ব্যাংক ঋণের ৭৬ শতাংশই পেয়েছেন কোটিপতিরা
প্রকাশিতঃ 3:17 pm | May 20, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:
দেশে ব্যাংক ঋণের ৭৬ শতাংশের বেশি পেয়েছেন কোটিপতি বা বড় অঙ্কের ঋণগ্রহীতারা। আর লাখ টাকার নিচে যারা ঋণ নিয়েছেন—সাধারণত যারা কৃষক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা নিম্ন আয়ের মানুষ—তাদের প্রাপ্ত ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২ শতাংশেরও কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে এমন কথা।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের হিসাব সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬ কোটি ৩২ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩২টি। এসব হিসাবে মোট জমার পরিমাণ ছিল ১৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এই সংখ্যা ছিল ১৫ কোটি ৩৫ লাখ ৬০ হাজার ৯৩৭টি এবং আমানতের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। এক বছরে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
ঋণ বিতরণেও একই ধরনের প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলো ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে, যেখানে ঋণগ্রহীতার সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২৯ লাখ ২৭ হাজার ৮১০ জন। এক বছর আগে ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৩৮ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরে ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ। কিন্তু একই সময় ঋণগ্রহীতা বেড়েছে মাত্র ১ লাখ ৪৬৮ জন। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো মূলত একই ধরনের গ্রাহকদের ওপর নির্ভরশীল থেকে ঋণ বিতরণ বাড়িয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ২৯ দশমিক ০৩ শতাংশ নিয়েছেন মাত্র ৪ হাজার ২৬৮ জন গ্রাহক। এদের প্রত্যেকেই ৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছেন। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। ২০ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছেন এমন গ্রাহকের সংখ্যা ১২ হাজার ৩০৬ জন, যাদের হাতে রয়েছে মোট ঋণের ৪৩ দশমিক ৮০ শতাংশ বা ৭ লাখ ৯৪ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা।
এছাড়া ৫ কোটি টাকার বেশি ঋণ নেওয়া গ্রাহকের সংখ্যা ৪৫ হাজার ৩৩৯ জন। তাদের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১১ লাখ ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬২ দশমিক ১৪ শতাংশ। ১ কোটি টাকার বেশি ঋণ নেওয়া গ্রাহকের সংখ্যা ১ লাখ ৬১ হাজার ৮৯৮ জন, যাদের পকেটে গেছে মোট ঋণের ৭৬ দশমিক ০৩ শতাংশ অর্থাৎ ১৩ লাখ ৩৭ হাজার ২২৭ কোটি টাকা।
আবার, লাখ টাকার নিচে যারা ঋণ নিয়েছেন, তাদের সংখ্যা ও প্রাপ্ত ঋণ তুলনামূলকভাবে নিতান্তই কম। এসব নিম্ন আয়ের গ্রাহকের মোট ঋণ ছিল মাত্র ৪৬ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। অতিক্ষুদ্র উদ্যোক্তা—যারা ১ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিয়েছেন—তাদের মোট প্রাপ্ত ঋণ ৭৩ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ। নতুন ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা (যারা সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিয়েছেন) মোট ঋণের ১২ দশমিক ২৬ শতাংশ পেয়েছেন, যার পরিমাণ ২ লাখ ৬ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। কোটি টাকার নিচে ঋণ পাওয়া মধ্যম আয়ের চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীরা মোট ৯৪ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছেন, যা ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বৈষম্যমূলক ঋণ বিতরণব্যবস্থা অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করছে। অথচ দেশের উৎপাদনশীলতা এবং কর্মসংস্থানে বড় অবদান রাখে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। কিন্তু ব্যাংকগুলো বড় অঙ্কের লাভের আশায় মূলত কোটিপতিদের দিকেই ঝুঁকছে।
প্রান্তিক পর্যায়ের ঋণপ্রত্যাশীদের অবহেলা করা উচিত নয় বলে মনে করেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমাদের জিডিপির বড় অংশ নগরকেন্দ্রিক। এর মধ্যে বেশিরভাগই ঢাকাকেন্দ্রিক এবং চট্টগ্রামে হয়ে থাকে। ফলে ঋণ ও বিনিয়োগেও এই কেন্দ্রিকতা দেখা যায়। তবে প্রান্তিক পর্যায়ের ঋণপ্রত্যাশীদের উৎপাদনমুখী খাতে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে অর্থনীতির ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করা সম্ভব।’
কালের আলো/এমএএইচএন