রানা প্লাজা ট্রাজেডির ৬ বছর : বিচার কত দূর?

প্রকাশিতঃ 10:56 am | April 24, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

রাজধানীর অদূরের শহরতলী সাভারে ছয় বছর আগে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঘটেছিল তৈরি পোশাকশিল্পের ইতিহাসে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী দূর্ঘটনা। ওইদিন রানা প্লাজা ভবন ধসে নিহত হয় ১,১৩৮ জন শ্রমিক৷ এই ঘটনা প্রশ্নবিদ্ধ করে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতটিকে৷ এরপর বড় ধরনের সংস্কার আর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তৈরি পোশাক শিল্পকে।

নিহতদের পরিবার আজও বহন করে চলেছে স্বজন হারানোর বেদনা। ছয় বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও মর্মান্তিক ওই ঘটনার বিচার না হওয়ায় প্রশমিত হয়নি আপনজন হারানের সেই বেদনা।

সাভারের গেন্ডা এলাকায় নির্মিত রানা প্লাজা ভবনটি ছিল আটতলা, তবে রাজউকের অনুমোদন ছিল চারতলা। ভবন নকশা করা হয়েছিল দোকান আর অফিসের জন্য। কিন্তু পাঁচটি ফ্লোরে স্থাপন করা হয়েছিল পোশাক কারখানা৷ ভারি যন্ত্রপাতি আর সেগুলোর কম্পন বহন করার সক্ষমতা ছিল না ভবনটির৷ ফলে ভবনটিতে ফাঁটল দেখা দেয়। কাঠামোতে এই বিপদজনক ফাঁটলের কারণে বন্ধ করে দেয়া হয় নিচ তলার দোকান আর ব্যাংকের কার্যালয়৷

রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা ছিলেন স্থানীয় যুবলীগের সদস্য৷ ভবনটির মুল কাঠামোর ফাঁটলকে তিনি দেয়ালের প্লাস্টারে ফাঁটল বলে ধামাচাপা দেন এবং দাবি করেন, ভবনটি সম্পূর্ণ নিরাপদ৷ ভবনের বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা কাজে যোগ দেওয়া পড়ে যান। কাজে যোগ না দিলে তাদের ওই মাসের বেতন না দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয় এবং কাজে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়।

পোশাক শ্রমিকরা সকাল ৮টায় কারখানায় প্রবেশ করে কাজে যোগ দেয়। সচল হয় মেশিন । এর ১৫ মিনিট পরেই সোয়া ৮টায় ভবনটি ধসে পড়ে। ঘটনার সময় ভবনের পাঁচটি পোশাক কারখানায় কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করছিল। বিশ্বের ভয়াবহতম এ ভবন ধ্বসের ঘটনায় এক হাজার ১৩৮ জন নিহত হয়। আহত হয় দুই হাজার শ্রমিক। যাদের মধ্যে পাঁচ শতাধিক শ্রমিক চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায়। অনেকে আজও ভুগছেন মানসিক যাতনায়৷

রানা প্লাজায় যে ৫ টি কারখানা ছিল, সেগুলোর ক্রেতাদের মধ্যে ছিল ওয়ালমার্ট, সিঅ্যান্ডএ, কিক-এর মতো কয়েকটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড৷ পোশাক কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ নিয়ে এ সময় তারা ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়ে৷ ইউরোপ, অ্যামেরিকার সাধারণ ক্রেতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংগঠন এসব ব্র্যান্ডের স্টোরের সামনে বিক্ষোভ করেন৷

আহত ও নিহতদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য রানা প্লাজা ধসের ৬ মাস পর জেনেভায় একটি উদ্যোগ নেয় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও৷ পরবর্তীতে সরকার, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডসহ বিভিন্ন পক্ষকে নিয়ে গঠিত হয় ‘রানা প্লাজা কো অর্ডিনেশন কমিটি’, যার মাধ্যমে ২০১৫ সালে এসে ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত হয়৷ মোট ৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয় নিহতদের পরিবার ও আহতদের৷

ভবন ধ্বসের ৬ বছর পার হলেও অনেক নিহত শ্রমিকদের স্বজন ও আহত শ্রমিকদের দাবি, তারা পায়নি প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের সুবিধা। ফলে অর্থাভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা নিতে না পারায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি অনেক আহত শ্রমিক। ভবন ধ্বসে ক্ষতিগ্রস্তের শিকার শ্রমিকদের আজও তাদের অধিকার ও ক্ষতিপূরণের জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে।

এ ঘটনায় মোট তিনটি মামলা হয়। এর মধ্যে অবহেলাজনিত মৃত্যু চিহ্নিত হত্যা মামলাটি করে পুলিশ। ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণের অভিযোগে অপর মামলাটি করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। আর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে আরেকটি মামলা করে।

প্রায় তিন বছর আগে হত্যার অভিযোগে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। অভিযোগ গঠনের আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আটজন আসামি হাইকোর্টে আবেদন করেন। শুনানি নিয়ে এই আটজনের পক্ষে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ আসে।

ইতিমধ্যে ছয়জন আসামির স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়েছে। কেবল সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফায়েত উল্লাহ এবং তৎকালীন কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানের পক্ষে স্থগিতাদেশ বহাল আছে। রেফায়েত উল্লাহর স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে আগামী ৯ মে পর্যন্ত। আর মোহাম্মদ আলীর পক্ষে আগামী জুন মাস পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়।

রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় অপর দুই মামলার মধ্যে ইমারত নির্মাণ আইনে মামলায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ওই অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম (সিজিএম) আদালত পরের বছর ১৪ জুন অভিযোগ গঠন করেন। ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন আসামি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন আবেদন করেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রিভিশন আবেদন করায় ইমারত আইনের মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম বন্ধ আছে। সিজিএম আদালতে নথি আসার পর সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম শুরু হবে।

রানা প্লাজা ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতির মামলায় ২০১৭ সালের ২১ মে সোহেল রানাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। শুধুমাত্র এ মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম চলছে ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে।

ছয় বছরেও হত্যা এবং ইমারত নির্মাণ আইনের মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু না হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবী ও ভুক্তভোগীরা।

এই পরিস্থিতিতে ভবন ধসের বিচার এবং নিহতদের পরিবারকে প্রয়োজনীয় ও আহতদের পুনর্বাসনের দাবি মঙ্গলবার থেকে রানা প্লাজার সামনে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করছেন রানা প্লাজার আহত শ্রমিকরা। তারা ১১ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবেন না বলে জানিয়েছেন।শ্রমিকদের ১১ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে, রানা প্লাজার সকল ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, সকলকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে, আজীবন চিকিৎসা করাতে হবে,

জাতীয় রানা প্লাজা শোক দিবস ঘোষণা করতে হবে, আহত ও নিহত সকল শ্রমিকদের সন্তানদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিতে হবে, সকল আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে, আসামিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে, উদ্ধার কর্মীদের চিকিৎসা করাতে হবে, স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করতে হবে, আহত নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের পরিবারের চিকিৎসা করাতে হবে এবং রানা প্লাজা ধ্বসে ক্ষতিগ্রস্তদের চাকরি দিতে হবে।

কালের আলো/এমএইচ/এসআর

Print Friendly, PDF & Email