হিজরি নতুন বছর ও মহররম মাসের গুরুত্ব
প্রকাশিতঃ 6:17 pm | June 27, 2025

মাহমুদ আহমদ:
আরবি হিজরি নতুন বছর ১৪৪৭ শুরু হয়েছে। হিজরি বর্ষের প্রথম মাস মহররম। নতুন চাঁদ উঠলে হিজরি ক্যালেন্ডারের নতুন মাস শুরু হয়। হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস মহররম, শেষ মাস জিলহজ। ধারাবাহিকভাবে হিজরি ক্যালেন্ডারের মাসগুলো হলো, ১. মহররম, ২. সফর, ৩. রবিউল আউয়াল, ৪. রবিউস সানি, ৫. জমাদিউল আউয়াল, ৬. জমাদিউস সানি, ৭. রজব, ৮. শাবান, ৯. রমজান, ১০. শাওয়াল, ১১. জিলকদ, ১২. জিলহজ।
ইসলামে মহররম মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। এ মাস আল্লাহতায়ালার নিকট অনেক সম্মানিত ও মর্যাদার একটি মাস। এ মাসে বহু ঐতিহাসিক ফজিলতপূর্ণ ঘটনা ইতিহাসে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। ৬১ হিজরির ১০ মহররম কারবালা প্রান্তরে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় দৌহিত্র, ন্যায়ের মূর্ত প্রতীক হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে চক্রান্তকারী ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে কারবালার প্রান্তরে শাহাদত বরণ করেন। তার শহিদ হওয়াকে কেন্দ্র করে বর্তমানে আশুরার গুরুত্ব পেলেও ইসলামের ইতিহাসে এদিনে অসংখ্য তাৎপর্যময় ঘটনা রয়েছে। এ কারণে মুসলমানরা দিনটিকে বিশেষ ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যের মধ্যদিয়ে স্মরণ করে থাকেন।
মহররম হিজরি বছরের প্রথম মাস হওয়ায় এ মাসে আল্লাহতায়ালার নিকট প্রতিটি মুসলমানের একমাত্র চাওয়া-পাওয়া হলো তিনি যেন মুসলিম উম্মাহকে বছরজুড়ে রহমত বরকত ও কল্যাণ দ্বারা ঢেকে দেন।
যদিও ইসলামের অনেক আগে থেকেই এ মাসের ১০ তারিখ অতি সম্মানিত এবং ফজিলতপূর্ণ। এ দিনে আল্লাহতায়ালা হজরত আদম (আ.)-এর দোয়া কবুল করেন। হজরত নুহ (আ.)-এর জাতির লোকেরা আল্লাহর গজব মহাপ্লাবনে নিপতিত হওয়ার পর ১০ মহররম তিনি নৌকা থেকে ইমানদারদের নিয়ে দুনিয়ায় অবতরণ করেন। হজরত ইবরাহিম (আ.) নমরুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ৪০ দিন পর ১০ মহররম সেখান থেকে মুক্তি লাভ করেন।
হজরত আইয়ুব (আ.) ১৮ বছর কঠিন রোগ ভোগ করার পর মহররমের এ দিনে আল্লাহর রহমতে সুস্থতা লাভ করেন। এ ধরনের আরো অনেক ফজিলতপূর্ণ ঘটনার সাথে মহররম মাস জড়িত।
রাসুল (সা.) বললেন, ‘রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তবে মুহররম মাসে রাখো। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’
ইসলামে মহররম মাসের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে বলেই এ মাসে রোজা রাখা মহানবির (সা.) সুমহান আদর্শ। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সংস্কৃতিতে ও মুসলমানদের জীবনে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম। অথচ হিজরি সন কবে আসে কবে যায়, তা হয়ত আমাদের অনেকেরই জানা থাকে না।
ইসলামি আরবি বর্ষপঞ্জিকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের পুণ্যময় স্মৃতি, তাই যুগ যুগ ধরে মুসলমানদের কাছে হিজরি সাল অনেক গুরুত্ব বহন করে আসছে।
যদিও মুসলমানদের রোজা, হজ, ইদ, কোরবানিসহ ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধান হিজরি সনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বর্তমান যুগে তা কেবল রমজান ও ঈদের হিসাব রাখার মধ্যেই যেন সীমিত।
বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়ত জানেই না হিজরি সাল কি আর আরবি মাসগুলোর নাম। আসলে আরবি মাসগুলোর সাথে আমরা তেমন পরিচিত নই।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই হিজরি সনের শুভ সূচনা হয়। ইসলামি সন তথা হিজরি সন মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কা থেকে মদিনা হিজরতের ঐতিহাসিক তাৎপর্যময় ঘটনার অবিস্মরণীয় স্মারক।
আল্লামা শিবলি নোমানি রহমতুল্লাহ আলাইহি সুপ্রসিদ্ধ আল ফারূক গ্রন্থে উল্লেখ করেন: হজরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে ১৬ হিজরি সনের শাবান মাসে খলিফার কাছে একটি দাপ্তরিক পত্রের খসড়া পেশ করা হয়, পত্রটিতে মাসের উল্লেখ ছিল; সনের উল্লেখ ছিল না। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন খলিফা বললেন, পরবর্তী কোনো সময়ে তা কীভাবে বোঝা যাবে যে এটি কোন সনে পেশ করা হয়েছিল?
