নৌবাহিনীতে কমিশন পেলেন ৫২ নবীন কর্মকর্তা, দেশপ্রেমে সর্বোচ্চ গুরুত্বের বার্তা সেনাপ্রধানের

প্রকাশিতঃ 10:16 pm | June 22, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

‘শান্তিতে সংগ্রামে সমুদ্রে দুর্জয়’ তাঁরা। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সদা জাগ্রত থাকার প্রত্যয় সবার চোখে-মুখে। দীর্ঘ কঠিন সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে গ্রীষ্মকালীন রাষ্ট্রপতি কুচকাওয়াজে অংশ নেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নবীন কর্মকর্তারা। রোববার (২২ জুন) বন্দর নগরী চট্টগ্রামের নেভাল একাডেমিতে তখন উৎসবমুখর পরিবেশ। বাদ্যের তালে তালে দৃঢ়পায়ে এগিয়ে চলেন সুসজ্জিত নৌবাহিনীর নবীন কর্মকর্তাদের দল। বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ২০২২-বি ব্যাচের ৪৪ জন মিডশিপম্যান এবং ২০২৫-এ ব্যাচের ৮ জন ডাইরেক্ট এন্ট্রি অফিসারসহ মোট ৫২ জন নবীন কর্মকর্তা কমিশন লাভ করেন। যেখানে রয়েছেন ৮ জন নারী ও ৪ জন বিদেশি কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে সর্বোচ্চ মান অর্জনকারীদের হাতে তুলে দেন পদক। দেশের বিস্তীর্ণ জলসীমার অতদ্র প্রহরী বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নবীন নির্ভীক সদস্যদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আজকের দিনটি সকলের জন্য আনন্দের দিন।  কারণ বিএনএতে দীর্ঘ তিন বছর প্রশিক্ষণ শেষে আজ তোমরা বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে কমিশন লাভ করতে যাচ্ছ। এজন্য তোমাদেরকে জানাই আমার আন্তরিক অভিনন্দন। তোমাদের কাছে আমার প্রত্যাশা এই যে, নেতৃত্বের সর্বোচ্চ গুণাবলী যেমন:  সততা, সত্যবাদিতা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রম দ্বারা নৌবাহিনীর ওপর অর্পিত সকল দায়িত্ব তোমরা আন্তরিকতার সাথে পালন করবে।’

এই প্যারেডে নিজের মুগ্ধতার কথা জানিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, ‘এজন্য তোমাদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তোমাদের এই একাডেমি আমাকে মুগ্ধ করেছে। তোমাদের এই বিল্ডিং এবং পারিপার্শ্বিক সৌন্দর্য এটাতে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছি। নবীন নেতৃত্ব তৈরির লক্ষ্যে ফোর্সের প্রশিক্ষণ সফলভাবে সম্পন্ন করার একাডেমির কমান্ড্যান্ট ও সংশ্লিষ্টদের জানাচ্ছি আন্তরিক ধন্যবাদ। আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারগণের গর্বিত মাতা পিতা ও অভিভাবকদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’

  • দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার শপথ নবীন কর্মকর্তাদের
  • একটি দক্ষ ও আধুনিক নৌবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য
  • যেকোন ধরনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে
  • সার্বভৌমত্ব রক্ষা তোমাদের জীবনের প্রথম এবং প্রধানতম ব্রত 
  • চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে নিজের বিবেকের দ্বারস্থ হবে

আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, অনুষ্ঠানে কৃতিত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণের জন্য কয়েকজন নবীন কর্মকর্তাকে পদক দেওয়া হয়। সব বিষয়ে সর্বোচ্চ নৈপুণ্যের জন্য মিডশিপম্যান মেহেদী হাসান মৃধা ‘সোর্ড অব অনার’, দ্বিতীয় সেরা হিসেবে মিডশিপম্যান মো. মেহেরাব হক তনি ‘নৌ প্রধান স্বর্ণপদক’ এবং কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য অ্যাক্টিং সাব লেফটেন্যান্ট রাজীব দত্ত ‘বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিন স্বর্ণপদক’ লাভ করেন। এ ছাড়া সুদানের মিডশিপম্যান আবোহোরিরা এলবাদাওয়ি আহমেদ এবদেলনাইম পান ‘বিএনএ আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক’।

দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার শপথ নবীন কর্মকর্তাদের

কুচকাওয়াজ শেষে নবীন কর্মকর্তারা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার শপথ নেন। তারা সুবিশাল সমুদ্র রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সন্তানদের এমন অর্জনে গর্বিত অভিভাবকরাও। অভিন্ন কণ্ঠে তাঁরা বলেন, ‘আমার সন্তান আজকে নেভাল অফিসার হয়েছে। গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে। প্রয়োজনে দেশের জন্য প্রাণ দেবে। দেশের নিরাপত্তা ও অগ্রগতির পথে ভূমিকা রাখবে। আপসহীন থাকবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে।

একটি দক্ষ ও আধুনিক নৌবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বক্তব্যের শুরুতেই গভীর শ্রদ্ধা জানান মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় শাহাদাত বরণকারী বীর যোদ্ধাদের, যাদের সুমহান আত্মত্যাগ সব সময় প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখার জন্য একটি দক্ষ, আধুনিক ও দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্ধুদ্ধ নৌবাহিনীর গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। এই নৌবাহিনীর নেতৃত্বের দায়িত্ব মূলত অফিসারদের ওপরেই বর্তায়। এই লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ নেভাল একাডেমি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই একাডেমি থেকে কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারদের নেতৃত্বের শৃঙ্খলা, আনুগত্য, ন্যায়পরায়ণতা ও কর্তব্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী আজ দেশের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বে অবদান রেখে চলেছে।

যেকোন ধরনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে

নতুন কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের যেকোন ধরনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে আহ্বান জানান সেনাপ্রধান। তিনি বলেন, ‘সামরিক চেতনা ও মূল্যবোধকে সমুন্নত রেখে এবং যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দেশপ্রেমকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। তোমাদেরকে সাহসিকতার সাথে সকল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। তোমরা প্রতিনিয়ত নিজের সক্ষমতা বাড়াতে সর্বদা সচেষ্ট থাকবে। নৌবাহিনীর দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, রীতিনীতি, সুনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন পদ্ধতি মনেপ্রাণে সর্বদা গ্রহণ করবে এবং নিজেদেরকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সর্বদা প্রস্তুত রাখবে। মনে রাখবে তোমাদের ওপর অর্পিত হবে নৌবাহিনীর ভবিষ্যৎ নেতৃত্বদানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।’

সার্বভৌমত্ব রক্ষা তোমাদের জীবনের প্রথম এবং প্রধানতম ব্রত

বাংলাদেশ নৌবাহিনীর মূলমন্ত্র ‘শান্তিতে সংগ্রামী সমুদ্রে দুর্জয়’ এটাতে উজ্জীবিত হয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা হবে তোমাদের জীবনের প্রথম এবং প্রধানতম ব্রত এমনটিই মনে করেন সেনাপ্রধান। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাংলাদেশের জন্য নৌবাহিনী একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। আমরা প্রতিনিয়ত চেষ্টায় আছি এই নৌবাহিনীকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ করতে।

বিভিন্ন ধরনের জাহাজ, সাবমেরিন সংযোজনের মাধ্যমে আমাদের সিলাইনআপ কমিউনিকেশন রক্ষা করার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশ আমদানি-রপ্তানি নির্ভর একটি দেশ। এদেশের সিলাইনআপ কমিউনিকেশন রক্ষার দায়িত্ব তোমাদের। ইনশাআল্লাহ তোমরা তোমাদের চাকরি জীবনে প্রত্যক্ষ করবে নতুন নতুন সরঞ্জাম, জাহাজ ও সাবমেরিন এই নৌবাহিনীতে সংযোজিত হবে। তোমরা এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে ইনশাআল্লাহ।’

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে নিজের বিবেকের দ্বারস্থ হবে

নৌবাহিনী একটি অত্যন্ত স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান যেখানে শৃঙ্খলা প্রধান চালিকাশক্তি বলে মনে করেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বলেন, ‘এখানে সকল বিষয় নির্ধারিত নিয়ম, প্রথা ও অনুশাসন দ্বারা পরিচালিত হয়। যেকোন বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে নিজের বিবেকের দ্বারস্থ হবে। তোমরা ভুলে যাবে না, তোমাদের গড়ে তুলতে দেশের খেটে খাওয়া মানুষের অনেক অবদান রয়েছে। মনে রাখবে আমাদের জীবনে ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার গুরুত্ব অপরিসীম। এর মাধ্যমে তোমরা একজন আদর্শবান, মর্যাদাবান ও  উন্নত চরিত্রের নৌ সদস্য হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।’

কালের আলো/এমএএএমকে