প্রতি বছর ৫০ হাজার শিশু হৃদরোগে আক্রান্ত, চিকিৎসার বাইরে ৮৫ শতাংশ

প্রকাশিতঃ 12:22 am | June 01, 2025

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, কালের আলো:

বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৫০ হাজার নবজাতক জন্মগত হৃদরোগ নিয়ে জন্ম নেয়, যাদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ চিকিৎসার অভাবে এক বছরের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করে। অথচ সময়মতো রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা গেলে অধিকাংশ শিশুর জীবন রক্ষা সম্ভব– এমন অভিমত জানিয়েছেন দেশের শীর্ষ শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা।

শনিবার (৩১ মে) রাজধানীর কল্যাণপুরে কিডস হার্ট ফাউন্ডেশনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত দিনব্যাপী জাতীয় বৈজ্ঞানিক সেমিনার ‘নিউনেটাল কার্ডিয়াক কনফারেন্স ২০২৫’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব তথ্য জানান।

নবজাতক ও শিশুদের জন্মগত হৃদরোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন বিষয়ে আয়োজিত এ সেমিনারে দেশের ২৫ জনের অধিক খ্যাতনামা চিকিৎসক ও গবেষক তাদের গবেষণা ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিকিৎসকরাও ভার্চুয়ালি অংশ নেন।

সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে নবজাতক হৃদরোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় এখনো পর্যাপ্ত অবকাঠামো, দক্ষ মানবসম্পদ ও আইসিইউ সুবিধার অভাব রয়েছে। এর ফলে শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ নবজাতকই চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

চিকিৎসক সংকট ও অবকাঠামোর দুর্বলতা

বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের শিশু হৃদরোগ ও জন্মগত হৃদরোগ সার্জন ডা. এমএকে আজাদ বলেন, শিশু হৃদরোগে দেশে প্রতি বছর ৫০ হাজার নতুন রোগী যুক্ত হয়। এর মধ্যে প্রায় ১৬ হাজার শিশুর এক বছরের মধ্যে মৃত্যু ঝুঁকি থাকে। অথচ দেশে প্রতি বছর মাত্র এক হাজারের মতো শিশু চিকিৎসার আওতায় আসে।

তিনি জানান, বর্তমানে দেশে শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন ৫০-৬০ জন, সার্জন মাত্র ১৫ জন এবং দক্ষ আইসিইউ স্পেশালিস্ট ৪-৫ জন, যারা কেবল জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত। ফলে এমন হাজারো শিশু চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

সচেতনতা ও প্রশিক্ষণের গুরুত্ব

সেমিনারের আয়োজক ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. নুরুন্নাহার ফাতেমা বেগম। তিনি বলেন, আগে হার্ট ডিজিজ নিয়ে মানুষের ধারণা ছিল খুবই কম। এখন সচেতনতা কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু নবজাতকের হার্টের সমস্যা চেনার জন্য শিশু চিকিৎসক ও নিউনেটোলজিস্টদের আরও দক্ষ ও সচেতন হওয়া জরুরি। কারণ তারাই প্রথমে রোগীকে দেখেন।

তিনি আরও বলেন, শিশুর জন্মের পরপরই যদি জন্মগত হৃদরোগ শনাক্ত করা যায়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় এবং অনেক সময় একদিনের মধ্যেই শিশুকে বিপদমুক্ত করা যায়। এ কারণেই আর্লি ডিটেকশন মানেই আর্লি ট্রিটমেন্ট এবং আর্লি কিউর।

বাস্তবভিত্তিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি

সেমিনারের একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল ‘হ্যান্ডস-অন ট্রেনিং’ কর্মসূচি। এতে ১৪০ জন চিকিৎসক অংশ নিয়ে নিউনেটাল ইকোকার্ডিওগ্রাফি, ইসিজি, মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশন এবং শিশু হৃদরোগ সংক্রান্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার সম্পর্কে সরাসরি প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণটি অংশগ্রহণকারী চিকিৎসকদের জন্য বাস্তবভিত্তিক ও ফলপ্রসূ অভিজ্ঞতা হিসেবে কাজ করে।

বক্তারা বলেন, দেশের অধিকাংশ শিশু হৃদরোগীই ঢাকার বাইরের, অথচ চিকিৎসাব্যবস্থা ঢাকা কেন্দ্রিক। সেজন্য তারা ঢাকার বাইরে বিশেষায়িত রেফারেল ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার পাশাপাশি সরকারি পর্যায়ে নবজাতক হৃদরোগ শনাক্তকরণ কর্মসূচি চালুর দাবি জানান।

তারা আরও বলেন, শিশুর হার্ট সার্জারির ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কষ্টকর। তাই দরিদ্র শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা চালু করে ২.৫–৩ লাখ টাকার মধ্যে সাশ্রয়ী চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা গেলে জীবন বাঁচানো সহজ হবে।

সেমিনারের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. নাজমুল হোসেন। তিনি বলেন, নবজাতকের জন্মগত হৃদরোগ একটি জাতীয় জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ। এজন্য সরকার, বেসরকারি খাত এবং চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।

এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ নিউরাল ফোরাম, বাংলাদেশ পেরিনেটাল সোসাইটি ও পিডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সোসাইটি অব বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা।

সেমিনারের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ছিল একমি ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।

কালের আলো/এসএকে