অতঃপর তিনি সাহাবায়ে কেরাম ও অন্যান্য শীর্ষ পর্যায়ের জ্ঞানী-গুণীদের পরামর্শে হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জুমাদাল উলা মোতাবেক ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে হিজরি সন প্রবর্তনের এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। হিজরতের বছর থেকে সন গণনার পরামর্শ দেন হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু। পবিত্র মহররম মাস থেকে ইসলামি বর্ষ শুরু করার পরামর্শ প্রদান করেন হজরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু। (বুখারি ও আবু দাউদ)
বর্ষগণনার ক্ষেত্রে হিজরতের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণ কী? অথচ মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত প্রাপ্তিসহ আরো একাধিক বিষয়কে কেন্দ্র করে সন গণনা শুরু করা যেত। এ প্রশ্নের উত্তর আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানি (রহ.) এভাবে দিয়েছেন: সুহাইলি (রহ.) এ বিষয়ে রহস্য উন্মোচন করেছেন। তিনি বলেছেন, সাহাবায়ে কেরাম সন গণনার বিষয়ে হিজরতকে প্রাধান্য দিয়েছেন সুরা তওবার ১০৮ নম্বর আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে। সেখানে প্রথম দিন থেকে তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত মসজিদে নামাজ আদায় করতে বলা হয়েছে। এই ‘প্রথম দিন’ ব্যাপক নয়। এটি রহস্যাবৃত। এটি সেই দিন, যেদিন ইসলামের বিশ্বজয়ের সূচনা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিরাপদে, নির্ভয়ে নিজ প্রভুর ইবাদত করেছেন। মসজিদে কুবার ভিত্তি স্থাপন করেছেন। ফলে সন গণনার ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরাম সেই দিনকেই বেছে নিয়েছেন। (ফতহুল বারি : ৭/২৬৮)
হিজরি বছরের প্রত্যেকটি মাসেরই রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। ইসলামে এ মাসের অনেক গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। মুহাররম মাস শুধু কারবালার ঘটনা স্মরণ করার মাস নয় বরং মুসলিম বিশ্বকে নতুন করে গড়ে তোলার দৃঢ় প্রতিজ্ঞার মাস । ইসলামের ইতিহাসে এই মাসটি এমন কতগুলো উল্লেখযোগ্য স্মৃতিবিজড়িত, যে স্মৃতিসমূহের সম্মানার্থেই এই মাসকে মহররম বা সম্মানিত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাইতো এ মাসের ৯, ১০ অথবা ১০, ১১ তারিখে ২টি রোজা রাখা উত্তম।
হজরত আলিকে (রা.) এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিলেন, রমজানের পর আর কোনো মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জনৈক সাহাবি করেছিলেন, তখন আমি তার খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, ‘রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তবে মুহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’ (জামে তিরমিজি)
হাদিসে আরো বর্ণিত হয়েছে, হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রোজা রাখার জন্য এত অধিক আগ্রহী হতে দেখিনি যত দেখেছি এই আশুরার দিন এবং রমজান মাসের রোজার প্রতি।’ (বুখারি)
মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রমজানের পর সর্বশ্রেষ্ঠ রোজা মহররমের রোজা; আর ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম নামাজ রাতের নামাজ।’ (মুসলিম)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় হিজরতের পর দেখেন ইহুদিরা এদিন রোজা পালন করছে। তখন হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমরা হজরত মুসা আলাইহিস সালামের অনুসরণ করার ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার। তিনি নিজে সেই (আশুরার) দিনের রোজা পালন করলেন এবং সাহাবাদেরকেও (এই আশুরার দিন রোজা) নির্দেশ দিলেন।’ (বুখারি)
আল্লাহপাক আমাদেরকে পবিত্র এ মহররম মাসের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তার ওপর আমল করার তৌফিক দিন। শেষে এটিও স্মরণ করাতে চাই, বিশ্বের বর্তমান অবস্থা খুবই ভয়াবহ। যুদ্ধ এখন থেমে গেলেও পরিস্থিতি নাজুক। অতীতে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র একাধিকবার যুদ্ধবিরতির শর্ত ভেঙেছে।
মানবজাতি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, যে কোনো সময় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে পারে। বিশ্বের নেতৃবর্গের উচিত, যুদ্ধ-বিগ্রহ, রক্তপাত এবং ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মানবজাতিকে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন দেশে সংঘটিত যুদ্ধ বন্ধের জোর প্রচেষ্টা চালানো।
যুদ্ধের ফলে একটি সাজানো গোছানো সুন্দর দেশ ধ্বংস হয়ে যায়। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলিন একদা যেভাবে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধে যে পক্ষই নিজেকে বিজয়ী দাবি করুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে কেউই বিজয়ী না, সব পক্ষই পরাজিত।’ সত্যিই তাই। যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বেসামরিক সাধারণ মানুষের। যুদ্ধে হাজার হাজার নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটে, শহরগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
তাই আমাদের প্রার্থনা, বিভিন্ন দেশে যে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা শুরু হয়েছে তা থেকে যেন আল্লাহতায়ালা সকল নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষকে রক্ষা করেন।
হিজরি নতুন বছর বিশ্ববাসীর জন্য বয়ে আনবে, ঐক্য, সম্প্রীতি, শান্তি-সৌহার্দ্য আর দূর হবে রক্তপাত-হানাহানি-এটাই আমাদের প্রত্যাশা ।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।