পেছনে এই কর্মীদের ভূমিকাই প্রধান—তাহলে কোনো মালিক তার কর্মীর বেতন মাসের পর মাস বন্ধ রাখতে পারেন না। বাজেট কমানোর অজুহাতে কর্মী ছাঁটাই করতে পারেন না।
এখন কেউ হয়তো বলবেন ব্যবসায় লস হলে কী করা যাবে? অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর সংবাদমাধ্যমের বাস্তবতা এক নয়। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠান (দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া) শুধুমাত্র গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান হিসেবে তৈরি হয়নি। প্রত্যেকটি সংবাদমাধ্যম—সেটি টেলিভিশন, পত্রিকা, রেডিও বা অনলাইন যাই হোক, তৈরি হয়েছে সংশ্লিষ্ট মালিকের অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সহায়ক হিসেবে।
সুতরাং আপনার মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমটিকে যেহেতু আপনি আপনার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষায় কাজ লাগাচ্ছেন, তখন এখানে লাভক্ষতির প্রশ্ন আসার কথা নয়।
একটি টেলিভিশনের মালিককে বলতে শুনেছি, ‘আমি যদি খাই, আমার কর্মীও খাবে।’ মালিকদের মধ্যে এই বোধটুকু থাকলে কোনো প্রতিষ্ঠানকে মাসের পর মাস বেতন বন্ধ রাখতে হয় না। বরং কর্মীরাই প্রতিষ্ঠানের দুঃসময়ে মালিকের ঢাল হিসেবে দাঁড়ায়। যে কর্মীরা তার প্রতিষ্ঠানকে ওউন করে, তারা প্রতিষ্ঠানের দুঃসময়ে মাঝে মধ্যে বেতন অনিয়মিত হয়ে গেলেও তা মেনে নেয়।
কারণ তারা জানে এই সংকট কেটে যাবে। কিন্তু আমাদের বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর একটা বড় অংশেরই কোনো বিজনেস মডেল না থাকায় বা টেলিভিশনগুলো চালু হওয়ার প্রক্রিয়াতেই গলদ থাকায় কিংবা আরও পরিস্কার করে বললে, মালিকদের নিয়তে গড়বড় থাকায় এখন এই সংকট।
এরকম একটি কঠিন বাস্তবতার ভেতরে আরও একাধিক নতুন টেলিভিশন চ্যানেল আসছে। কিন্তু তাদের বিজনেস মডেল কী? সেসব টেলিভিশনের মালিকও কি অন্য প্রতিষ্ঠান সুরক্ষার ঢাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য টিভি আনছেন? যদি তাই হয় তাহলে ধরে নিতে হবে, একটা সময় পর সেসব টেলিভিশনের কর্মীরাও ছাঁটাই হবেন, মাসের পর মাস বেতন পাবেন না, ইনক্রিটেমন্ট ও পদোন্নতি তো দূরে থাক। প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইয়িটি না হয় শিঁকেয় তোলা থাকলো।
অস্বীকার করার উপায় নেই, এ মুহূর্তে বাংলাদেশের টেলিভিশন খাত একটি বড় ধরনের বিপদের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বস্তুত এই বিপদের মূল কারণ এখানে ওই অর্থে কেনো পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠেনি। অর্থাৎ আমাদের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও ‘করপোরেট এনটিটি’ হিসেবে গড়ে ওঠেনি।
কিন্তু তার মধ্যেও চ্যানেল ২৪ যে তাদের অনেক কর্মীর পদোন্নতি এবং সবাইকে কমবেশি ইনক্রিমেন্ট দিলো বা দিতে পারলো, সেটি শুধু ধন্যবাদযোগ্যই নয়, বরং অন্য টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর জন্যও একটি বড় বার্তা যে, মালিক ও নীতিনির্ধারকরা আন্তরিক হলে সংকটের ভেতরেও ইনক্রিমেন্ট দেয়া যায়। প্রয়োজন শুধু আপনি আপনার কর্মীদের কী চোখে দেখছেন…।
চ্যানেল ২৪ কে ধন্যবাদ এবং অন্যান্য টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সংকট কেটে যাবে—এই প্রত্যাশা।”
কালের আলো/ডিআর/এমএইচ