কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে সরকার পতনের ইতিহাস শুরু

প্রকাশিতঃ 11:16 am | July 01, 2025

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

১ জুলাই ২০২৪। দিনটি ছিল সোমবার। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদ এবং কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে লাগাতার আন্দোলনের সূচনা করেছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলে উত্তাল ক্যাম্পাস। ৩ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন শিক্ষার্থীরা। তবে সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রতি দিনের মতো বিএনপিকে নিয়ে আওয়ামী লীগ পড়েছিলেন।

সেদিন দুপুরে তেজগাঁও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, “বিএনপির নেতাদের চোখে ঘুম নেই। তাদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। মির্জা ফখরুলের (বিএনপির মহাসচিব) চোখে অশান্তির আগুন। লন্ডন থেকে ফরমান আসে ‘ইন অ্যান্ড আউট’। বিএনপিতে এখন ‘ইন-আউট’ চলছে।” সেই ওবায়দুল কাদের আজ দেশ থেকে পালিয়ে ‘ভারতে’ অবস্থান নিয়েছেন। দলের এই ক্রান্তিলগ্নে হয়তো তার আজ ঘুম হারাম হয়ে গেছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতা থাকা দল আওয়ামী লীগ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। দলের সভাপতি সেদিন ভারতে পালিয়ে যান। তার দলের নেতাকর্মীরা আত্মাগোপনে চলে যান। আওয়ামী লীগ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হলেও সেই আন্দোলনের বীজ রোপন করা হয় ১ জুলাই। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ ৫৬ শতাংশ কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদ এবং কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে লাগাতার আন্দোলনের সূচনা করেছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেদিন মানববন্ধন, সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলে উত্তাল ছিল ক্যাম্পাস।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত এ প্লাটফর্মের নেতৃত্বে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির একদল সংগ্রামী শিক্ষার্থী। তারা হলেন- সাবেক উপদেষ্টা ও জাতীয় নাগরিক পার্টির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম, বর্তমান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া, জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম ও মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার, সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের, জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা আব্দুল হান্নান মাসউদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি রিফাত রশিদসহ অনেকেই। প্ল্যাটফর্ম ঘোষণার দু’দিন পরেই ৬৫ সদস্য বিশিষ্ট সমন্বয়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়।

জুলাইয়ের প্রথমদিকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১ জুলাই চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। কোটা সংস্কারের লক্ষ্যে এদিন চার দফা দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা লাগাতার কর্মসূচি দেয়।

দাবিগুলো ছিল

১. ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখতে হবে।

২. ১৮ এর পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে (সকল গ্রেডে) অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দিতে হবে এবং কোটাকে ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী কেবল অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।

৩. সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে হবে।

৪. দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

১৯ জুলাই ৯ দফা ঘোষণা করেন আব্দুল কাদের। এরপর ইন্টারনেট শাটডাউন, ডিবি হেফাজতে সমন্বয়কদের আটক ও তাদের মুক্তি দাবিতে আন্দোলন গোটা দেশকে উত্তপ্ত করে। এর মধ্যে বাড়তে থাকে লাশের মিছিল। শেখ হাসিনার লেলিয়ে দেওয়া নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের গুলিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আন্দোলনকারীদের নিহত হওয়ার খবর আসতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা ঘোষণা হয়। তারপরও অস্ত্রের জোরে তিনি ক্ষমতায় থাকতে চাইলে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা রাজপথ দখলে নেয়, শেখ হাসিনা জনরোষ থেকে বাঁচতে পালিয়ে ভারতে চলে যান।

মঙ্গলবার এই অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ইতোমধ্যে অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন মাসব্যাপী নিজেদের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

কালের আলো/এএএন